ঈদুল ফিতর উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠান
ঈদ হচ্ছে রোজাদারদের জন্য আনন্দের দিন, খুশির দিন, পুরস্কারের সুসংবাদ প্রাপ্তির দিন। পুরো রমজান মাস জুড়ে রোজাদারগণ আল্লাহর দরবারে ইবাদাত-বন্দেগির উপঢৌকন পাঠিয়ে ঐশী রহমত, বরকত, মাগফেরাত ও নাজাতের মিষ্টি ভোজ করেছেন।
রমজানের পর শাওয়াল মাসের শুরুতে তাঁরা অনুভব করছেন নতুন এক জীবন। ঈমানের নবায়নের মাধ্যমে তরতাজা, স্নিগ্ধ, নিষ্পাপ কিশলয়ের মতো জীবনের সূচনা করেছেন। তাই ঈদের দিনে চারিপাশের সকল কিছুই যেন ঐশী রং ও গন্ধ লাভ করেছে। চারদিকে তাই খুশি আর আনন্দের নব জোয়ার বইছে। এই জোয়ার সারাজীবন আমাদের মাঝে বিরাজ করুক- এই প্রত্যাশা রইলো।
ঈদুল ফিতর একটি অনন্য সাধারণ দ্বীনি উৎসব। এইদিনে ধনী-গরীবে কোনো ভেদাভেদ থাকে না। সবার জন্যই এই দিনটি সমান আনন্দের। এই আনন্দ যেন সবাই উপভোগ করতে পারে সেজন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কিছু বিধান দিয়েছেন। যেমন যারা ধনী তাদের ওপর ফিতরা দেওয়া অত্যাবশ্যকীয় করে দিয়েছেন। ফিতরা এক ধরনের জাকাত। এই জাকাত দেওয়া প্রত্যেক সামর্থবান মুসলমানের ওপর অবশ্য কর্তব্য। ফিতরা কোনো দান নয় বরং আবশ্যিক দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালনে বাধ্য সামর্থবানরা। সুতরাং যারা ফিতরা গ্রহণ করে তারা সামর্থবানদের কর্তব্য পালনে সহায়তা করে থাকে। তবে এই বিধানের উদ্দেশ্য হলো গরীবরাও যেন ধনীর মতোই ঈদের দিনটি উদযাপন করতে পারে আনন্দের সঙ্গে। ফিতরা তাই দিতে হয় ঈদের নামাজে যাবার আগেই। কবি নজরুল তাঁর বিখ্যাত ঈদের গানে যেমনটি বলেছেন:
তোর সোনা-দানা,বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ
দে যাকাত,মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিঁদ
ঈদের দিনে উঁচু-নীচু ধনী-গরীবের মধ্যকার পার্থক্য ঘুচে যায়। শত্রু-মিত্রর মাঝেও কোনোরকম দেয়াল থাকে না বা থাকা উচিত নয়। নজরুলের ভাষায়:
আজ ভুলে যা তোর দোস্ত-দুশমন, হাত মেলাও হাতে,
তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরিদ।
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
কী চমৎকার এক সংস্কৃতি। ক্ষমতা কিংবা শক্তির দাপটে নয় বিশ্বকে বশে আনতে হবে প্রেম দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে। এই প্রেমের শিক্ষাই দেয় ঈদ। কীরকম প্রেম? তোরে মারল'ছুঁড়ে জীবন জুড়ে ইট পাথর যারা
সেই পাথর দিয়ে তোলরে গড়ে প্রেমেরই মসজিদ।
যারা আপনাকে সারা জীবন বিচিত্র পন্থায় রোষানলের ইট-পাথর ছুঁড়ে মেরে কষ্ট দিয়েছে, আপনি তাদের নিক্ষিপ্ত সেইসব ইট-পাথর দিয়ে প্রেমের মসজিদ তৈরি করুন। ঈদ এই শিক্ষাই দেয়।
আরও একটি জরুরি বার্তা আছে ঈদের জন্য। সেটি হলো:
যারা জীবন ভরে রাখছে রোজা,নিত্য উপবাসী
সেই গরিব ইয়াতীম মিসকিনে দে যা কিছু মুফিদ
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ।
তার মানে হলো আপনি তুচ্ছ তাচ্ছিল্যভরে দান করলে চলবে না। যারা সারা বছর ধরেই ক্ষুধায় তৃষ্ণায় কষ্ট ভোগ করে, যাদের বাবা নেই, মা নেই, আদর স্নেহ বঞ্চিত যারা, যাদের কোনো অভিভাবক নেই-সেইসব এতিম-মিসকিনদের আজ দুই হাতে দান করতে হবে। যাচ্ছেতাই দিয়ে নাম কুড়ালে চলবে না। সবচেয়ে উত্তম বা ভালো জিনিসটাই তাদেরকে দিতে হবে। এটাই ঐশী তাগিদ।
ইসলামি সংস্কৃতিতে তাই ঈদের ভূমিকা ও গুরুত্ব অপরিসীম। বিশ্বের অন্তত দেড় শ কোটি মুসলমান ঈদের দিনে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এক কাতারে শামিল হয়ে ঈদের নামাজ আদায় করেন। তার মানে কোনোরকম জাত-অভিজাতের গুরুত্ব নেই ইসলামে। সকল দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ভুলে গিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে ঈদের সকল কার্যক্রম চালায় মুসলমানেরা।ঈদের নামাজ যদিও ফরজ নয় তারপরও সমগ্র ইরানেরই শহর-নগর, গ্রাম, মহল্লায় ঈদের নামাজ পড়ার জন্য মুসলমানরা কাতারবদ্ধ হয়ে যান।এই দৃশ্য বিশ্বের সকল মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাতেই পরিলক্ষিত হয়। গোসল করে,নতুন জামা কাপড় পরে, মনের সকল কালিমা দূর করে সবাই যখন কাতারবদ্ধ হয়ে ঈদের নামাজ পড়েন তখন অন্যরকম এক ভালোলাগার মতো দৃশ্যের অবতারণা হয়। এই দৃশ্য বলে দেয় মুসলমানরা অভিন্ন জাতি, ঐক্যবদ্ধ জাতি, এক আল্লাহরই ইবাদাতকারী একটি সুশৃঙ্খল জাতি।ঈদের এই শিক্ষা যেন আমরা আমাদের সমগ্র জীবনে কাজে লাগাতে পারি-সেই মানসিকতা ও সচেতনতা আল্লাহর আমাদের দান করুন।
ঈদগাহে মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ নামাজের ইতিবাচকতা নিয়ে বলছিলাম। মুসলমানদের মধ্যে এই ঐক্যের দৃঢ়তা দেখে খুশি হন আল্লাহ আর হতাশ হয়ে যায় শয়তান এবং শয়তানের প্রেতাত্মারা। কারণ শুধু ঈদগাহেই নয় মুসল্লিরা নামাজ শেষে কোলাকুলি করে পারস্পরিক সম্প্রীতির এক অপূর্ব বন্ধনে আবদ্ধ হন। তারপর তারা চলে যান আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করতে। মৃতদের কবর জিয়ারত করতে। ইসলামের শত্রুরা এইসব দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে যায়, হতাশায় ভুগতে থাকে। সবচেয়ে বেশি অসন্তুষ্ট হয় শয়তান এবং তার দোসররা। ইউরোপীয় বিখ্যাত মনীষী টমাস আর্নল্ড মুসলমানদের এই ঈদের নামাজের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে লিখেছেন:… মানুষ মুসলমানদের এই ঐক্যবদ্ধ নামাজের আধ্যাত্মিক সুষমায় আপ্লুত হয়ে পড়ে এবং বলাবাহুল্য বিধর্মীরা এই সৌন্দর্যের প্রভাবে প্রভাবিতও হয়।
আমরা ফিতরার কথা বলেছি। ফিতরার বাইরেও যাদের ওপর জাকাত ফরজ হয়েছে তাদের উচিত জাকাত আদায় করার মাধ্যমে সমাজের অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করা।যারা প্রকৃতই ঋণগ্রস্ত তাদেরকে ঋণভার থেকে মুক্তি দিয়ে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তোলার চেষ্টা চালানো উচিত।ইসলামের এইসব বিধি-বিধান থেকে বোঝা যায় এটি একটি সামাজিক জীবন-বিধান। ইসলাম একাকী ভালো থাকার শিক্ষা দেয় না। সমাজের উঁচু-নীচু সবাইকে নিয়েই ভালো থাকার শিক্ষা দেয় ইসলাম।ফিতরা তো একদিনের বিষয়। কিন্তু এই ফিতরার সংস্কৃতি বজায় রাখতে হবে সারা বছর। রোজা রেখে ধনী-গরীব যেমন একইরকমের ক্ষুধা-তৃষ্ণার অভিজ্ঞতা লাভ করেছে সেই অভিজ্ঞতার আলোকে ঈদের ফিতরা দেওয়ার মতো সারা বছর ধরেই গরীবদের প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে। মনে রাখতে হবে গরীবের জন্য সারাবছরই তো রোজা। সুতরাং সারাবছরই তাদেরকে ফিতরার মতো দান-অনুদান অব্যাহত রাখতে হবে।
আরেকটি কথা।পুরো রমজান মাসে আমরা যেরকম সংযমের সংস্কৃতি চর্চা করেছি সেই ধারা অব্যাহত রাখতে হবে।ভালো কাজ করতে যদি নাও পারি অন্তত কোনো একটি খারাপ যেন আমরা না করি-সেই চেষ্টা থাকতে হবে। তাকওয়া অর্জনের মাসব্যাপী কর্মশালা ছিল রমজান মাস। এই মাসে আমরা কারো গীবত চর্চা করি নি,সারা বছরও যেন গীবত চর্চা না করি। এ মাসে মিথ্যা কথা বলি নি, কাউকে ঠকাই নি, পুরো বছরেও যেন এই অভ্যাস আমরা বজায় রাখতে পারি,সেই চেষ্টা চালাতে হবে। খুন-খারাবি,অপরের অধিকার হরণ,অবৈধ যৌনতার চর্চা ইত্যাদি মানবিয় অসৎ গুণাবলি যেমন চর্চা করি নি রমজানে,সেরকমই বাকি মাসগুলোতেও চর্চা যেন না করি। মনে রাখতে হবে আমরা যখন ঈদের আনন্দে মাতোয়ারা তখন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বহু মুসলমান ক্ষুধার তাড়নায় মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। নারী-শিশু-বৃদ্ধরা জালিম শাসকের অন্ধ কারাগারে নিরানন্দ বন্দি জীবন যাপন করছে। তাদের কথাও যেন আমরা ভুলে না যাই।
ঈদ সবার জন্য বয়ে আনুক আনন্দের জোয়ার। মজলুম নিপীড়িত মুসলমানের মুখেও ফুটিয়ে তুলুক হাসির রেখা-এই কামনা করছি। ও হ্যাঁ! যাদের বাবা-মা নেই, তাঁরা অবশ্যই তাদের কবর জিয়ারত করতে ভুলবেন না।একইভাবে ভুলবেন না অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব তথা মৃত সকল মুমিনের কথা। আল্লাহ যেন তাদের ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করে দিয়ে জান্নাত নসিব করেন। #
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/ ৫