জুলাই ০৫, ২০২১ ১৫:২৬ Asia/Dhaka

এক সৌদি ওয়াহাবি মদিনায় মহানবীর (সা)রওজা পাক ও মসজিদে নববীর খুব কাছেই অবস্থিত জান্নাতুল বাকি কবরস্থানে প্রখ্যাত ইরানি আলেম হুজ্জাতুল ইসলাম মুহসিন ক্বারায়াতিকে বলল: কেনো ফাতিমা, হাসান ও হুসাইন এদেরকে সম্বোধন করে ডাকছ? তাঁরা তো মরে গেছেন! মাটি হয়ে গেছেন!

এরপর ওই ওয়াহাবি হাত থেকে একটি কলম বা বলপেন মাটিতে ফেলে ডাক দিয়ে বলল: হে হাসান! হে জাইনুল আবেদিন! হে ইমাম বাক্বির! এই কলমটা আমার হাতে তুলে দিন!- এরপর বলল: দেখলেন তো কোনো জবাব দিলেন না! অর্থাৎ উনারা মরে গেছেন ও তাঁদের আর কোনো ক্ষমতা নাই!

ইরানি আলেম হুজ্জাতুল ইসলাম মুহসিন ক্বারায়াতি ওই কলমটা হাতে তুলে নিয়ে আবার তা মাটিতে ফেলে দেন! তিনি এবার ডাক দিয়ে বললেন: হে আল্লাহ! কলমটা আমার হাতে তুলে দিন!

এরপর ওই ওয়াহাবিকে বললেন: দেখলেন তো আল্লাহও কলমটা তুলে দিতে পারলেন না ও কোনো জবাব দিলেন না! অতএব আপনার যুক্তি অনুযায়ী আল্লাহও মরে গেছেন! যারাই জীবিত তাদেরকে কি অবশ্যই আপনার চাকর হতে হবে?

ওয়াহাবি লা-জওয়াব হয়ে গেল!

সুরা মুমতাহিনার শেষ আয়াত তথা ১২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

মুমিনগণ, আল্লাহ যে জাতির প্রতি রুষ্ট, তোমরা তাদের সাথে বন্ধুত্ব করো না। তারা পরকাল সম্পর্কে নিরাশ হয়ে গেছে যেমন কবরস্থ কাফেররা নিরাশ হয়ে গেছে।-এ আয়াত থেকে স্পষ্ট কবরস্থ কাফিররাও চেতনাহীন নয়! তাই মহান আল্লাহর ওলি ও শহীদরা এবং মুমিন মুসলমানরা মৃত্যুর পর কিভাবে চেতনাহীন হতে পারে? তাঁরা স্বপ্নে এসে দেখা দিয়ে কিভাবে নানা বার্তা দেন যদি মৃত হওয়া মানেই নিশ্চিহ্ন এবং অস্তিত্বহীন হওয়ার অবস্থা হত? পার্থিব জীবনে মৃত্যু মানে দেহের অবসান বা দেহান্তর কিন্তু আত্মা সবই দেখতে পায় ও বুঝতে পারে। তা না হলে কবরবাসীকে সালাম করার নির্দেশ ইসলামে থাকত না! তবে যারা জালিম, পাপাচারী ও কাফির তাদের আত্মা কষ্টে থাকে ও মুমিনদের আত্মা শান্তিতে থাকে!

বিশ্ব-জগতে আমাদের অবস্থানকে বুঝতে হলে তার আগে খানিকটা বুঝতে হবে মহান আল্লাহর নামগুলোর অর্থ ও তাৎপর্য। মহান আল্লাহর আসমাউল হুসনার অন্তর্ভুক্ত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নাম হল কাবির। পবিত্র কুরআনে এই নামটি ছয় বার এসেছে। পাঁচ বার আলিয়্যু ও একবার মুতাআল নামের সঙ্গে। কাবির  শব্দটি এসেছে কাবুর থেকে যার অর্থ হল বড় বা উচ্চ বা মর্যাদাময় এবং যা ক্ষুদ্র বা ছোট শব্দের বিপরীত অর্থবোধক। কাবির নাম থেকেই কিবরিয়া শব্দটি উদ্ভূত। এর অর্থ বড়ত্ব, মহত্ত্ব ও গৌরব ইত্যাদি। পবিত্র কুরআনে সুরা হজের ৬২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তাঁর আলী নামের পাশে কাবির শব্দ ব্যবহার করে বলেছেন: এটা এ কারণেও যে, আল্লাহই সত্য; আর তাঁর পরিবর্তে তারা যাকে ডাকে, তা অসত্য এবং আল্লাহই সবার উচ্চে, মহান।

কাবির শব্দের ব্যবহার বয়সে বড় হওয়া ও মর্যাদায় বড় হওয়া এবং অন্য অনেক ক্ষেত্রে বড় বা উচ্চ অবস্থানের অর্থবোধক। আরবিতে এর সমার্থবোধক শব্দ আযিম বা সম্মানিত। হীন বা অপদস্থ শব্দের বিপরীতে এই আজিম শব্দ ব্যবহার করা হয়। কোনো একটি জিনিষ অন্য জিনিষের তুলনায় বড় বা ছোট হতে পারে। কিন্তু মহান আল্লাহর আজিম শব্দকে কোনো কিছুর সঙ্গেই তুলনা করা যায় না। এই আজিম-এর মধ্যে কোনো তুচ্ছ বৈশিষ্ট্য আরোপ করা যায় না। অবশ্য বস্তুগত ক্ষেত্রে বিশাল অর্থে আজিম শব্দের ব্যবহার রয়েছে। অবস্তুগত ক্ষেত্রেও ব্যাপক বা অতি বড় অর্থে এই শব্দের ব্যবহার রয়েছে। যেমন, অনেক বড় বেদনা বা দুঃখ। কাবির শব্দটি মহান আল্লাহর আযামাত, গৌরব বা বড়ত্বের উচ্চতর অবস্থা তুলে ধরে। মহান আল্লাহ এমনই কাবির বা বড় যে কোনো বর্ণনার মাধ্যমে তাঁর পরিপূর্ণ পরিচয় তুলে ধরা সম্ভব নয়। বুদ্ধি ও কল্পনার সর্বোচ্চ প্রয়োগের মাধ্যমে আমরা শ্রেষ্ঠত্ব বা বড়ত্বের যে কল্পনাই করি না কেন মহান আল্লাহ তার চেয়েও অনেক অনেক বেশি বড়। আল্লাহু আকবার তথা আল্লাহ সবচেয়ে বড় বা তাকবির ধ্বনি মুসলমানদের সবচেয়ে বড় শ্লোগান। আমরা তাকবিরাতুল ইহরাম দিয়ে নামাজ শুরু করি। এরপর নামাজ-সংশ্লিষ্ট কাজ বা ভাবনা ছাড়া অন্য সব কিছু করা বা ভাবা নিষিদ্ধ। নামাজের প্রথমেই আমরা এটা স্মরণ করছি ও স্বীকৃতি দিচ্ছি যে মহান আল্লাহর চেয়ে বড় ও মহীয়ান কিছু নেই। তাই একমাত্র আল্লাহর সামনেই মাথা নত করছি ও সিজদা দিচ্ছি। মহানবী (সা) যখন নামাজে দাঁড়াতেন তখন তিনি আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকেই ও অন্য কিছুকেই চিনতেন না। সুরা আসরার শেষ আয়াত তথা ১১১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ কাবির জাতীয় শব্দ 'কাব্বারাহু তাকবিরা' ব্যবহার করে বলছেন:

হে নবী আপনি বলুন:  সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর যিনি না কোন সন্তান রাখেন, না তাঁর সার্বভৌমত্বে কোন শরীক আছে এবং যিনি  কখনও দুর্বল বা দুর্দশাগ্রস্ত হন না, যে কারণে তাঁর কোন সাহায্যকারীর প্রয়োজন হতে পারে। সুতরাং আপনি তাঁর মাহাত্ম্য  বর্ণনা করতে থাকুন যেভাবে তাঁর মাহাত্ম্য বর্ণনা করা উচিত। -

তুলনা করা যেতে পারে এমন সব কিছুর চেয়ে বড় ও মর্যাদাসম্পন্ন হলেন মহান আল্লাহ। এক ব্যক্তি ইমাম জাফর আস সাদিক্ব (আ)'র সামনে বলেছিল: আল্লাহু আকবর! তথা আল্লাহ সবচেয়ে বড়! ইমাম তখন তাকে প্রশ্ন করলেন : আল্লাহ কিসের চেয়ে বড়? তখন লোকটি বলল: আল্লাহ সব কিছুর চেয়ে বড়। ইমাম তখন বললেন: আক্ষেপ তোমার প্রতি! তুমি তো এই কথা বলে মহান আল্লাহকে সীমাবদ্ধ করে দিলে! আল্লাহর সমান মানের বা জাতের এমন কিছু কি আছে যে তিনি তার চেয়ে বা ওই শ্রেণীর মধ্যে সবচেয়ে বড়? ওই ব্যক্তি তখন প্রশ্ন করলেন: তাহলে কি বলব? ইমাম বললেন: বলো যে বর্ণনার মাধ্যমে প্রকাশ করা যায় এমন সব কিছুর চেয়ে বড় হলেন মহান আল্লাহ। -

মুমিনের দৃষ্টিতে শ্রেষ্ঠত্ব, মহত্ত্ব ও গৌরব আর অহংকার কেবলই মহান আল্লাহর প্রাপ্য। সর্বাবস্থায় ও সব কিছুর মোকাবেলায় মহান আল্লাহ সবচেয়ে বড়। রুকু বা কুর্নিশ ও সিজদা বা মাটিতে কপাল স্পর্শ করে মুমিন মহান আল্লাহর মোকাবেলায় নিজের হীনতা ও তুচ্ছতা এবং বিনম্রতা প্রকাশ করে মহান আল্লাহর চিরস্থায়ী শ্রেষ্ঠত্ব ও উচ্চ মর্যাদার স্বীকৃতি দেন।  আর এভাবে মু'মিন বা বিশ্বাসী আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের ছায়ায় সম্মান অর্জন করতে চান। মু'মিন অন্যদেরকেও আল্লাহর দিকে আহ্বান করেন এবং এ পথে ডেকে তিনি অন্য মুমিনদেরও সম্মানের পাত্র করেন।

সুরা মুল্‌ক্‌-এর ১২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

নিশ্চয়ই যারা তাদের পালনকর্তাকে না দেখে ভয় করে, তাদের জন্যে রয়েছে ক্ষমা ও মহাপুরস্কার।  দেন। - এখানে মহাপুরস্কার শব্দটি বোঝাতে 'আযরুন কাবিরুন' শব্দদ্বয় ব্যবহার করেছেন মহান আল্লাহ। তাই বিশ্লেষকরা বলেন এ পুরস্কার এত ব্যাপক ও ক্রমবর্ধমান যে কোনো চোখ কখনও তা দেখেনি, কোনো কান কখনও তা শোনেনি ও কোনো হৃদয় কখনও তা কল্পনাও করেনি!

পবিত্র কুরআনে সৎকাজে অগ্রগামীতার গুণকে বড় ধরনের ফজিলত বা যোগ্যতা বোঝাতে আল ফাজলুল কাবির এবং চিরস্থায়ী বেহেশত পাওয়াকে বড় ধরনের সাফল্য বোঝাতে আল ফাওজুল কাবির  শীর্ষক শব্দ-যুগল ব্যবহার করা হয়েছে।

মহান আল্লাহর কাবির নামের প্রভাব যাদের ওপর পড়ে সেইসব সৌভাগ্যবান মুমিনরাও আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে বড়  ও জীবনের লক্ষ্য বলে মনে করেন না এবং তারা বলদর্পি, জালিম, অবিশ্বাসী ও কুপ্রথার প্রচলনকারী অহংকারী ব্যক্তিদের মোকাবেলায় অহংকার দেখান বা তাদেরকে তুচ্ছ মনে করেন। ইসলামী জ্ঞান অনুযায়ী কয়েকটি ক্ষেত্রে অহংকার দেখানো বৈধ। যেমন, যুদ্ধের ময়দানে জালিম শত্রুর মোকাবেলায়, অহংকারী ব্যক্তির মোকাবেলায় ও নারীর ক্ষেত্রে পরপুরুষের মোকাবেলায়। হযরত আলী (আ) বলেছেন, অহংকারীর মোকাবেলায় অহংকার দেখানোটাই বিনয়। হযরত জাইনাব (সা.আ) যখন কুফার খোদাদ্রোহী জালিম শাসক ইবনে জিয়াদের দরবারে প্রবেশ করেন তখন তিনি এমন আত্মমর্যাদাবোধ নিয়ে প্রবেশ করেন ও জালিম এই খোদাদ্রোহী পরপুরুষের সামনে এত ভালোভাবে ইসলামী দায়িত্ব পালন করেন যে ওই জালিম নিজের অজান্তেই বলে ওঠে: এই গর্বিত নারী কে? #

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ৪

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।