ইমাম রেজা (আ.) অলৌকিক জ্ঞান ও কয়েকটি বিস্ময়কর ঘটনা
https://parstoday.ir/bn/radio/uncategorised-i17188-ইমাম_রেজা_(আ.)_অলৌকিক_জ্ঞান_ও_কয়েকটি_বিস্ময়কর_ঘটনা
১১ ই জিলকাদ ইসলামের ইতিহাসের এক মহা-খুশির দিন। কারণ, আজ হতে ১২৮৯ চন্দ্রবছর আগে ১৪৮ হিজরির এই দিনে মদিনায় ইমাম মুসা ইবনে জাফর সাদিক (আ.)'র ঘরে জন্ম নিয়েছিলেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)'র পবিত্র আহলে বাইতের অন্যতম সদস্য হযরত ইমাম রেজা (আ.)।
(last modified 2025-10-12T12:48:31+00:00 )
আগস্ট ১৪, ২০১৬ ১৩:০৯ Asia/Dhaka
  • ইমাম রেজা (আ.) অলৌকিক জ্ঞান ও কয়েকটি বিস্ময়কর ঘটনা

১১ ই জিলকাদ ইসলামের ইতিহাসের এক মহা-খুশির দিন। কারণ, আজ হতে ১২৮৯ চন্দ্রবছর আগে ১৪৮ হিজরির এই দিনে মদিনায় ইমাম মুসা ইবনে জাফর সাদিক (আ.)'র ঘরে জন্ম নিয়েছিলেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)'র পবিত্র আহলে বাইতের অন্যতম সদস্য হযরত ইমাম রেজা (আ.)।

তাঁর পবিত্র ও কল্যাণময়ী মায়ের নাম ছিল উম্মুল বানিন নাজমা। ১৮৩ হিজরিতে খলিফা হারুনের কারাগারে পিতা ইমাম কাজিম (আ.)'র শাহাদতের পর পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে মুসলিম উম্মাহর ইমামতের ঐশী দায়িত্ব গ্রহণ করেন ইমাম রেজা (আ.)। প্রায় ১৯/২০ বছর ধরে ইমামতের মহান দায়িত্ব পালনের পর তিনি শাহাদত বরণ করেন।

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)'র পবিত্র আহলে বাইত তথা মাসুম বংশধররা ছিলেন খোদায়ী নানা গুণ ও সৌন্দর্যের প্রকাশ। তাঁরা ছিলেন মানব জাতির জন্য পূর্ণাঙ্গ বা পরিপূর্ণ আদর্শ। তাঁদের মহত গুণ ও যোগ্যতাগুলো সত্য-সন্ধানী এবং খোদা-প্রেমিকদের জন্য অফুরন্ত শিক্ষা ও প্রেরণার উতস হয়ে আছে।

শেখ সাদুক (র) হযরত ইমাম রেজা (আ.) সম্পর্কে এক বইয়ে লিখেছেন, অসাধারণ নানা গুণ ও যোগ্যতার জন্য আলী ইবনে মুসা রেজা (আ.) রেজা বা সন্তুষ্ট, সাদিক বা সত্যবাদী, ফাজেল বা গুণধর, মু'মিনদের চোখের প্রশান্তি বা আলো ও কাফির বা অবিশ্বাসীদের ক্ষোভের উতস প্রভৃতি উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন।

তবে আলী ইবনে মুসা রেজা (আ.)'র একটি বড় উপাধি হল 'আলেমে আ'লে মুহাম্মাদ' বা মুহাম্মাদ (সা.)'র আহলে বাইতের আলেম।

ইমাম রেজা (আ.)'র পিতা ইমাম মুসা কাজিম (আ.) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেছেন, আমার বাবা ইমাম জাফর সাদিক (আ.) আমাকে বার বার বলতেন যে, আলে মুহাম্মাদের আলেম বা জ্ঞানী হবে তোমার বংশধর। আহা! আমি যদি তাঁকে দেখতে পেতাম! তাঁর নামও হবে আমিরুল মু'মিনিন (আ.)'র নাম তথা আলী।

রেজা (আ.)'র মাজার জিয়ারতকারীরা বেহেশতবাসী হবেন

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) ইরানের খোরাসানে তাঁর শরীরের একটি অংশকে তথা তাঁর পবিত্র বংশধারার বা আহলে বাইতের একজন সদস্যকে দাফন করা হবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন।

বলা হয়, যারা এই মহান ইমামের উচ্চ সম্মান সম্পর্কে পরিচিতি বা সমীহ নিয়ে তাঁর পবিত্র মাজার জিয়ারত করবেন তারা বেহেশতের অধিকারী হবেন।

প্রায় হাজার বছর আগে লিখিত 'শাওয়াহেদুন্নবুওয়াত' নামক বইয়ে বর্ণিত একটি হাদিসে এসেছে, যারা ইরানের খোরাসানে অবস্থিত (যার বর্তমান নাম মাশহাদ) ইমাম রেজা (আ.)'র মাজার জিয়ারত করবে তারা বেহেশতবাসী হবে। বিশিষ্ট কবি ও আধ্যাত্মিক সাধক মাওলানা আবদুর রহমান জামির লিখিত এই বইটি বহু বছর আগে বাংলা ভাষায়ও অনূদিত হয়েছে (মাওলানা মহিউদ্দিনের মাধ্যমে) (পৃ.১৪৩-১৪৪)। [এ বইয়ের ২৭২ পৃষ্ঠায় ইরানের পবিত্র কোম শহরে অবস্থিত হযরত ফাতিমা মাসুমা (সা.)’র পবিত্র মাজার জিয়ারত সম্পর্কেও একই কথা বলা হয়েছে। এই ফাতিমা মাসুমা ছিলেন ইমাম রেজা-আ.’র ছোট বোন।  মাসুমা বা নিষ্পাপ ছিল তাঁর উপাধি।] 

ধূর্ত মামুনের কূটচাল ব্যর্থ করা

ইমাম রেজা (আ)'র সমসাময়িক যুগে জনগণের কাছে বিশ্বনবীর (সা) পবিত্র বংশধারায় জন্ম-নেয়া মহান ইমামগণের বার্তা পৌঁছে যাবার ফলে জনগণের অনেকেই ইসলামের প্রকৃত রূপ ও সত্য বুঝতে থাকে এবং তারা নবীবংশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে থাকে। বিশেষ করে বাদশাহ মামুনের অপততপরতার বিরুদ্ধে ইমাম রেজা (আ.) যখন দাঁড়িয়ে গেলেন, তখন ইরাকের অধিকাংশ জনগণ মামুনের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল। হযরত আলী(আ.)’র  পবিত্র খান্দানের কেউ বাদশাহর বিরুদ্ধে গেলে বাদশাহি যে হারাতে হবে-এই আশঙ্কা মামুনের মধ্যে ছিল। যার ফলে মামুন একটা আপোষ-নীতির কৌশল গ্রহণ করে। বাদশাহ মামুন ইমামকে খোরাসানে আসার আমন্ত্রণ জানায়। ইমাম প্রথমত রাজি হন নি, কিন্তু পরবর্তীকালে তাঁকে আমন্ত্রণ গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়। বাধ্য হয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি বসরা অভিমুখে যাত্রা করেন। কিন্তু পথিমধ্যে তিনি তাঁর গতিপথ পরিবর্তন করে ইরানের দিকে পাড়ি দেন। উল্লেখ্য যে, নবীবংশের মধ্যে ইমাম রেজা(আ.)ই প্রথম ইরান সফর করেন। যাই হোক, যাত্রাপথে তিনি যেখানেই গেছেন জনগণ তাঁকে সাদরে ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করে। ইমামও নবী করিম (সা.), তাঁর আহলে বাইত ও নিষ্পাপ ইমামদের চরিত্র-বৈশিষ্ট্য এবং ইসলামের সঠিক বিধি-বিধান সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করেন। সেইসাথে তাঁর সফরের উদ্দেশ্য অর্থাৎ বাদশাহর আমন্ত্রণের কথাও তাদেরকে জানান। চতুর বাদশাহ মামুন ইমামের আগমনে তার সকল সভাসদ এবং অন্যান্য লোকজনকে সমবেত করে বলে, হে লোকেরা ! আমি আব্বাস এবং আলীর বংশধরদের মধ্যে অনুসন্ধান করে দেখেছি , আলী বিন মূসা বিন রেজার মতো উত্তম লোক দ্বিতীয় কেউ নেই। তাই আমি চাচ্ছি যে , খেলাফতের দায়িত্ব থেকে ইস্তফা দেব এবং এই দায়িত্ব তাঁর ওপর ন্যস্ত করবো। ইমাম, মামুনের রাজনৈতিক এই দুরভিসন্ধি সম্পর্কে জানতেন। তাই তিনি জবাবে বললেন, মহান আল্লাহ যদি খিলাফত তোমার জন্যে নির্ধারিত করে থাকেন, তাহলে তা অন্যকে দান করা উচিত হবে না। আর যদি তুমি আল্লাহর পক্ষ থেকে খেলাফতের অধিকারী না হয়ে থাক, তাহলে আল্লাহর খেলাফতের দায়িত্ব কারো উপর ন্যস্ত করার কোনো অধিকার তোমার নেই। ইমাম শেষ পর্যন্ত মামুনের কথায় খেলাফতের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করায় মামুন ইমামকে তার ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী হতে বাধ্য করেন। ইমাম রেজা (আ.) শেষ পর্যন্ত নিরুপায় হয়ে কিছু শর্তসাপেক্ষে তা গ্রহণ করেন। শর্তগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ দুটি ছিল এরকম-এক, তিনি প্রশাসনিক কোনো দায়িত্ব পালন করবেন না। দূরে থেকে তিনি খেলাফতের সম্পর্ক রক্ষা করবেন। তিনি কেন এ ধরনের শর্তারোপ করেছিলেন , তার কারণ দায়িত্ব গ্রহণকালে প্রদত্ত তাঁর মোনাজাত থেকেই সুস্পষ্ট হয়ে যায়। তিনি মুনাজাতে বলেছিলেন - হে খোদা ! তুমি ভালো করেই জানো , আমি বাধ্য হয়ে এই দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। সুতরাং আমাকে এজন্যে পাকড়াও করো না। যেমনিভাবে তুমি ইউসূফ ও দানিয়েল ( আ ) কে পাকড়াও করো নি। হে আল্লাহ ! তোমার পক্ষ থেকে কোনো দায়িত্ব ও কর্তব্য ছাড়া আর কোনো কর্তৃত্ব হতে পারে না। আমি যেন তোমার দ্বীনকে সমুন্নত রাখতে পারি, তোমার নবীর সুন্নতকে যথার্থভাবে বাস্তবায়ন করতে পারি।

ইমাম রেজার (আ) এই দায়িত্ব গ্রহণের খবর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লে আব্বাসীয়রা ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। তারা ভেবেছিল, খেলাফত বুঝি চিরদিনের জন্যে আব্বাসীয়দের হাত থেকে আলীর (আ) বংশধরদের হাতে চলে গেল। তাদের দুশ্চিন্তার জবাবে বাদশা মামুন তার আসল উদ্দেশ্যের কথা তাদেরকে খুলে বলে। তা থেকেই বোঝা যায়, যেমনটি আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেছেন, ইমামকে খোরাসানে আমন্ত্রণ জানানো এবং তাঁর পরবর্তী বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের পেছনে মামুনের মূল উদ্দেশ্য ছিল, বিশ্বনবীর (আ) আহলেবাইতপন্থী মুসলমানদের বৈপ্লবিক সংগ্রামকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করা। যাতে তাদের উত্তাল রাজনীতিতে ভাটা পড়ে যায়। দ্বিতীয় উদ্দেশ্যটি ছিল আব্বাসীয় খেলাফতকে বৈধ বলে প্রমাণ করা। তৃতীয়ত, ইমামকে উত্তরাধিকার বানানোর মাধ্যমে নিজেকে একজন আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব ও মহান উদার হিসেবে প্রমাণ করা।

 মামুনের এই অশুভ উদ্দেশ্যের কথা জানার পর আব্বাসীয়রা ইমামকে বিভিন্নভাবে হেয় ও মর্যাদাহীন করে তোলার চেষ্টা চালায়। কিন্তু জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় সমৃদ্ধ ইমামকে তারা কিছুতেই হেয় করতে পারে নি। যেমন, বিভিন্ন ধর্মের জ্ঞানী ও পণ্ডিতদের মাধ্যমে জটিল প্রশ্নের অবতারণা করে ইমাম রেজা (আ.)-কে জব্দ করার চেষ্টা, কিংবা ক্ষরা-পীড়িত অঞ্চলে বৃষ্টি বর্ষণের জন্য ইমামকে দিয়ে এই আশায় দোয়া করানো যে দোয়া কবুল না হলে ইমামের মর্যাদা ধূলিসাৎ হবে। কিন্তু ইমাম প্রতিটি জ্ঞানগত বিতর্কে বিজয়ী হতেন এবং বৃষ্টির জন্য করা তাঁর দোয়াও কবুল হয়েছিল।

বাদশাহ মামুন একবার তার সাপ্তাহিক প্রশ্নোত্তরের আসরে ইমামকে আমন্ত্রণ জানায়। সেখানে ইমাম কোনো এক প্রেক্ষাপটে মামুনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অভিমত দেন। এতে বাদশা ভীষণ ক্ষেপে যায় এবং ইমামের বিরুদ্ধে অন্তরে ভীষণ বিদ্বেষ পোষণ করতে থাকে। এইভাবে   ইমামত, জনপ্রিয়তা, খেলাফত, আলীর বংশধর প্রভৃতি বিচিত্র কারণে বাদশাহ ইমামের বিরুদ্ধে শত্রুতা করতে থাকে। অন্যদিকে জনগণ বুঝতে পারে যে, খেলাফতের জন্যে মামুনের চেয়ে ইমামই বেশি উপযুক্ত। ফলে ইমামের বিরুদ্ধে মামুনের ক্রোধ এবং হিংসা বাড়তেই থাকে। আর ইমামও মামুনের বিরুদ্ধে অকপট সত্য বলার ক্ষেত্রে নির্ভীক ছিলেন। কোনোভাবেই যখন ইমামকে পরাস্ত করা গেল না, তখন মার্ভ থেকে বাগদাদে ফেরার পথে ইরানের বর্তমান মাশহাদ প্রদেশের তূস নামক অঞ্চলে মামুন ইমামকে ডালিমের রস বা আঙ্গুরের সাথে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করে হৃদয়-জ্বালা মেটাবার উদ্যোগ নেয়। ২০৩ হিজরির ১৭ই সফরে এই হৃদয়বিদারক ঘটনাটি ঘটে। তখন ইমামের বয়স ছিল পঞ্চান্ন বছর।

আসলে বিষ প্রয়োগে ইমামের সাময়িক মৃত্যু ঘটলেও আসল মৃত্যু ঘটেছিল মামুনেরই। পক্ষান্তরে ইমাম শাহাদাতের পেয়ালা পান করে যেন অমর হয়ে গেলেন চিরকালের জন্যে। তার প্রমাণ মেলে মাশহাদে তাঁর পবিত্র সমাধিস্থলে গেলে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ইমামের জন্মদিনে কাতারে কাতারে মানুষ আসে তাঁর প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা নিবেদন করতে। সোনালি রঙ্গের সমাধি-ভবনের চারপাশ জাঁকজমক আর অপূর্ব ঐশ্বর্যে কোলাহল-মুখর হয়ে ওঠে নিমেষেই। যুগ যুগ ধরে মানুষের নেক-বাসনা পূরণের উসিলা হিসেবে কিংবদন্তীতুল্য খ্যাতি রয়েছে নবীবংশে জন্ম-নেয়া ইমামগণের। ইমাম রেজা (আ.) ও তাঁর পবিত্র মাজারও এর ব্যতিক্রম নয়।

জ্ঞানগত বিতর্কের আসরগুলোতে ইমামের বিজয় 

 আমরা আগেই বলেছি মামুন ইমাম রেজা (আ.)-কে ইরানের মার্ভ অঞ্চলে নিয়ে এসেছিল। মার্ভ শহর ছিল মামুনের রাজধানী। সে এই মহান ইমামের উপস্থিতিতে বিভিন্ন অঞ্চলের জ্ঞানী-গুণীদের নিয়ে জ্ঞানের নানা বিষয়ে অনেক বৈঠক করত। বিশেষজ্ঞ বা পণ্ডিতদের দিয়ে ইমাম রেজা (আ.)-কে জব্দ করাই ছিল এইসব বৈঠকের আসল উদ্দেশ্য। কিন্তু ইমাম রেজা (আ.) নানা ধরনের কঠিন প্রশ্ন ও জটিল বিতর্কের এইসব আসরে বিজয়ী হতেন এবং বিতর্ক শেষে ওইসব পণ্ডিত ও জ্ঞানীরা ইমামের শ্রেষ্ঠত্বও অকাট্য যুক্তির কথা স্বীকার করে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতেন। বলা হয় বিতর্কগুলো চলতো দীর্ঘ সময় ধরে। মামুনের প্ররোচনায় নানা অঞ্চলের নানা ধর্মের পণ্ডিতরা একবার এক দীর্ঘ বিতর্কের জলসায় ইমাম রেজা (আ)-কে ত্রিশ হাজার প্রশ্ন করেছিলেন। ইমাম তাদের সব প্রশ্নের সদুত্তর দিয়েছিলেন ওই পণ্ডিতদের নিজ নিজ ভাষায়। ফলে ব্যর্থ হয়েছিল ইমামকে জব্দ ও হেয় করার বাদশাহি চক্রান্ত।

খলিফা মামুন হযরত ইয়াহিয়া (আ.)'র অনুসারী হওয়ার দাবিদার তথা সাবেয়ি ধর্মের এক  বিখ্যাত পণ্ডিতকে একবার নিয়ে আসে এ ধরনের এক বিতর্কের আসরে। সেখানে ইহুদি, খ্রিস্টান ও অগ্নি-উপাসকদের পণ্ডিতরাও উপস্থিতি ছিল। এই আসরে ইমাম রেজা (আ.) ইসলামের বিরোধিতা সম্পর্কে কারো কোনো বক্তব্য, যুক্তি বা প্রশ্ন থাকলে তা তুলে ধরার আহ্বান জানান এবং তিনি এর জবাব দেবেন বলে ঘোষণা করেন। ইমরান নামের ওই সাবেয়ি পণ্ডিত অবজ্ঞাভরে বলল: "তুমি যদি না চাইতে তবে তোমার কাছে আমি প্রশ্ন করতাম না। আমি কুফা, বসরা, সিরিয়া ও আরব দেশে গিয়েছি এবং তাদের সব দার্শনিক বা যুক্তিবাদীদের সঙ্গে বিতর্ক করেছি। কিন্তু তাদের কেউই প্রমাণ করতে পারেনি যে আল্লাহ এক ও তিনি ছাড়া অন্য কোনো খোদা নেই এবং তিনি এই একত্বের মধ্যে বহাল রয়েছেন। এ অবস্থায় আমি কি তোমার কাছে প্রশ্ন করতে পারি? ইমাম রেজা (আ.) বললেন, যত খুশি প্রশ্ন করতে পার। ফলে সে ইমামকে বিভিন্ন ধরনের বেশ কিছু প্রশ্ন করে। ইমাম রেজা (আ.)ও বহু সংখ্যক পণ্ডিত ও বিপুল দর্শকদের উপস্থিতিতে একে-একে ইমরানের সব প্রশ্নের এত সুন্দর জবাব দিলেন যে ওই সাবেয়ি পণ্ডিত সেখানেই মুসলমান হয়ে যান।

ইমাম রেজা (আ.) বিতর্কে অংশগ্রহণকারী পণ্ডিতদের ধর্ম-বিশ্বাস ও মতবাদে উল্লেখিত দলিল-প্রমাণের আলোকেই তাদের প্রশ্নের জবাব দিতেন। একবার বাহশাহ মামুন বিখ্যাত খ্রিস্টান পণ্ডিত জাসলিককে বলে ইমাম রেজা (আ.)’র সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হতে। জাসলিক বললেন, আমি কিভাবে তাঁর সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হব যখন তাঁর ধর্মগ্রন্থ তথা কুরআন ও এর দলিল-প্রমাণের প্রতি আমার বিশ্বাস নেই এবং তিনি যেই নবীর বক্তব্যকে দলিল-প্রমাণ হিসেবে পেশ করবেন তাঁর প্রতিও আমার ঈমান নেই। ইমাম রেজা (আ.) বললেন, যদি ইঞ্জিল তথা বাইবেল থেকে দলিল-প্রমাণ তুলে ধরি তাহলে কি আপনি তা গ্রহণ করবেন? জাসলিক বললেন, হ্যাঁ। আসলে ইমাম উভয়-পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য দলিল-প্রমাণের ভিত্তিতে জাসলিকের সঙ্গে বিতর্ক করলেন। বিতর্কে জাসলিক এতটা প্রভাবিত হলেন যে তিনি বললেন: খ্রিস্ট বা ঈসার কসম, আমি কখনও ভাবিনি যে মুসলমানদের মধ্যে আপনার মত কেউ থাকতে পারেন।

ইমাম রেজা (আ.) ইহুদি সর্দার ও পণ্ডিত রাস উল জালুত-এর কাছে জানতে চেয়েছিলেন যে, মুসা (আ.)’র নবী হওয়ার দলিল বা প্রমাণ কী? রাস উল জালুত বললেন, তিনি এমন মু’জিজা বা অলৌকিক নিদর্শন এনেছেন যে তাঁর আগে আর কেউই তেমনটি আনতে পারেনি। ইমাম প্রশ্ন করলেন: কেমন সেই মো’জেজা? জালুত বললেন: যেমন, সাগরকে দুই ভাগ করে মাঝখানে পথ সৃষ্টি করা, হাতের লাঠিকে সাপে পরিণত করা, পাথরে ওই লাঠি দিয়ে আঘাত করে কয়েকটি ঝর্ণা বইয়ে দেয়া, হাত সাদা করা এবং এ রকম আরো অনেক মু’জিজা বা অলৌকিক নিদর্শন; আর অন্যরা এর মোকাবেলায় কিছু করতে পারত না ও এখনও তার চেয়ে বেশি ক্ষমতা কারো নেই। জবাবে ইমাম রেজা (আ.) বললেন,  এটা ঠিকই বলেছেন যে, হযরত মুসা (আ.)’র আহ্বানের সত্যতার প্রমাণ হল, তিনি এমন কিছু কাজ করেছেন যা অন্যরা করতে পারেনি; তাই কেউ যদি নবুওতের দাবিদার হন ও এমন কিছু কাজ করেন যা অন্যরা করতে পারেন না, এ অবস্থায় তাঁর দাবিকে মেনে নেয়া কি আপনার জন্য ওয়াজিব বা অপরিহার্য নয়? ইহুদি আলেম বললেন: না, কারণ আল্লাহর কাছে উচ্চ অবস্থান ও নৈকট্যের দিক থেকে কেউই মুসা নবীর সমকক্ষ নয়। তাই কেউ যদি মুসা নবীর মত মু’জিজা বা অলৌকিক নিদর্শন দেখাতে না পারেন তাহলে তাকে নবী হিসেবে মেনে নেয়া আমাদের তথা ইহুদিদের জন্য ওয়াজিব নয়। ইমাম রেজা (আ.) বললেন,  তাহলে মুসা নবী (আ.)’র আগে যে নবী-রাসূলবৃন্দ এসেছেন তাঁদের প্রতি কিভাবে ঈমান রাখছেন? তাঁরা তো মুসা (আ.)’র অনুরূপ মু’জিজা আনেননি। রাস উল জালুত এবার বললেন, ওই নবী-রাসূলবৃন্দ যদি তাঁদের নবুওতের সপক্ষে মুসা নবীর মু’জেজার চেয়ে ভিন্ন ধরনের মু’জিজা দেখাতে পারেন তাহলে তাদের নবুওতকে স্বীকৃতি দেয়ায়ও ওয়াজিব বা জরুরি। ইমাম রেজা (আ.) বললেন,  তাহলে ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ.)’র প্রতি কেন ঈমান আনছেন না? অথচ তিনি তো মৃতকে জীবিত করতে পারতেন, অন্ধকে দৃষ্টি দান করতেন, চর্ম রোগ সারিয়ে দিতেন, কাদা দিয়ে পাখি বানিয়ে তাতে ফু দিয়ে জীবন্ত পাখিতে পরিণত করতেন। রাস উল জালুত এবার বললেন, তিনি এইসব কাজ করতেন বলে বলা হয়ে থাকে, তবে আমরা তো দেখিনি। ইমাম রেজা (আ.) বললেন, আপনারা কি মুসা নবী (আ.)’র মু’জিজা দেখেছেন? এইসব মু’জিজার খবর কি আপনাদের কাছে নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিদের মাধ্যমে পৌঁছেনি?-   জি হ্যাঁ, ঠিক তাই। বললেন রাস উল জালুত-ইমাম রেজা (আ.) বললেন, "ভালো কথা, তাহলে ঈসা (আ.)’র মু’জিজাগুলোর  নির্ভরযোগ্য খবরও তো আপনাদের কাছে বলা হয়েছে। কিন্তু এ অবস্থায় আপনারা মুসা নবী (আ.)-কে নবী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তাঁর প্রতি ঈমান আনলেও  ঈসা (আ.)’র প্রতি ঈমান আনছেন না। "তিনি আরো বললেন, "বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)’র নবুওতসহ অন্যান্য নবী-রাসূলদের ব্যাপারেও একই কথা প্রযোজ্য। আমাদের নবী (সা.)র অন্যতম মু’জিজা হল এটা যে তিনি ছিলেন একজন দরিদ্র ইয়াতিম ও রাখালের কাজ করে পারিশ্রমিক নিতেন। তিনি কোনো পড়াশুনা করেননি এবং কোনো শিক্ষকের কাছেও আসা-যাওয়া করেননি। কিন্তু তারপরও তিনি এমন এক বই এনেছেন যাতে রয়েছে অতীতের নবী-রাসূলদের কাহিনী ও ঘটনাগুলোর হুবহু বিবরণ। এতে রয়েছে অতীতের লোকদের খবর এবং কিয়ামত পর্যন্ত সুদূর ভবিষ্যতের খবর। এ বই  অনেক নিদর্শন ও  অলৌকিক ঘটনা তুলে ধরেছে।"

এভাবে রাস উল জালুতের সঙ্গে ইমাম রেজা (আ.)’র আলোচনা চলতে থাকে। সংলাপ এমন পর্যায়ে উপনীত হয় যে ইহুদি সর্দার ও পণ্ডিত রাস উল জালুত ইমাম রেজা (আ.)-কে বললেন: "আল্লাহর কসম! হে মুহাম্মদের সন্তান (বংশধর)!আমি আপনার নির্দেশই মান্য করতাম যদি না তা ইহুদি জাতির ওপর আমার নেতৃত্বের পথে যদি বাধা হয়ে না দাঁড়াত। সেই খোদার কসম দিয়ে বলছি, যে খোদা মুসার ওপর নাজেল করেছেন তাওরাত ও দাউদের ওপর নাজেল করেছি যাবুর। এমন কাউকে দেখিনি যিনি তাওরাত ও ইঞ্জিল আপনার চেয়ে ভালো তিলাওয়াত করেন এবং আপনার চেয়ে ভালোভাবে ও মধুরভাবে এইসব ধর্মগ্রন্থের তাফসির করেন।"

এভাবে ইমাম রেজা (আ.) তাঁর অকাট্য যুক্তির মাধ্যমে সবার জন্য সর্বোত্তম ও বোধগম্যভাবে ইসলামের বিশ্বাসগুলো তুলে ধরেছিলেন। আর তিনি এত গভীর ও ব্যাপক জ্ঞানের অধিকারী এবং সেসবের প্রচারক ও বিকাশক  ছিলেন বলেই  তাঁকে ‘আলেমে আলে মুহাম্মাদ’ বা বিশ্বনবী (সা.)’র আহলে বাইতের আলেম শীর্ষক উপাধি দেয়া হয়েছিল।

এবারে আমরা বিশ্বনবী (সা.)’র পবিত্র আহলে বাইতের এই সদস্যের কয়েকটি মো’জেজা বা অলৌকিক ক্ষমতার ঘটনা তুলে ধরছি:  

“ইমাম রেজা (আ.)’র বিশিষ্ট সঙ্গী আবা সালাত হারুবি বলেছেন: আমি হযরত রেজা (আ.)’র কাছে ছিলাম (তাঁর শাহাদতের কিছুকাল আগে)। তিনি আমাকে বললেন: হে আবা সালাত! এই স্থানে (খলিফা) হারুনের যে কবর দেখছ, তার চারদিক থেকে কিছু মাটি তুলে আন। আমি তা করলাম। ইমাম সেই মাটিগুলো শুঁকলেন ও বললেন: ওরা আমাকে (আব্বাসীয় শাসক) হারুনের পাশে কবর দিতে চাইবে, কিন্তু এখানে একটি পাথর জেগে উঠবে; খোরাসানের পাথর ভাঙ্গার সবগুলো যন্ত্র এনেও তা তুলতে পারবে না তারা। হারুনের কবরের মাথার ওপরের দিকে ও পায়ে নিচের দিকে ইমাম এইসব কথা বলেন। এরপর তিনি হারুনের কবরের অন্য দিকের মাটির ঘ্রাণ নিলেন এবং বললেন: এই স্থানের মাটিই হবে আমার কবরের স্থান। হে আবা সালাত! আমার কবর যখন দেখা যাবে তখন সিক্ততা দেখা দেবে। আমি তোমাকে একটি দোয়া শিখিয়ে দিচ্ছি তা পড়বে। ওই দোয়া পড়ার পর আমার কবর পানিতে ভরে যাবে। সেই পানিতে ছোট ছোট মাছ দেখা যাবে। এই রুটি তোমাকে দিচ্ছি তা ওদের জন্য গুড়ো কর। ওই রুটির গুড়ো ওরা খাবে। এরপর একটি বড় মাছ দেখা যাবে। সে ছোট ছোট সব মাছ খেয়ে ফেলবে এবং এরপর অদৃশ্য হয়ে যাবে। এরপর তুমি পানিতে হাতে রেখে এই দোয়াটি যা আমি তোমাকে শিখিয়ে দেব তা পড়বে। সব পানি নেমে যাবে। আর এই সবই করবে (ইমামের ঘাতক) মামুনের উপস্থিতিতে। এরপর ইমাম বললেন, ‘হে আবা সালাত! আমি আগামীকাল এই অসত ও অপরাধী লোকটার (বাদশাহ মামুন) কাছে যাব। যখন ওর কাছ থেকে ফিরে আসব তখন দেখবে যে আমার মাথা যদি ‘আবা’ দিয়ে (এক ধরনের পাতলা পোশাক যা মূল মোটা পোশাকের ওপর পরা হয়) ঢাকা থাকে তাহলে আমার সঙ্গে আর কথা বলবে না ও বুঝে নিও যে আমাকে বিষ খাওয়ানো হয়েছে।’ 

আঙ্গুরের মাধ্যমে ইমামকে বিষ-প্রয়োগ

পরের দিন সকালে ইমাম নিজের মেহরাবে অপেক্ষা করছিলেন। কিছু সময় পর বাদশাহ মামুন তার এক ভৃত্যকে পাঠায় ইমামকে সঙ্গে নিয়ে আসার জন্য। ইমাম মামুনের মজলিসে গেলেন। আমিও (আবা সালাত) পিছে পিছে গেলাম। তার সামনে একটি পাত্রে খুরমাসহ নানা ধরনের ফল ছিল। মামুনের হাতে ছিল এক থোকা আঙ্গুর। ওই থোকা থেকে সে নিজেও কয়েকটি আঙ্গুর খেয়েছিল। মামুন ইমামকে দেখে উঠে দাঁড়ায় এবং তাঁকে আলিঙ্গন করে ও  তাঁর কপালে চুমো খায়। সে ইমামকে নিজের পাশে বসায়। এরপর সে ওই আঙ্গুরের থোকাটি খেতে ইমামকে অনুরোধ করে বলে: আমি এরচেয়ে ভালো আঙ্গুর আর দেখিনি। ইমাম বললেন, বেহেশতের আঙ্গুর তো এর চেয়ে অনেক ভালো। মামুন বলল: এই আঙ্গুর খান। ইমাম বললেন, আমার ওজর গ্রহণ কর। (অর্থাত আমি তা খেতে চাচ্ছি না) মামুন বলল: অন্য কোনো উপায় নেই; আপনি কি আমাকে অভিযুক্ত করতে চান? অবশ্যই খেতে হবে। এরপর সে আঙ্গুরের থোকাটি তুলে ধরে তা থেকে নিজে কয়েকটি আঙ্গুর খেলো ও থোকাটি ইমামের হাতে দিল। ইমাম সেই আঙ্গুর থেকে তিনটি আঙ্গুর খেয়ে আঙ্গুরের থোকাটি মাটিতে ফেলে দেন এবং সেখান থেকে উঠে আসেন।মামুন বলল: কোথায় যাচ্ছেন? ইমাম বললেন: সেখানেই যাচ্ছি যেখানে তুমি আমাকে পাঠিয়েছ। এরপর তিনি তার ‘আবা’ দিয়ে মাথা ঢাকেন এবং নিজ ঘরে ফিরে আসেন। তিনি আমাকে বললেন: ‘দরজাটা বন্ধ কর’। আর এটা বলেই বিছানায় পড়ে গেলেন।

বাবার শাহাদতের সময় ছেলে (নতুন ইমাম) ইমাম জাওয়াদ (আ.) কাছে এলেন

আবা সালাত বলেন, ‘আমি ঘরের মাঝখানে দুঃখ-ভারাক্রান্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। এমন সময় দেখলাম যে এক অপরূপ সুন্দর যুবক আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর চেহারা ইমাম রেজার চেহারার সবচেয়ে কাছাকাছি বা অনুরূপ মনে হল।  আমি তাঁর সামনে গিয়ে বললাম: কিভাবে এখানে এলেন? সব দরজা তো বন্ধ ছিল।

ইমাম জাওয়াদ (আ.) বললেন: যিনি আমাকে মদীনা থেকে এখানে এনেছেন তিনি বন্ধ দরজা দিয়েও আমাকে প্রবেশ করিয়েছেন। প্রশ্ন করলাম: আপনি কে? আমি তোমার ওপর আল্লাহর দলিল বা প্রমাণ (ইমাম) হে আবা সালাত! আমি মুহাম্মাদ বিন আলী আল জাওয়াদ। এরপর তিনি বাবার দিকে গেলেন এবং বললেন: আপনিও প্রবেশ করুন।

ইমাম রেজা (আ.)’র দৃষ্টি পুত্রের ওপর পড়া মাত্রই তিনি তাঁকে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলেন ও তাঁর কপালে চুমু খেলেন।  ইমাম জাওয়াদ (আ.) নিজেকে বাবার শরীরের সঙ্গে যুক্ত করলেন ও তাঁকে চুমো খেলেন। এরপর তাঁরা মৃদু আওয়াজে পরস্পর কথা বললেন যা আমি শুনিনি। পিতা ও পুত্রের মধ্যে রহস্যময় কিছু কথা বিনিময় হল যতক্ষণ না ইমাম রেজা (আ.)’র বেহেশতী আত্মা তাঁর দেহ ত্যাগ করল।‘  

ইমাম জাওয়াদ (আ.)  পিতা ইমাম রেজা (আ.)’র গোসল, দাফন ও জানাজা সম্পন্ন করেন

উল্লেখ্য, কোনো ঐশী নেতা বা ইমামের জানাজা বা দাফন পরবর্তী ঐশী নেতা বা ইমাম ছাড়া সম্পন্ন করার অধিকার রাখেন না। তাই দেখা যায় বিশ্বনবী (সা.)-কে  গোসল করিয়েছেন ও তাঁর দাফন করেছেন ইমাম আলী(আ.), ইমাম আলী(আ.)’র জানাজা ও দাফন করেছেন ইমাম হাসান (আ.), তাঁর দাফন করেছেন ইমাম হুসাইন (আ.), ইমাম হুসাইন(আ.)’র দাফন সম্পন্ন হয়েছে ইমাম জয়নুল আবেদিন (আ.)’র মাধ্যমে,  ...... অনুরূপভাবে ইমাম জাওয়াদ(আ.)ই পিতার গোসল, দাফন ও জানাজা সম্পন্ন করেন।  

ইমাম জাওয়াদ (আ.) বললেন: হে আবা সালাত! ওই খাটের ভেতর থেকে গোসলের সামগ্রী ও পানি নিয়ে আসুন।

-         সেখানে তো এ ধরনের কোনো সামগ্রী নেই।

-         যা বলছি তাই করুন।

আমি (আবা সালাত) কোষাগারে গিয়ে দেখলাম, হ্যাঁ, সেখানে সবই রয়েছে। সেসব আনলাম এবং আমার ঢিলে পোশাক কোমরে বেধে নিলাম যাতে গোসলে (নতুন) ইমামকে সাহায্য করা যায়। ইমাম জাওয়াদ (আ.) বললেন, হে আবা সালাত! এক পাশে সরে যান। যিনি আমাকে সাহায্য করছেন তিনি অন্য কেউ (সম্ভবত ফেরেশতা)। এরপর তিনি প্রিয় বাবাকে গোসল দেন এবং তা শেষ করে বললেন: কোষাগারের ভেতরে একটি ঝুড়ি আছে তা নিয়ে আসুন, তাতে কাফন ও  ‘হানুত’ বা লাশ সংরক্ষক মশলা রয়েছে। আমি সেখানে গেলাম ও একটি ঝুড়ি দেখলাম। অমন ঝুড়ি আমি তার আগে কখনও দেখিনি। আমি কাফন, হানুত ও কাফুর নিয়ে আসি।  

ইমাম জাওয়াদ (আ.) নিজের পিতাকে কাফন পরালেন ও নামাজ পড়লেন। এরপর বললেন, কফিন নিয়ে আসুন।

আমি (আবা সালাত) বললাম: কাঠ মিস্ত্রির কাছ থেকে?

ইমাম বললেন: কোষাগারে কফিন আছে।

আমি ভেতরে গেলাম ও দেখলাম কফিন তৈরি হয়ে আছে। ইমাম জাওয়াদ (আ.) বাবা ইমাম রেজা (আ.)-কে কফিনে রাখলেন ও এরপর নামাজে দাঁড়ালেন।

আকাশের দিকে ইমাম রেজা (আ.)’র কফিনের উড্ডয়ন

ইমাম জাওয়াদ (আ.) নামাজ তখনও শেষ করেননি। এমন সময় আমি (আবা সালাত) দেখলাম ছাদ ফাঁক বা বিদীর্ণ হয়ে সেই জায়গা দিয়ে ইমাম রেজা (আ.)’র কফিন আকাশের দিকে গেল।

আমি বললাম: হে ইবনে রাসূলুল্লাহ (সা.) তথা রাসূলের সন্তান! এখনই  (জালিম বাদশাহ) মামুন আসবেন এবং বলবেন যে হযরত রেজা (আ.)’র পবিত্র দেহের কি হল?

ইমাম জাওয়াদ বললেন: শান্ত হন! ওই পবিত্র দেহ শিগগিরই ফিরে আসবে হে আবা সালাত! কোনো নবীই বিশ্বের পূর্বাঞ্চলে মারা যান না যতক্ষণ না আল্লাহ তাঁদের এবং তাঁদের প্রতিনিধির শরীর ও আত্মাকে একত্রিত না করেন, এমনকি যদি তাঁর ওয়াসি, প্রতিনিধি বা খলিফা বিশ্বের পূর্বাঞ্চলেও মারা যান। (মহানবী-সা.-এর প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর সঙ্গে ইমামের সাক্ষাতের ইঙ্গিত) 

এরপর আবারও ঘরের ছাদ ফাঁক হল এবং সেখান দিয়ে ইমাম রেজা (আ.)’র কফিন আবারও মাটিতে অবতরণ করল।

এরপর ইমাম জাওয়াদ (আ.) পিতার পবিত্র দেহকে কফিন থেকে বের করেন এবং সেই আগের অবস্থার মত তাঁকে এমনভাবে বিছানায় রাখেন যে মনে হল যেন, গোসলও দেয়া হয়নি ও কাফনও পরানো হয়নি। এরপর বললেন: হে আবা সালাত! উঠুন এবং মামুনের জন্য দরজা খুলে দিন।

ইমাম রেজা (আ.)’র পবিত্র লাশ মুবারকের পাশে বাদশাহ মামুন

হঠাৎ মামুন তার ভৃত্য বা দাসদের নিয়ে ক্রন্দনরত অবস্থায় ও ফুলে-ওঠা চোখ নিয়ে প্রবেশ করে ইমাম রেজা (আ.)’র ঘরে। সে নিজের মাথা চাপড়াতে চাপড়াতে তথা নিজের মাথায় হাত দিয়ে আঘাত করতে করতে ইমাম রেজা (আ.)’র পবিত্র মাথার পাশে বসল ও  ইমামের লাশ মুবারককে সুসজ্জিত করে দাফন করার নির্দেশ দিল।

আবা সালাত আরো বলেন, ইমাম রেজা (আ.) আমাকে যা যা বলেছিলেন তার সবই ঘটেছিল। মামুন (সেসব দেখে) বলত: আমরা সব সময়ই হযরত রেজার (আ.) জীবিত অবস্থায় তাঁর অনেক কারামাত বা অলৌকিক ঘটনা দেখেছি, আর এখন তিনি তাঁর মৃত্যুর পরও  সেইসব কারামাত বা অলৌকিক ঘটনাগুলো আমাদের দেখাচ্ছেন।

মামুনের মন্ত্রী তাকে বলল: আপনি কি বুঝেছেন ইমাম রেজা (আ.) আপনাকে কী দেখালেন?

- না,

-  তিনি এইসব ছোট ছোট মাছ ও বড় মাছ দেখানোর মাধ্যমে এটা বলতে চেয়েছেন যে, আপনাদের বনি আব্বাস রাজবংশের রাজত্ব ব্যাপকতা ও দীর্ঘস্থায়ীত্ব পাওয়া সত্ত্বেও এইসব ছোট ছোট মাছের মত এবং যখন আপনাদের সময় ফুরিয়ে যাবে তখন আল্লাহ নবী বংশ তথা আমাদের আহলে বাইতের মধ্য থেকে এক ব্যক্তিকে তোমাদের ওপর কর্তৃত্বশীল করবেন ও তিনি তোমাদের ধ্বংস করবেন।

-  ঠিকই বলেছেন। (মামুন বলল)

 এরপর মামুন আমাকে (আবা সালাত) বলল: সেটা কি দোয়া ছিল যেটা আপনি পড়েছেন?

আমি বললাম: আল্লাহর কসম! আমি সেই দোয়া পড়ার পরপরই তা ভুলে গেছি। আর আসলেই তা ভুলে গিয়েছিলাম।"

ইমাম রেজা (আ.)'র  আরো অনেক অলৌকিক ঘটনা বা মু’জেজা রয়েছে। যেমন, অন্য ইমামদের মত তিনিও পৃথিবীর সব জাতির ভাষায় বিশুদ্ধভাবে কথা বলতে পারতেন। এ ছাড়াও ইমামের দেয়া জামার স্পর্শে এক ব্যক্তির দাসীর অন্ধত্ব মোচন ; কোনো এক ব্যক্তির মৃত্যু কখন হবে তা বলে দেয়া;  ইমামের নিজ হাতে মাটি খুঁড়ে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত করা ও সেই ঝরনা আজো বহমান থাকা; ইমামের সাহাবী রাইয়ানকে তার মনের আশা অনুযায়ী তার মেয়েদের জন্য গয়না কিনতে অর্থ দেয়া ও কাফনের জন্য তাকে নিজের জামাও দেয়া যদিও রাইয়ান ইমামের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার সময় তার মনে অতীতের লালিত এইসব ইচ্ছার কথা বলতে ভুলে গিয়েছিল ; ইমামের মাজার জিয়ারত করতে এসে বোবা মেয়ের বাক-শক্তি লাভ, ইমামের জীবিত অবস্থায় ডাকাতদের পাল্লায় পড়া (মুখ ও জিহ্বায়) আহত ইমাম ভক্ত এক ব্যক্তিকে স্বপ্নযোগে (তার মুখ ও জিহ্বার) ক্ষত সারিয়ে তোলার ওষুধ বানানোর পদ্ধতি বলে দেয়া  এবং পরে সে সরাসরি ইমামের সঙ্গে দেখা করলে ইমাম তাকে ওই স্বপ্নের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে আবারও ওষুধ বানানোর সেই একই পদ্ধতির কথা স্মরণ করিয়ে দেন..... ইত্যাদি। #

পার্সটুডে/মু.আ.হুসাইন/১৪