মানবিকতার ঈদ
(last modified Mon, 10 May 2021 12:23:39 GMT )
মে ১০, ২০২১ ১৮:২৩ Asia/Dhaka
  • মানবিকতার ঈদ

মুহাম্মদ মিজানুর রহমান: মুসলমানদের অন্যতম ধর্মীয় ও আনন্দের উৎসব ঈদ-উল-ফিতর। যা প্রতি বছর গোটা মুসলিম জাতির জন্য নিয়ে আসে আনন্দের বারতা। উৎসবের মহা আয়োজন। ঘরে ঘরে বেজে উঠে আনন্দের সুর। যে সুরে ছুঁয়ে যায় মন-প্রাণ।

আর সেই সুর ঝংকৃত হয়েছে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত কালজয়ী গান- ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ/ তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ।’

ঈদের খুশি সার্বজনীন। আর এই আনন্দও সবার। এই দিনের মহিমায় উচুঁ-নিচু আর ধনী-গরিবের ভেদাভেদ ভুলে যায় মানুষ। মানব তরে সবাই নিজেকে উৎসর্গ করতে চায়। পেতে চায় আল্লাহর অশেষ রহমত। এই রহমত আর কিছু নয়, যা মানুষের দোয়া ও ভালোবাসা। যে ভালোবাসা অর্জিত হয় দুর্দিনে মানুষের পাশে থেকে। মানুষকে আপন ভেবে কাছে টেনে নিয়ে। তখনি সার্থক হয়ে উঠে কবির কণ্ঠে ধ্বনিত সেই অমর গান- ‘তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ।’

ত্যাগ ও উদারতার মহিমা নিয়ে ঈদ এসেছে ধরায়। মানব মাঝে এই মহিমা ছড়িয়ে ভুবনকে আলোকিত করতে হবে। মুছে দিতে হবে মানুষের দুঃখ-দুর্দশা। বাড়িয়ে দিতে হবে সাহায্যের হাত। তাহলেই অন্যের মুখে ফুটবে হাসি। যে হাসি আনন্দের। ঈদের প্রকৃত আনন্দ তখনই উপভোগ্য হয়ে উঠবে, যখন সবার দ্বারে পৌঁছে যাবে ঈদের এই খুশি। সমাজের বঞ্চিত অবহেলিত মানুষগুলো অভুক্ত থাকবে না। অত্যন্ত কয়েকদিনের জন্য হলেও অন্যের ভালোবাসা তাদের এই দৈন্যতাকে ঘুচিয়ে দেবে।

প্রতিটি মানুষ যদি নিজের দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে অন্যের সাহায্যে এগিয়ে আসে, এ সমাজে এত অসহায় মানুষ থাকতে পারে না। মানুষকে ভিক্ষে দিয়ে তার বেড়ে উঠার চেতনাকে নষ্ট করবো না ঠিকই, কিন্তু তাকে তো একটা রাস্তা দেখিয়ে দেবো, যে পথ বেয়ে সে সমাজের মূল ধারায় মিশে যাবে। বাঁচতে শিখবে মাথা উঁচু করে। আমরা সেই ভালোবাসা মানুষকে দিতে চাই, যে ভালোবাসা মানুষকে বদলে দেয়। ভিক্ষের বাটি ছেড়ে পরিশ্রমের কুঠার ধরতে শেখায়। ঈদের এই শুভক্ষণে মানুষের দিকে এমনি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেই। যে হাত কখনো অন্যের কাছে মিনতির আর্জি নিয়ে হাজির হবে না। বরং নিজেই ভালোবাসার স্মারক হয়ে অন্যের পাশে দাঁড়াতে শিখবে।

বিবেক মানুষের সবথেকে মূল্যবান জিনিস। কিন্তু আমাদের সমাজচিত্র এখন বদলে দিয়েছে মানুষকে। বদলে দিয়েছে তাদের চিন্তাচেতনাকে। অন্যায় করেও আজ মানুষ লজ্জাবোধ করে না। অহমিকা মানুষের বিবেককে ধ্বংস করে দিয়েছে। মিথ্যে প্রবোধ নিয়ে আজ স্বস্থিবোধ করছে। প্রিয়জন মানবেতর জীবনযাপন করছে। কেউ টাকার অভাবে সুচিকিৎসা পাচ্ছে না। সে দিকে লক্ষ নেই কারো। এই বিবেক নিয়ে যে মানুষ আজ বেঁচে আছে, তার একবারও কি মনে হয় না সে অপরাধ করছে? অতীতের সব কথা ভুল যাই। আর মানুষ হয়ে বেঁচে উঠি। ঈদের এই পরম আনন্দের দিনে নতুন করে শপথ নি, যতদিন থাকি মানুষ হয়ে থাকব। আর মানুষের পাশে রবো। আমি চাকচিক্যে বসবাস করছি। আর আমার প্রতিবেশী কষ্টে রয়েছে। তার কথা ভাবছি না। তার সাহায্যে এগিয়ে যাচ্ছি না। আর যাই হোক আমি এখনো মানুষ হতে পারিনি। যে মানুষকে সৃষ্টিকর্তা বিবেক দিয়ে তৈরি করেছেন সেই মানুষ। যার মর্যাদা সমস্ত সৃষ্টিকুলের উপরে।

অন্যকে নিয়ে ভালো থাকার মধ্যেই প্রকৃত সুখ। যে সুখ হারিয়ে মানুষ আজ ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। এই অসুখ সাড়িয়ে তোলা এখন সময়ের প্রয়োজন। অন্যথায় মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের প্রশান্তি মিলবে না। শেষ হবে না তার প্রত্যাশা। যতই থাকুক তার। এই ঈদ-ই যেন আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ ঈদে রূপান্তরিত হয়। আমরা আমাদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা দিয়ে অন্যের অভাব মুছে দিতে কাজ করব। আমার সেই প্রিয়জনকে কাছে টেনে নেব, যাকে আমি এতদিন দূরে ঠেলে রেখেছি। আমার প্রতিবেশী অনেক স্বপ্ন নিয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ঈদের এই আনন্দক্ষণে আমি নিরাশ করব না তাকে। পরম যত্নে তাকেও ভাই বলে বুকে জড়িয়ে নেবে। এটাই মানবিকতা। এটাই সৌজন্যতা। এখানেই পুণ্য।

সম্পদ অনেকের রয়েছে। কিন্তু সবাই মানুষের সেবায় নিজের সম্পদকে ব্যয় করতে পারে না। একজন সাধারণ অসহায় মানুষকে মায়া-মমতা দিয়ে বুকে টেনে নেওয়া অনেক বড় মহত্মের পরিচয়। যে মন ও উদারতা সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ। এরকম হৃদয়বান মানুষ তারাই হতে পারে যাদের প্রতি স্রষ্টা রহম করেছেন। যাদের অন্তর সিক্ত হয়েছে প্রভুর ভালোবাসায়। 

মানুষ কতো অসহায়! জীবন ও জীবিকার তাগিদে মানুষ এখান থেকে ওখানে ছুটে চলেছে। তবুও কাজের সন্ধান মিলছে না। পরিবার-পরিজন নিয়ে কী যে এক কষ্টকর জীবন! অনেকে নিজের সমস্যার কথা কাউকে বলতে পারছে না। অত্মসম্মান বড় একটি প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে তার সামনে। মানুষ মানুষের জন্য। আর স্রষ্টাও তাদের জন্য, যারা মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল। তাই প্রত্যেকের অবস্থান থেকে অন্যের কষ্ট বুঝতে হবে। নিকটজনের এই দুর্দিনে এগিয়ে যেতে হবে। সামাজিক কারণে যে মানুষটি দূরের কারো সাহায্য নিতে পারবে না, কিন্তু কোনো আপনজন তার সাহায্যে এগিয়ে আসলে হৃদয়টা তার আনন্দে ভরে যাবে। দারুণ খুশি হবে সে। এটাইতো ভালোবাসা। শত্রুতা ভুলে পরম বন্ধুতে পরিণত হবার এক সুবর্ণ সুযোগ। এ যে এক মহা খুশির দিন। মুসলিম মিল্লাতের ঈদ।

নিজের খুশিটাকে একটু ছোট করে যদি অন্যের কাজে লাগাই মানুষ খুশি হবে। খুশি হবে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা। এই খুশির মর্ম যদি মানব মন বুঝতে পারে, এর চেয়ে উত্তম খুশি আর কিছুই হতে পারে না। পোশাকের শান্তি বেশি দিন টেকে না, কিন্তু মানুষকে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে যে প্রশান্তি লাভ করা যায় তা কখনো হারিয়ে যায় না। তাই দামি পোশাকের খরচে একটু পরিবর্তন এনে যদি মানুষের কাজে লাগানো যায় এটাই-বা কম কীসে।

বাসায় যে মেয়েটি কাজ করে কখনো বলিনি- খুশি, তোর পরিবার কেমন আছে। মাস গেলে শুধু মাইনেটাই দিয়েছি। এবার ওকে একটু বলি না, তোর পরিবার-পরিজন নিয়ে তুই কেমন আছিস? প্রয়োজনে ওর দিকে সাহায্যের হাতটা বাড়িয়ে দিই। অল্পতেই তুষ্ট হয়ে যাবে ও। ভালো থাকবে ওর পরিবার। এজন্য আমাকে বেশি কিছু দিতে হবে না। তাতেই একরাশ হাসি ফুটে উঠে ওর মুখে। আমার পাওয়া শিক্ষা নিয়ে ও হয়তো একদিন মানুষ হয়ে উঠবে। অন্যের সাহায্যে এগিয়ে যাবে। এটাইতো মানবতা। এটাইতো ইসলামের অমীয় বাণী।

আমরা প্রত্যেকেই কোনো না কোনো পরিবারের সাথে জড়িয়ে আছি। আমাদের সমাজ নিয়ে আমাদের জীবনযাপন। যাপিত এই জীবনে যদি আমরা মানুষের প্রতি দায়িত্বশীল হয়ে উঠি, এ সমাজের পরিবর্তন হবেই। মানুষে মানুষের এই প্রভেদ যা একদিন ঘুচে যাবে। জেগে উঠবে মানুষের মনুষ্যত্ব।

মানুষ কখনো দায়িত্বশীল হয়ে জন্মায় না। পারিপার্শ্বিকতা তাকে সবকিছু শিখিয়ে দেয়। ঈদ ধরাধামে আনন্দের যে বারতা নিয়ে এসেছে মানবিকতা ও মনুষ্যত্ব দিয়ে তাকে গ্রহণ করতে হবে। ঈদের আনন্দ যেন সার্থক হয়ে উঠে। মানুষের মুখে হাসি ফুটাতে এই আনন্দ যেন বিলিয়ে দিতে পারি সবার তরে।  

লেখক : সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও ইসলামবিষয়ক গবেষক, বাংলাদেশ।      

পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/১০

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।