রেইনট্রিতে ধর্ষণ মামলায় আসামী খালাস এবং আদালতের পর্যবেক্ষণ: বিভিন্ন মহলের প্রতিক্রিয়া
চার বছর আগে রাজধানীর বনানীর রেইনট্রি হোটেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রী ধর্ষণের মামলায় পাঁচজনকে খালাস দিয়েছেন আদালত। গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭-এর বিচারক মোছা. কামরুন্নাহার এ আদেশ দেন।আদালত বলেছে, রাষ্ট্রপক্ষ এই মামলায় অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। আদালতের সময় নষ্ট হয়েছে।
মামলায় রায় দেওয়ার পর আদালত নির্দেশনা দিয়েছেন, ধর্ষণের অভিযোগের ক্ষেত্রে ৭২ ঘণ্টা পার হলে পুলিশ যেন মামলা না নেয়। আর এ নির্দেশনার বিষয়টি নিয়ে সমালোচনায় মুখর হয়েছেন রাজনৈতিক মহল, নারী ও মানবাধিকারকর্মীরা।
বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর রেইনট্রি হোটেলে আলোচিত ধর্ষণ মামলার রায়ে হতাশা ও তীব্র নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন 'যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তারা এতটাই প্রভাবশালী যে, সমস্ত নারী জাতিকে অপমান করে তাদের খালাস দেওয়া হয়েছে।'
শুক্রবার দুপুরে জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি- জাগপার একাংশের উদ্যোগে ৭ নভেম্বর ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ উপলক্ষে জাতীয় প্রেসক্লাবে এক আলোচনা সভায় তিনি এই ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট মানবাধিকারকর্মী আইনজীবী সুলতানা কামাল গণমাধ্যমে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, রায়টি অত্যন্ত হতাশাব্যাঞ্জক। এটি এই সময়কার বহুল আলোচিত কলঙ্কিত মামলাগুলোর মধ্যে একটি। মামলার প্রথম থেকেই সবার মনে এমন শঙ্কা ছিল। এ মামলায় এমন একটি রায় পাওয়া গেল, যা আমাদের বিচারব্যবস্থার প্রতি এখনো যতটুকু আস্থা রাখার চেষ্টা করি আমরা, তার ওপর কঠিন আঘাত হানল। এ রায় কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
ধর্ষণের অভিযোগের ক্ষেত্রে ঘটনার ৭২ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলে পুলিশ মামলা না নেওয়ার যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, সে প্রসঙ্গে সুলতানা কামাল বলেছেন, এমন নির্দেশনা কোনো বিচারেই সংগত বলা যায় না। প্রথমত, ফৌজদারি অপরাধের বিরুদ্ধে মামলা করার কোনো সময়সীমা আমাদের প্রচলিত আইনব্যবস্থায় বেঁধে দেওয়া নেই। এ ক্ষেত্রে বিচারকের এ নির্দেশনা সম্পূর্ণ বেআইনি। অপরাধ যাতে প্রমাণ করা যায়, সে বিষয়ের ওপর জোর না দিয়ে বিচারক ৭২ ঘণ্টার পরে মামলা না নেওয়ার নির্দেশনা দিয়ে ধর্ষণের শিকার মানুষের বিচার পাওয়ার পথে কঠিন অন্তরায় সৃষ্টি করলেন।
মধ্য রাতের পদযাত্রা
বনানীর রেইনট্রি হোটেলে দুই শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের মামলায় পাঁচ আসামিকে খালাস দেওয়া এবং ৭২ ঘণ্টা পর ধর্ষণ মামলা না নেওয়ার বিষয়ে আদালতের এক নির্দেশনার প্রতিবাদে গতকাল মধ্যরাতে ঢাকার শাহবাগ থেকে ‘শেকল ভাঙার পদযাত্রা’ কর্মসূচি আয়োজন করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, নারী অধিকারকর্মী, পেশাজীবী ও শিল্পীসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের নারী-পুরুষেরা পদযাত্রায় অংশ নিয়ে শাহবাগ থেকে মশালমিছিল নিয়ে জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে যান এবং সেখানে তাঁরা একটি প্রতিবাদ সমাবেশ করেন৷
এই কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক রেহনুমা আহমেদ বলেন, ‘একবিংশ শতকে এসে একটি স্বাধীন দেশে এ ধরনের রায় হতে পারে না৷ আদালতের বিচার করার কথা, ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট (চারিত্রিক সনদ) দেওয়ার কথা নয়৷ বিচারক পুলিশকে বলছেন, ৭২ ঘণ্টার পরে ধর্ষণ মামলা না নিতে৷ তার মানে, ধর্ষণ করে ৭২ ঘণ্টা নারীকে আটকে রাখলেই পুলিশ আর মামলা নেবে না?’
সমাবেশে আইনজীবী ফারাহ হোসেন বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরেই সাক্ষ্য আইনের ত্রুটিপুর্ণ ১৫৫(৪) ধারা বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছি৷ আজ একটি মামলার রায়ে দেখা গেল, যে নারীরা বিচার চাইতে এসেছেন, তাঁদের বিচার না দিয়ে বরং তাঁদের চরিত্র নিয়ে কথা বলা হলো৷
অপরদিকে, শ্রমজীবী নারী মৈত্রীর সভাপতি বহ্নিশিখা জামালী ও সাধারণ সম্পাদক রাশিদা বেগম আজ এক বিবৃতিতে রেইনট্রি হোটেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই তরুণী শিক্ষার্থী ধর্ষণ মামলায় আসামিদের খালাস, মামলার রায় ও পর্যবেক্ষণে তীব্র ক্ষোভ, বিস্ময় ও শংকা ব্যক্ত করে বলেছেন, নিম্ন আদালতে এই রায়ে দেশে ধর্ষক ও যৌন নিপীড়নকারীরা আরও উৎসাহিত হবে।এই রায় নারীদের জীবন ও সম্ভ্রমকে আরও বিপদাপন্ন করবে।এই রায় বিস্ময়কর ও বিচারহীনতার নামান্তর।
নেতৃবৃন্দ বলেন, ৭২ ঘন্টা পর ধর্ষণের মামলা না নেবার কথা খুবই বিপজ্জনক, প্রকারান্তরে মামলা না নেবার নির্দেশনা। তারা বলেন, এই রায় ন্যায় বিচার ও আইনের শাসনের পরিপন্থী। তারা ক্ষোভের সাথে উল্লেখ করেন, ক্ষমতাবানদের কাছে আইন-আদালতও কিভাবে জিম্মি হয়ে যায় তাও আর একবার প্রমাণ হলো।
নেতৃবৃন্দ রেইনট্রি হোটেলে এই ধর্ষণ মামলার যথাযথ তদন্তে পুলিশী গাফিলতির তীব্র সমালোচনা করেন এবং আলোচিত এই মামলার পুনঃতদন্ত এবং উচ্চ আদালত এই মামলার রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করার জন্য সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহবান জানান।#
পার্সটুডে/ আব্দুর রহমান খান/ বাবুল আখতার /১২
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।