মে ০৬, ২০২১ ১৭:৪৪ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা পাশ্চাত্যে মাদকের ব্যাপক ব্যবহার এবং এ ক্ষেত্রে ইউরোপ ও আমেরিকার ভুল নীতি সম্পর্কে আলোচনা করেছি।

আমরা ইউরোপ ও আমেরিকার এ সংক্রান্ত আচরণ তুলে ধরতে গিয়ে আফগানিস্তানে পপি চাষ ও মাদক উৎপাদন বৃদ্ধির প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলেছি। আমরা বলেছি প্রায় দুই দশক ধরে আফগানিস্তানে সেনা মোতায়েন করে রেখেছে আমেরিকা ও ইউরোপীয় দেশগুলো। পরোক্ষভাবে দেশটির নিয়ন্ত্রণ তাদেরই হাতে। কিন্তু এই সময়ে সেদেশে মাদক উৎপাদন বহু গুণে বেড়েছে। ২০০১ সালে আফগানিস্তানে বার্ষিক মাদক উৎপাদনের পরিমাণ ছিল মাত্র প্রায় ২০০ টন, কিন্তু ২০১৮ সালে উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার টনে অর্থাৎ মার্কিন নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মাদক উৎপাদন ৫০ গুণ বেড়েছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার আনুষ্ঠানিক পরিসংখ্যানেই এসব তথ্য উঠে এসেছে। সমাজ ধ্বংসকারী হেরোইনের প্রধান উৎস হিসেবে ভূমিকা রেখে চলেছে আফগানিস্তান। আমেরিকা সেখানে বিপুল সংখ্যক সেনা মোতায়েন রেখেছে। আফগানিস্তানকে দখলে নেয়ার পর সেখানে মাদক উৎপাদন বৃদ্ধিই প্রমাণ করে আমেরিকা ও ইউরোপ মাদক নির্মূলে কখনোই আন্তরিক ছিল না, লোক দেখানো নানা পদক্ষেপ হয়তো কখনো কখনো চোখে পড়ে কিন্তু বাস্তবে তারা মাদকের মূল উৎসের ধ্বংস চায় না। আজকের আসরে পাশ্চাত্যে বিদ্যমান আরও কিছু সমস্যা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ইরানের সর্বোচ্চ নেতার বক্তব্য দিয়েই আজকের আলোচনা শুরু করছি। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেছেন, আজকের আমেরিকা প্রসাধনী মেখে সেজেগুজে নিজেকে তুলে ধরছে, কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি এমন নয়। বর্তমানে আমেরিকা হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে ঋণগ্রস্ত দেশ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছে তাদের ঋণের পরিমাণ ২২ হাজার বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে আমেরিকায় শ্রেণী বৈষম্য অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। আমি যেসব কথা এখন বলছি তা আমার নিজের কথা নয়, এটা আমেরিকারই একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের বক্তব্য। তিনি নিজে মার্কিন শাসক শ্রেণীর একজন সদস্য। অর্থাৎ কংগ্রেসের সদস্য, একজন সিনেটর। এগুলো তার কথা। আমি তার নাম জানি, কিন্তু কোনো ব্যক্তির নাম আনতে চাচ্ছি না। তিনি বলেছেন ট্রাম্পের সরকারের তিন বছরে শীর্ষ ধনীদের পাঁচ জনের সম্পদ বেড়েছে একশ’ বিলিয়ন ডলারের বেশি, এই পাঁচ জনের মধ্যে তিন জনের সম্পদ আমেরিকার অর্ধেক জনসংখ্যার সম্পদের সমান।

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আরও বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিদ্যমান শ্রেণী বৈষম্যটা দেখুন। জনসংখ্যার অর্ধেক অর্থাৎ ১৬ কোটি মানুষ এর মানে হলো, তিন জনের কাছে যে সম্পদ রয়েছে তা ১৬ কোটি মানুষের সম্পদের সমান। প্রতি পাঁচ জন মার্কিন নাগরিকের মধ্যে মাত্র একজন ডাক্তার দেখানোর পর ওষুধ কেনার সামর্থ্য রাখেন, অন্য চার জন ডাক্তারের কাছে গেলেও ওষুধ কেনার সামর্থ্য রাখেন না। শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গের মধ্যে সম্পদের ব্যবধান গত পাঁচ বছরে তিন গুণ বেড়েছে।

এটাই বাস্তবতা। আমেরিকার প্রেসিডেন্টরা দাবি করেন অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি করেছেন। কিন্তু আমেরিকার ঐ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বলছেন অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে কিন্তু সেটা কেবল বিলিয়নারদের জন্য, সাধারণ মানুষের জন্য নয়। এই হলো আমেরিকার সামাজিক অবস্থা। আমেরিকার লাখ লাখ মানুষ রাতে খাবার পান না। বিপুল সংখ্যক মানুষ রাতে রাস্তায় ঘুমাতে বাধ্য হচ্ছেন। একটু শীত পড়লেই শোনা যায় আমেরিকায় কিছু লোক ঠাণ্ডায় মারা গেছে কেন মারা যাবে? যেমন ধরুন মাইনাস ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস; এরকম ঠাণ্ডায় মানুষ মারা যাওয়ার কথা নয়, যেহেতু তারা রাস্তায় ঘুমান রাস্তায় থাকার কারণে তারা মারা যান।

আমেরিকার বিপুল সংখ্যক মানুষ রাস্তায় ঘুমান, কারণ তাদের কোনো ঘরবাড়ি নেই। যখন যেখানে জায়গা পান সেখানেই ঘুমান। আমেরিকার উন্নত শহর নিউ ইয়র্কের দিকে তাকালেই দেশটিতে গৃহহীনতা সমস্যার গভীরতা ও পরিধি অনুমান করা যায়। ২০১৯ সালের ৭ ডিসেম্বর নিউ ইয়র্কের গভর্নর অ্যান্ড্রু এম. কুওমো, মহানগর পরিবহন কর্তপক্ষ বা এমটিএ'র কাছে লেখা চিঠিতে জানিয়েছেন, ২০১৮ সালে কেবল সাবওয়েতে বসবাসকারী গৃহহীন মানুষের সংখ্যা ছিল এক হাজার ৭৭১ জন। এই সংখ্যা ২০১৯ সালে ২৩ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ১৭৮ জনে। ২০১৯ সালের পরিসংখ্যান তুলে ধরে তিনি আরও জানিয়েছেন, ট্রেন লাইনে গৃহহীন মানুষের হেঁটে চলার কারণে ট্রেন চলাচলে বিলম্বের ঘটনা কয়েক বছরে ৫৪ শতাংশ বেড়েছে। আমেরিকার  প্রায় সব শহরেই এমন চিত্র চোখে পড়ে।

জার্মানির গণমাধ্যম ডয়চে ভেলের ২০১৮ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জার্মান ফেডারেল অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য সাপোর্ট অফ হোমলেস-এর তথ্য অনুযায়ী, জার্মানিতে সাড়ে আট লাখেরও বেশি মানুষ গৃহহীন৷ এদের মধ্যে প্রায় আট লাখ মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে বা পরিচিতদের সাথে রাত কাটালেও বাকিরা থাকেন রাস্তায়, অর্থাৎ মোট গৃহহীনের ৬ ভাগ খোলা আকাশের নীচে রাত কাটান। অন্যদিকে প্রায় সাড়ে চার লাখ বৈধ শরণার্থির বেশিরভাগই থাকেন গণআবাসনে। তবে এ সব ক্ষেত্রে অনেকেই ভাড়া নেয়া সত্ত্বেও আবাসন থেকে বিতাড়িত হন। জার্মানির জরুরি দাতব্য সেবা সংস্থা বানহফ্সমিশন-এর দেয়া তথ্য অনুযায়ী, কেবল বার্লিনের বিভিন্ন স্টেশনের আশেপাশে এ ধরনের মানুষের সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। জার্মানিতে শরণার্থীদের মধ্যে অন্তত ৬০ ভাগই এসেছেন রোমানিয়া, বুলগেরিয়া ও পোল্যান্ডের মতো ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে।

জার্মানির প্রায় সব বড় শহরের অবস্থান প্রায় অভিন্ন। কারণ এ ধরণের গৃহহীন মানুষেরা বড় শহরগুলোতেই বেশি ভিড় জমায়। কারণ বড় শহরে চাকরির সুযোগ বেশি। সেইসাথে বড় শহরগুলোতে পর্যটকও আসে প্রচুর যারা ভিক্ষা দিতে তুলনামূলকভাবে উদারহস্ত। গৃহহীনদের জন্য সবচেয়ে কঠিন সময় এই শীতকাল। প্রতি বছরই ইউরোপ ও আমেরিকায় ঠাণ্ডার কারণে শত শত গৃহহীন মানুষ মারা যায়। রাতে বেরুলেই রেল স্টেশন, বিভিন্ন সড়ক ও স্কয়ারে চোখে পড়ে এমন অসংখ্য মানুষ যারা কোনো মতে খেয়েপড়ে জীবন বাঁচিয়ে রেখেছে, কিন্তু রাতে ঘুমানোর মতো স্থায়ী কোনো ঠিকানা নেই। #

পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ০৬

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ