সূরা আহকাফ : আয়াত ১৯-২৩ (পর্ব-৫)
পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা আহকাফের ৫নং পর্ব নিয়ে আলোচনা। আরব উপত্যকায় আদ জাতির বসবাসের স্থান বালুকাময় মরুভূমি ছিল বলে এই জনপদকে আহকাফ বলা হতো। এই সূরার ২১ নম্বর আয়াতে ইনশাআল্লাহ আদ জাতির ঘটনা বর্ণনা করা হবে। আজ আমরা এই সূরার ১৯ থেকে ২৩ নম্বর পর্যন্ত আয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসির সম্পর্কে জানব। এই সূরার ১৯ নং আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
وَلِكُلٍّ دَرَجَاتٌ مِمَّا عَمِلُوا وَلِيُوَفِّيَهُمْ أَعْمَالَهُمْ وَهُمْ لَا يُظْلَمُونَ ﴿۱۹﴾
“আর তাদের প্রত্যেকের জন্য রয়েছে কর্ম অনুযায়ী মর্যাদা। আর তা এজন্য যে,আল্লাহ সকলের কর্মের পূর্ণ প্রতিফল দান করবেন এবং তাদের প্রতি অবিচার করা হবে না।”(৪৬:১৯)
গত আসরে মানুষকে দুই ভাগে বিভক্ত করার কথা বলা হয়েছিল। এর একদলে ছিল পিতামাতার সঙ্গে সদাচারণকারী সন্তান ও আল্লাহ তায়ালার প্রতি ঈমানদার ব্যক্তিবর্গ। আর অন্যদলে ছিল আল্লাহর অস্তিত্বে অস্বীকারকারী ও পিতামাতার প্রতি অবহেলাকারী সন্তান। এরপর আজকের এই আয়াতে বলা হচ্ছে, মহান আল্লাহ কিয়ামতের দিন প্রত্যেক দলকে তাদের আমল বা কর্ম অনুযায়ী পুরস্কার বা শাস্তি দেবেন। সেদিন যেকোনো কর্ম এবং তা করার নিয়তের ওপর ভিত্তি করে প্রত্যেক ব্যক্তির মর্যাদা আলাদা আলাদাভাবে নির্ধারিত হবে। আয়াতের পরের অংশে আল্লাহ তায়ালার ন্যায়পরায়ণতা বর্ণনা করে বলা হচ্ছে: প্রত্যেক ব্যক্তি তার কৃতকর্মের ফলাফল পরিপূর্ণভাবে পাবে এবং সেদিন কারো প্রতি বিন্দুমাত্র জুলুম বা অন্যায় করা হবে না।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- পৃথিবী ও আখিরাতে প্রত্যেক ব্যক্তির ভাগ্য তার নিজের কর্মের ওপর নির্ভরশীল। কিয়ামতের দিন যেকোনো কাজের উদ্দেশ্য সম্পর্কেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
২- কোনো কাজের প্রভাব সময়ের ব্যবধানে নির্মূল হয়ে যায় না; বরং এই প্রভাব মানুষের আমলনামায় লিপিবদ্ধ থাকে। কিয়ামতের দিন প্রতিটি আমলের প্রতিদান প্রদান করা হবে।
সূরা আহকাফের ২০ নং আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
وَيَوْمَ يُعْرَضُ الَّذِينَ كَفَرُوا عَلَى النَّارِ أَذْهَبْتُمْ طَيِّبَاتِكُمْ فِي حَيَاتِكُمُ الدُّنْيَا وَاسْتَمْتَعْتُمْ بِهَا فَالْيَوْمَ تُجْزَوْنَ عَذَابَ الْهُونِ بِمَا كُنْتُمْ تَسْتَكْبِرُونَ فِي الْأَرْضِ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَبِمَا كُنْتُمْ تَفْسُقُونَ ﴿۲۰﴾
“আর যেদিন কাফেরদের জাহান্নামের সামনে পেশ করা হবে [সেদিন তাদেরকে বলা হবে] তোমরা তোমাদের দুনিয়ার জীবনেই যাবতীয় সুখ-সম্ভার ভোগ করা শেষ করেছ সফলকাম হয়েছ [কিন্তু আজকের জন্য কোনো কিছু সঞ্চয় করোনি] সুতরাং তোমরা যমীনে অন্যায়ভাবে যে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করতে এবং ক্রমাগত যে নাফরমানী করে বেড়াতে তার কারণে আজ তোমাদেরকে দেয়া হবে অবমাননাকর শাস্তি।”(৪৬:২০)
পার্থিব জীবনে আল্লাহর দয়া ও রহমত সবার জন্য বরাদ্দ রয়েছে। এক্ষেত্রে মুমিন ও কাফিরের মধ্যে পার্থক্য করা হয়নি। আল্লাহ তায়ালা কাফির ও মুশরিকদেরকে পার্থিব জীবনের সহায় সম্পদ দিতে মোটেও কার্পণ্য করেননি। এই আয়াতে বলা হচ্ছে: কাফির ও গোনাহগার ব্যক্তিরা পার্থিব জীবনে আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামত ব্যবহার করে সব ধরনের ভোগবিলাস ও ইন্দ্রীয়পূজা করেছে। পৃথিবীতে তাদের না পাওয়ার কোনো বেদনা ছিল না। কিন্তু কিয়ামত হচ্ছে প্রতিদান দিবস। সেদিন আল্লাহর রহমতের ছায়াতলে শুধু বিশুদ্ধচিত্ত ঈমানদার ও সৎকর্মশীল মানুষই স্থান পাবে। পৃথিবীতে যারা খোদাদ্রোহী হয়েছে এবং দম্ভ, অহংকার ও গোয়ার্তুমির কারণে আল্লাহর অস্তিত্ব স্বীকার করেনি নিঃসন্দেহে কিয়ামতের দিন তাদের জন্য রয়েছে ভয়াবহ শাস্তি।
এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হচ্ছে:
১- পার্থিব জীবনের প্রাচুর্য ও সম্পদ ভোগ করার জন্য আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা বাধ্যতামূলক নয়। এখানে আল্লাহ তায়ালা মানুষসহ তাঁর সব সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় জীবিকার ব্যবস্থা করেছেন।
২- দম্ভ ও অহংকার মানুষকে সৎপথ থেকে বিচ্যুত করে বিভ্রান্তি ও খোদাদ্রোহিতার দিকে নিয়ে যায়।
৩- কিয়ামতের দিন অবমাননাকর শাস্তির মুখোমুখি হবে সেইসব জনগোষ্ঠী যারা পৃথিবীতে ঔদ্ধত্য ও আত্মাভিমান প্রদর্শন করেছে এবং ক্ষমতা, প্রভাব ও প্রতিপত্তির বড়াই করেছে।
সূরা আহকাফের ২১ থেকে ২৩ নং আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
وَاذْكُرْ أَخَا عَادٍ إِذْ أَنْذَرَ قَوْمَهُ بِالْأَحْقَافِ وَقَدْ خَلَتِ النُّذُرُ مِنْ بَيْنِ يَدَيْهِ وَمِنْ خَلْفِهِ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا اللَّهَ إِنِّي أَخَافُ عَلَيْكُمْ عَذَابَ يَوْمٍ عَظِيمٍ ﴿۲۱﴾ قَالُوا أَجِئْتَنَا لِتَأْفِكَنَا عَنْ آلِهَتِنَا فَأْتِنَا بِمَا تَعِدُنَا إِنْ كُنْتَ مِنَ الصَّادِقِينَ ﴿۲۲﴾ قَالَ إِنَّمَا الْعِلْمُ عِنْدَ اللَّهِ وَأُبَلِّغُكُمْ مَا أُرْسِلْتُ بِهِ وَلَكِنِّي أَرَاكُمْ قَوْمًا تَجْهَلُونَ ﴿۲۳﴾
“আর স্মরণ করুন, আদ সম্প্রদায়ের ভাই [হযরত হুদের] কথা, যখন সে আহকাফ অঞ্চলে বসবাসকারী স্বীয় সম্প্রদায়কে সতর্ক করেছিল; যার আগে এবং পরেও সতর্ককারীরা এসেছিলেন (এই বলে) যে,তোমরা আল্লাহ ছাড়া কারও ইবাদাত করো না। নিশ্চয় আমি তোমাদের জন্য ভয়ঙ্কর দিনের শাস্তির আশংকা করছি।”(৪৬:২১)
“তারা বলেছিল,তুমি কি আমাদেরকে আমাদের দেবতাগূলোর [পূজা] হতে নিবৃত্ত করতে এসেছ? তুমি সত্যবাদী হলে আমাদেরকে যার প্রতিশ্রুতি দিয়েছ,তা আনয়ন কর।”(৪৬:২২)
“হুদ বলল (আযাব কখন আসবে না আসবে) সে বিষয়ের জ্ঞান তো আল্লাহর নিকট আছে। আর আমাকে যা নিয়ে পাঠানো হয়েছে আমি শুধু সেগুলোই তোমাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছি। কিন্তু আমি দেখছি তোমরা এমন এক জাতি যারা মূর্খের আচরণ করছে।” (৪৬:২৩)
এই তিন আয়াতে আল্লাহর নবী হযরত হুদ (আ.) ও তাঁর জাতির ঘটনা উল্লেখ করে বলা হচ্ছে: আগে ও পরের অন্যান্য নবীর মতো হযরত হুদও তাঁর জাতিকে শিরক,মূর্তিপূজা এবং পাপকাজ করার ব্যাপারে সতর্ক করতেন। কিন্তু জাতির লোকজন তাদের অন্যায় অপকর্ম সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করা বা মূর্তিপূজা থেকে বিরত থাকার পরিবর্তে নবীকে বলত- তুমি কিয়ামতের যে আজাবের ভয় দেখাচ্ছো তা সত্যি হয়ে থাকলে এই দুনিয়াতেই তা দেখিয়ে দাও। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে পাপের শাস্তি একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই দিতে পারেন এবং দুনিয়া কিংবা আখেরাতে তা দেয়ার কোনো ক্ষমতা নবী-রাসূলগণের নেই। এ কারণে হযরত হুদ জবাবে বলেন, তোমরা যা চাও তার কোনো জ্ঞান আমার কাছে নেই। তা কেবলমাত্র আল্লাহর কাছে রয়েছে। আমি শুধুমাত্র আল্লাহর আদেশ তোমাদের কাছে পৌঁছে দিতে এবং তোমাদেরকে একত্ববাদ গ্রহণ করার দাওয়াত দিতে প্রেরিত হয়েছি। আমি যেমন দাওয়াত গ্রহণ করতে তোমাদেরকে বাধ্য করছি না তেমনি তোমাদেরকে শাস্তি দেয়ার ক্ষমতাও আমার নেই। আর তোমরা সত্য প্রত্যাখ্যানের জন্য যে আচরণ করছ তা মূর্খরা ছাড়া আর কেউ করে না।
এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- মুশরিক ও পাপাচারী জাতিগুলোর প্রতি নবী-রাসূলদের প্রথম দায়িত্ব ছিল তাদেরকে সতর্ক করা যাতে তারা শিরক ও পাপাচারের শাস্তি সম্পর্কে সাবধান হতে পারে।
২- সমস্ত নবী-রাসূল এক আল্লাহর ইবাদত করতে ও সব ধরনের শিরক ও কুফর থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।
৩- কেউ যদি পরকালে বিশ্বাস করে তবে পার্থিব জীবনে তার কর্মাবলী সংশোধন হয়ে যায়।
৪- নবী-রাসূলগণ এসেছিলেন মানুষকে একত্ববাদের দাওয়াত দিতে; কিন্তু মানুষকে বাধ্য করা তাদের দায়িত্ব ছিল না।
৫- পূর্বপুরুষদের অন্যায় আচরণ ও মিথ্যা উপাস্যদের প্রতি অন্ধবিশ্বাস ও গোঁড়ামি মানুষের মূর্খতার লক্ষণ। আর এ মূর্খতা মানুষকে সত্য থেকে দূরে সরিয়ে রাখে।#
পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ২৮
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।