আসমাউল হুসনা (পর্ব-৪১)
মহান আল্লাহর নাম ও গুণগুলোর অর্থ বা পরিচিতি জানার মাধ্যমে মানুষ পৃথিবীর বুকে আল্লাহর খলিফা হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে যে যোগ্যতা ফেরেশতাদেরও নেই। এইসব নাম মহান আল্লাহর এক একটি গুণের পূর্ণতার প্রকাশ।
মহান আল্লাহর প্রকৃত খলিফা বা প্রতিনিধি হতে হলে ও পূর্ণতা অর্জন করতে হলে মানুষকেও এইসব নামের মুখাপেক্ষী হতে হবে এবং এইসব নামের ঔজ্জ্বল্য তুলে ধরতে হবে জীবনে।
মহান আল্লাহর আসমাউল হুসনার অন্তর্ভুক্ত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নাম হল জালিল। মহান আল্লাহ'র 'জুল জালাল' নাম থেকে এসেছে এই নাম। এই নামের অর্থ মহান বা বড় ও গৌরবময় বা জাঁকজমকপূর্ণ। মহান আল্লাহর জ্বালালি নামগুলো গৌরব, ঔজ্জ্বল্য, শ্রেষ্ঠত্ব ও কর্তৃত্ব-এসব তুলে ধরে। এসব নামের মাঝে মহান আল্লাহর ক্রোধ, পরাক্রম ইত্যাদির প্রকাশ রয়েছে। যেমন, কাহ্হার, ক্বাবিদ বা ক্বাবিয ... এসব নাম মহান আল্লাহর সৌন্দর্যবাচক বা জামালি নামের বিপরীত। জামালি নামগুলো মহান আল্লাহর দয়া, দাক্ষিণ্য, আনন্দ ইত্যাদি তুলে ধরে। মহান আল্লাহর এসব নামের মধ্যে রয়েছে রাহিম, লাতিফ, নুর, হাদি, রাজ্জাক ইত্যাদি। জামালি নাম মহান আল্লাহর প্রতি নৈকট্যের অনুভূতির মাধ্যমে বান্দাকে আকৃষ্ট ও প্রেমাসক্ত করে। অন্যদিকে জ্বালালি নামগুলো মহান আল্লাহর প্রতি বান্দাহর মনে ভয়, সমীহ ও আতঙ্ক -এসব সৃষ্টি করে যে আল্লাহ তার কাজ ও কথা পর্যবেক্ষণকারী। জামালি নামগুলো আকর্ষণবাচক ও জ্বালালি নামগুলো বিকর্ষণবাচক হলেও এ দুই ধরনের নামই আসলে পরস্পরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অন্য কথায় মহান আল্লাহর জ্বালালগুলো জামালবিহীন নয় এবং জামালগুলোও জালালবিহীন নয়। এসব নামই পরস্পরের সমান্তরাল।
মহান আল্লাহ সুরা আররাহমানের ২৬ নম্বর আয়াতে বলেছেন: পার্থিব বা ভূপৃষ্ঠের সবকিছুই ধ্বংসশীল। একমাত্র আপনার মহিমায় ও মহানুভব পালনকর্তার যাত্ বা সত্তাই টিকে থাকবে। -অনেকেই এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন মহান আল্লাহর দয়া ও করুণা এবং মহানুভবতা এসবই আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব, অনন্য গৌরব ও অসীম জালাল বা ঔজ্জ্বল্যের কারণেই বান্দারা পেয়ে থাকে। মহান আল্লাহর জালিল নামটি জালাল থেকে উদ্ভূত বলে এর অর্থ শ্রেষ্ঠত্ব, বড়ত্ব, মহত্ত্ব, গৌরব, ঔজ্জ্বল্য ইত্যাদি তুলে ধরে। পারিভাষিক ক্ষেত্রে জালিল তাকেই বলা হয় যিনি পূর্ণতাবাচক সব গুণের অধিকারী যেমন, রাজত্ব, ধন-সম্পদ, ক্ষমতা ও সম্মানের অধিকারী হওয়া। অন্য কথায় জালিল হচ্ছেন এমন কেউ যার মোকাবেলায় সব রাজা-বাদশাহ, পার্থিব ও আধ্যাত্মিক উভয় ক্ষেত্রের মহারাজাধিরাজ ও মহাক্ষমতাধররাও অত্যন্ত অক্ষম, ক্ষুদ্র, দরিদ্র ও অভাবী। এমন পদ আসলে সেই মহান সত্ত্বার যার বিধি-বিধান মেনে চলা অন্যদের জন্য ফরজ ও অপরিহার্য। কারো কারো মতে মহান আল্লাহ জালিল কারণ তাঁর সৃষ্টিকুল হচ্ছে বিস্ময়কর এবং তাঁর সৃষ্টির মধ্যেই মহান আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও অনন্য গৌরব-গরিমার বিষয়টি ফুটে উঠে।
মহান আল্লাহ অন্য যে কারণেও জালিল বা মহামর্যাদাবান তা হল সব কিছুর ওপর রয়েছে তাঁর কর্তৃত্ব ও জ্ঞান।
মহান আল্লাহ'র জালিল নাম তাঁর সৌন্দর্যকেও তুলে ধরে। জামিল শব্দের মাধ্যমে বাহ্যিক সৌন্দর্যকে বোঝানো হয়। অন্যদিকে জালিল বলতে আধ্যাত্মিক বা সুপ্ত সৌন্দর্যের ধারণা দেয়া হয়। অস্তিত্বের জগতে সৌন্দর্য ও পূর্ণতাবাচক যা কিছু রয়েছে সবই মহান আল্লাহর সত্ত্বাগত আলোকমালা ও গুণেরই প্রকাশ। মহান আল্লাহর বিধি-নিষেধ বা আদেশ-নিষেধও সৌন্দর্য ও পূর্ণতার মতই। সুরা মায়েদার ৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন: আল্লাহ তোমাদেরকে অসুবিধায় ফেলতে চান না; কিন্তু তোমাদেরকে পবিত্র রাখতে চান এবং তোমাদের প্রতি নিজ নেয়ামত পূর্ণ করতে চান-যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।– এখানে বোঝানো হচ্ছে যে বাহ্যিক ধর্মীয় দায়িত্বগুলো পালন আধ্যাত্মিক পবিত্রতা নিয়ে আনে। আর এই আত্মিক পবিত্রতা হৃদয়ের সৌন্দর্যকে করে নিশ্চিত।
যাকাত দিলে গেলে বাহ্যিক দৃষ্টিতে সম্পদ কমে যায়, কিন্তু বাস্তবে তা বরকত ও প্রাচুর্য তথা সমৃদ্ধি নিয়ে আনে। ফলে মানুষের ভেতরটা হয় সুন্দর। তাই আল্লাহর খাঁটি বান্দাহরা মন ও প্রাণ দিয়ে আল্লাহর আদেশ ও নিষেধগুলো মেনে চলেন।
পবিত্র কুরআনও মহান আল্লাহর জামাল ও জালাল-এর প্রকাশ। সুরা আসরার ৮২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন: আমি কুরআনে এমন বিষয় নাযিল করি যা রোগের সুচিকিৎসা এবং মুমিনের জন্য রহমত। গোনাহগারদের তো এতে শুধু ক্ষতিই বৃদ্ধি পায়। -অন্য কথায় কুরআন খোদাদ্রোহীদের পথ দেখায় না। আর তারা কুরআন থেকে দূরে থেকে নিজেদের ক্ষতিই বাড়িয়ে চলে।
মহান আল্লাহর জালিল নামের আরেকটি অর্থ হল আল্লাহ সবাইকে দেখতে পেলেও কোনো চোখই আল্লাহকে দেখতে সক্ষম নয়। সুরা আরাফ-এর ১৪৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন: তারপর মূসা যখন আমার প্রতিশ্রুত সময় অনুযায়ী এসে হাযির হলেন এবং তাঁর সাথে তাঁর পরওয়ারদেগার কথা বললেন, তখন তিনি বললেন, হে আমার প্রভু, তোমার দিদার আমাকে দাও, যেন আমি তোমাকে দেখতে পাই। তিনি বললেন, তুমি আমাকে কখনও দেখতে পাবে না, তবে তুমি পাহাড়ের দিকে দেখতে থাক, সেটি যদি স্বস্থানে দাঁড়িয়ে থাকে তবে তুমিও আমাকে দেখতে পাবে। তারপর যখন তার পরওয়ারদেগার পাহাড়ের উপর আপন জ্যোতির বিকিরণ ঘটালেন, সেটিকে বিধ্বস্ত করে দিলেন এবং মূসা অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন।
তাই মহান আল্লাহর জ্বালালগুলো হচ্ছে এমনই যা পুরোপুরি বোঝা সম্ভব নয়। এমন অতি উচ্চ ও মহান আল্লাহই আবার বান্দাদের অতি আপন ও ঘনিষ্ঠ হয়ে বলেন: 'এমন কোনো তওবাকারী আছে যে যার তওবা আমি কবুল করব? খোদা-সন্ধানী ও খোদার প্রতি আহ্বানকারী কেউ কি আছে যার আহ্বানের জবাব আমি দেব? আমি তো অন্য সব কিছুর চেয়ে তাদের বেশি কাছে রয়েছি।'
সুরা মুজাদিলার সপ্তম আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন:
আপনি কি ভেবে দেখেননি যে, নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলে যা কিছু আছে, আল্লাহ তা জানেন। তিন ব্যক্তির এমন কোন পরামর্শ হয় না যাতে তিনি চতুর্থ না থাকেন এবং পাঁচ জনেরও হয় না, যাতে তিনি ষষ্ঠ না থাকেন তারা এতদপেক্ষা কম হোক বা বেশী হোক তারা যেখানেই থাকুক না কেন তিনি তাদের সাথে আছেন, তারা যা করে, তিনি কেয়ামতের দিন তা তাদেরকে জানিয়ে দিবেন। নিশ্চয় আল্লাহ সর্ববিষয়ে সম্যক জ্ঞাত।-
যারা মহান আল্লাহর জালিল নামের রঙ্গে রঙ্গিন তারা নিজ ইচ্ছাগুলোকে মহান আল্লাহর ইচ্ছা আর আদেশের সঙ্গে এক করে নেন মন ও প্রাণ দিয়ে। মহান আল্লাহর জালিল-এর রূপে তারা হন ভীত-বিহ্বল ও জামিল এর আলোয় বিমোহিত। আর মহান আল্লাহও এমন ব্যক্তিকে দেন সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্ব। ফলে সবাই তার মহত্ত্বের প্রতি হয় শ্রদ্ধাশীল ও বিনম্র এবং তার ক্ষমতার প্রতি হয় ভীত-চকিত।
একবার এক ব্যক্তি মহানবীর (সা) সামনে দোয়ার হাত উঠিয়ে বলছিলেন: ইয়া জালজালাল ওয়াল ইকরাম: হে জালাল ও দয়া বা অনুগ্রহের অধিকারী! -মহানবী (সা) বললেন, মহান আল্লাহকে যখন এই নামে ডেকেছ তোমার দোয়া আল্লাহ কবুল করেছেন, আল্লাহর কাছে যা ইচ্ছা তা চাও।#
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ১৬
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।