আত্মহত্যায় বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে দশম, কারণ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ অভিমত
আজ (১০ সেপ্টেম্বর) আন্তর্জাতিক আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস। ঠিক একদিন আগে, গতকাল (শুক্রবার) বিকেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আকতার জাহানের মরদেহ বিশ্ববিদ্যালয়ের জুবেরী ভবনে তার শয়ন কক্ষের দরজা ভেঙে উদ্ধার করা হয়েছে। সেখান থেকে একটি সুইসাইড নোট এবং একটি কীটনাশকের বোতলও উদ্ধার করা হয়েছে।
সুইসাইড নোটে শিক্ষিকা আকতার জাহান লিখেছেন, ‘আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। শারীরিক ও মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে আমি এই পথ বেছে নিলাম। সোয়াদকে যেন ওর বাবা কোনোভাবেই নিজের হেফাজতে নিতে না পারে। যে বাবা নিজের সন্তানের গলায় ছুরি ধরতে পারে সে কোনো সময় সন্তানকে মেরেও ফেলতে পারে বা মরতে বাধ্য করতে পারে।’
২০১২ সালে গণযোগাযোগ বিভাগের শিক্ষক আকতার জাহান জলি এবং একই বিভাগের শিক্ষক তানভীর আহমেদ-এর বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। ২০১৬ সালে তানভীর আহমেদ ওই বিভাগের আরেকজন শিক্ষককে বিয়ে করেন।
আকতার জাহান কিছুদিন আগে তাদের একমাত্র ছেলে আয়মান সোয়াদকে ঢাকায় নানা-নানীর বাসায় থেকে পড়াশোনা করতে পাঠিয়ে দেন। এরপর শিক্ষক কোয়ার্টার ছেড়ে জুবেরী ভবনের ৩০৩ নম্বর কক্ষে ওঠেন।
শুক্রবার দুপুরে আইমান মুঠোফোনে তার মাকে না পেয়ে অন্য শিক্ষকদের কাছে খোঁজ নেয়। সহকর্মী শিক্ষকরা আখতার জাহানের খবর নিতে জুবেরী ভবনে গিয়ে দেখেন ভেতর থেকে দরজা বন্ধ। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও বিভাগের শিক্ষকদের উপস্থিতিতে পুলিশ বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। এ সময় ঘরের ভেতরে মশারির মধ্যে ওই শিক্ষক শুয়ে ছিলেন। মুখের দুইপাশ দিয়ে লালা পড়ছিল। তাকে দ্রুত রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে।
গত মে মাসের ঘটনা। তিন থেকে চার ঘণ্টা আগে ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে ঢাকার একজন মডেল কন্যা সাবিরা হোসাইন সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলে আত্মহত্যা করে।
মিরপুরের রূপনগর এলাকার এক বাসায় প্রেমিক নির্ঝর সিনহা রওনককে স্বামী পরিচয় দিয়ে একসঙ্গে থাকতেন সাবিরা হেসেন। মৃত্যুর আগে সাবিরা তার ফেসবুক স্টাটাসে লেখেন, নির্ঝরের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিল তার। কিন্তু তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক গড়েও নির্ঝর তাকে বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানালে ব্যাপারটি মেনে নিতে পারেননি তিনি।
সমাজে একটা পরিচিতি আছে এমন কারো আত্মহত্যার খবর সহজেই গণমাধ্যমে সংবাদ শিরোনাম হলেও প্রতিদিন এমন অনেক আত্মহত্যার খবর প্রকাশ পায় না।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও পুলিশ সদর দফতরের হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রতিদিন গড়ে ২৮ জন আত্মহত্যা করেন। সে হিসাবে প্রতিবছর দেশে প্রায় ১০ হাজার মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার জরিপ বলছে, বাংলাদেশে আত্মহত্যার প্রবণতা কমেছে। তবে পুলিশের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সম্প্রতি আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে ২০১৪ সালে ১১ হাজার ৯৪ জন, ২০১৩ সালে ১০ হাজার ১২৯ জন, ২০১২ সলে ১০ হাজার ১৬৭ জন, ২০১১ সালে ১০ হাজার ৩২৩ জন এবং ২০১০ সালে ১০ হাজার ৭৮৮ জন আত্মহত্যা করেছেন।
বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশে নারী ও তরুণ-তরুণীরা বেশি আত্মহত্যা করছেন বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, উপমহাদেশে প্রায় ৬৫ লাখ মানুষ আত্মহত্যার ঝুঁকিতে রয়েছেন।
অপরদিকে, বিশ্বে প্রতিবছর আত্মহত্যা করেন ১০ লাখেরও বেশি মানুষ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পারিবারিক নির্যাতন, কলহ, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, পরীক্ষা ও প্রেমে ব্যর্থতা, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, প্রাত্যহিক জীবনের অস্থিরতা, নৈতিক অবক্ষয়, মাদক ইত্যাদি কারণে মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, আত্মহত্যা প্রবণতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে দশম। বাংলাদেশে গত সাত বছরে ৭৩ হাজার ৩৮৯ জন আত্মহত্যা করেছেন। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ও বাংলাদেশ পুলিশ সদর দফতর অনুযায়ী, আত্মহত্যাকারীদের বেশিরভাগেরই বয়স ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের জরিপ অনুযায়ী, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, ‘নারীদের ওপর শারীরিক ও যৌন এবং মানসিক নির্যাতন বেড়েছে। যৌন নিপীড়নও ঘটছে ব্যাপকভাবে। এতে অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন।
তবে অবিবাহিত মেয়েদের ক্ষেত্রে বিয়ের আগে যৌন সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য হওয়া কিংবা স্বেচ্ছায় যৌন সম্পর্ক স্থাপনের পর গর্ভধারণ বা শেষপর্যন্ত প্রেমিক পুরুষটি বিয়েতে রাজী না হবার কারণেও অনেক তরুণী আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।
তিনি বলেন, এ প্রবণতা রোধে সরকার, সংবাদমাধ্যম ও পরিবারকেই এগিয়ে আসতে হবে। এ প্রবণতা রোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি জরুরি।#
পার্সটুডে/আবদুর রহমান খান/আশরাফুর রহমান/১০