মধ্যযুগীয় বর্বরতা: চার্চের অন্ধকার শাসন ও সত্যের বিকৃতি
https://parstoday.ir/bn/news/event-i152674-মধ্যযুগীয়_বর্বরতা_চার্চের_অন্ধকার_শাসন_ও_সত্যের_বিকৃতি
সাইফুল খান: “মধ্যযুগীয় বর্বরতা” (Medieval Barbarism) এই শব্দবন্ধটি আজ ইতিহাসের আলোচনায় এমনভাবে প্রোথিত যে, মনে হয়- মুসলিম শাসন বা ইসলামী সভ্যতাই যেন ছিল মধ্যযুগের নিষ্ঠুরতম অধ্যায়। অথচ সত্য এর সম্পূর্ণ বিপরীত।
(last modified 2025-10-08T09:10:00+00:00 )
অক্টোবর ০৫, ২০২৫ ২০:০৮ Asia/Dhaka
  • মধ্যযুগীয় বর্বরতা: চার্চের অন্ধকার শাসন ও সত্যের বিকৃতি

সাইফুল খান: “মধ্যযুগীয় বর্বরতা” (Medieval Barbarism) এই শব্দবন্ধটি আজ ইতিহাসের আলোচনায় এমনভাবে প্রোথিত যে, মনে হয়- মুসলিম শাসন বা ইসলামী সভ্যতাই যেন ছিল মধ্যযুগের নিষ্ঠুরতম অধ্যায়। অথচ সত্য এর সম্পূর্ণ বিপরীত।

“Medieval Barbarism” কথাটির জন্মই হয়েছে ইউরোপের চার্চতন্ত্রের বর্বরতা, অন্ধত্ব ও নিষ্ঠুর ধর্মীয় শাসন থেকে। এটি ছিল এমন এক সময়, যখন মানবচেতনা, যুক্তি, বিজ্ঞান, নারী, শিল্প সবকিছু বন্দি ছিল রোমান ক্যাথলিক চার্চের শৃঙ্খলে। আজ যখন পশ্চিমা ইতিহাস নিজেকে সভ্যতার আলোচক হিসেবে তুলে ধরে, তখন তারা ইচ্ছাকৃতভাবে সেই লজ্জার ইতিহাস ভুলিয়ে দেয়। অথচ ইতিহাসের দলিলপত্র, ইনকুইজিশনের রেকর্ড, পোপীয় আদেশ এবং দার্শনিকদের বিবরণ সবই প্রমাণ করে “মধ্যযুগীয় বর্বরতা” বলতে বোঝায় চার্চের বর্বরতা, ইসলামের নয়।

রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর ইউরোপে যখন রাজনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়ে, তখন ধর্মগুরুদের হাতে ক্ষমতা চলে আসে। সেই সময় থেকেই শুরু হয় Ecclesiastical Supremacy বা চার্চতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্র। ১৩০২ খ্রিস্টাব্দে পোপ বোনিফেস অষ্টম (Pope Boniface VIII) তাঁর বিখ্যাত ফরমান Unam Sanctam-এ ঘোষণা করেন, Every human creature must be subject to the Roman Pontiff (Vatican Archives, Bullarium Romanum, Vol. II, p. 567)। এই ঘোষণাই ইউরোপে রাজনীতি ও ধর্মের সীমারেখা মুছে দেয়। রাজারা পোপের অনুমতি ছাড়া রাজা হতে পারতেন না, আইন নির্ধারিত হতো বাইবেলের ব্যাখ্যা দিয়ে, আর সমাজে চার্চ হয়ে ওঠে সর্বশক্তিমান এক প্রতিষ্ঠান।

এই শাসনব্যবস্থায় মানবচিন্তা ও যুক্তিকে করা হয় অপরাধ। চার্চের কাছে “Faith” ছিল সর্বোচ্চ সত্য, আর “Reason” ছিল শয়তানের ফিসফিস। ১২১০ সালে প্যারিসের কাউন্সিল এবং ১২২৯ সালের Synod of Toulouse-এ ঘোষিত হয়, “No layman may possess books of the Old and New Testament” (Church Council Records, Toulouse Archive, 1229)। অর্থাৎ বাইবেলও সাধারণ মানুষের হাতে রাখা নিষিদ্ধ। জ্ঞানের এই অবরুদ্ধতা ইতিহাসে পরিচিত হয় “Dark Ages” নামে।

এই সময়ের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর নিপীড়ন ব্যবস্থার নাম ছিল Inquisition বা চার্চের ধর্মীয় আদালত। ১২শ শতকে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়, এবং ১৫শ শতকে এসে তা রক্তাক্ত এক আতঙ্কে রূপ নেয়। Henry Charles Lea-এর A History of the Inquisition of Spain (Vol. I, 1906, p. 231) অনুযায়ী, শুধু স্পেনেই প্রায় ত্রিশ হাজার মানুষ ইনকুইজিশনের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড পেয়েছিল। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে বলা হতো “heretic” অর্থাৎ ধর্মত্যাগী। তাকে প্রথমে নির্যাতন করে স্বীকারোক্তি আদায় করা হতো, পরে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হতো। স্পেনের জাতীয় আর্কাইভে সংরক্ষিত Archivo Histórico Nacional, Inquisición, leg. 3995-এর নথিতে উল্লেখ আছে, ১৪৮১ সালে সেভিলে ২৯৮ জনকে একসাথে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়।

চার্চের নির্যাতনের সবচেয়ে করুণ অধ্যায় হলো গ্যালিলিও গ্যালিলেই ও জিওর্দানো ব্রুনোর কাহিনি। গ্যালিলিও ১৬৩৩ সালে ঘোষণা করেছিলেন, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে। কিন্তু রোমের ইনকুইজিশন আদালত তাঁকে অভিযুক্ত করে বলেছিল, “You have rendered yourself suspected of heresy” (Sentence of the Tribunal against Galileo, Vatican Archives, 22 June 1633)। তাঁকে বাধ্য করা হয় নিজের মতবাদ প্রত্যাহার করতে। জীবনের শেষ সাত বছর তিনি গৃহবন্দি অবস্থায় কাটান। জিওর্দানো ব্রুনো, যিনি বলেন 'মহাবিশ্ব অসীম', তাঁকে ১৬০০ সালে রোমের Campo de Fiori-তে পুড়িয়ে মারা হয় (Roman Inquisition Records, Case No. 5341)।

চার্চ কেবল জ্ঞান দমন করেই থেমে থাকেনি; তারা পাপকেও বানিয়েছিল ব্যবসা। ১৫১৫ সালে পোপ লিও দশম (Pope Leo X) ঘোষণা দেন যে, অর্থের বিনিময়ে পাপ মোচন সম্ভব। এ ছিল “Indulgence” নামক পাপের সার্টিফিকেট বিক্রির ব্যবসা। ডোমিনিকান ফ্রায়ার জোহান টেটজেল প্রচারে বলেছিলেন, As soon as the coin in the coffer rings, the soul from purgatory springs. এই ভয়াবহ দুর্নীতির বিরুদ্ধেই ১৫১৭ সালে মার্টিন লুথার জার্মানির উইটেনবার্গ চার্চের দরজায় তাঁর বিখ্যাত Ninety-Five Theses টাঙিয়ে দেন (Weimar Ausgabe, Vol. 1, p. 233–238)। তিনি লিখেছিলেন, “They preach only human doctrines who say that as soon as the money clinks into the money chest, the soul flies out of purgatory.” এভাবেই শুরু হয় প্রোটেস্ট্যান্ট রিফর্মেশন, যা চার্চতন্ত্রের কফিনে প্রথম পেরেক গাঁথে।

নারীর প্রতি চার্চের দৃষ্টিভঙ্গিও ছিল অবর্ণনীয়ভাবে হীন। St. Augustine তাঁর De Genesi ad Litteram (Vol. 11, ch. 42)-এ লিখেছিলেন, “Woman is the gateway of the devil.” চার্চ বিশ্বাস করত, নারীই শয়তানের প্রধান দূত, যে মানুষকে পাপে নিমজ্জিত করে। এই ধারণা থেকেই শুরু হয় “Witch Hunt” যেখানে লক্ষাধিক নারীকে ডাইনী বলে হত্যা করা হয়। European Witch Trials Database (University of Trier, 2020) অনুযায়ী, ১৫৮০ থেকে ১৬৩০ সালের মধ্যে জার্মানির বাভারিয়া ও ওয়ুর্টেমবার্গ অঞ্চলে অন্তত ২৫,০০০ নারীকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়। এই হত্যাযজ্ঞ ছিল চার্চের অনুমোদিত “Holy Purge”।

চার্চ শুধু সমাজ ও জ্ঞান নয়, শিল্প ও সাহিত্যকেও দমন করেছিল। ১৫৫৯ সালে ভ্যাটিকান প্রকাশ করে Index Librorum Prohibitorum ব বইয়ের নিষিদ্ধ তালিকা। সেখানে উল্লেখ ছিল: “All works containing heretical doctrines are to be absolutely prohibited.” দান্তে আলিগিয়েরির De Monarchia থেকে শুরু করে গ্যালিলিওর Dialogue Concerning the Two Chief World Systems সবই নিষিদ্ধ করা হয়। ১৫৪৫–১৫৬৩ সালের Council of Trent ঘোষণা দেয়, শিল্পে কেবল বাইবেলীয় চরিত্র বা ঈশ্বরীয় পবিত্রতা থাকতে হবে। মানবদেহের নগ্ন চিত্রায়ণ বা প্রকৃতির রূপচিত্রকেও “পাপ” ঘোষণা করা হয়।

রাজনীতি থেকেও চার্চ নিজেকে সরিয়ে রাখেনি। ১০৭৬ সালে জার্মান সম্রাট হেনরি চতুর্থ (Henry IV) যখন পোপ গ্রেগরি সপ্তমের বিরুদ্ধে দাঁড়ান, পোপ তাকে বহিষ্কার করে দেন। তখন হেনরি বাধ্য হয়ে বরফে তিন দিন দাঁড়িয়ে ক্ষমা ভিক্ষা করেন। এই ঘটনাই ইতিহাসে পরিচিত “Walk to Canossa” নামে (Liber Pontificalis, Vol. III, p. 112–118)। এতে স্পষ্ট হয়, পোপ ছিলেন রাজাদের রাজা। এমনকি ইউরোপের প্রায় ৩০–৪০% জমির মালিকও ছিল চার্চ। কৃষকদের উৎপাদনের দশমাংশ দিতে হতো “Tithe Tax” হিসেবে। ধর্ম ছিল কেবল বিশ্বাস নয়, বরং অর্থনৈতিক শোষণের হাতিয়ার।

এই ভয়াবহ চার্চীয় শাসনব্যবস্থা ইউরোপকে শতাব্দীর পর শতাব্দী পিছিয়ে দেয়। যখন বাগদাদ, দামেস্ক, কর্ডোভা, কায়রো ও সমরখন্দে মুসলিম বিজ্ঞানীরা পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্বিজ্ঞান, চিকিৎসা, রসায়ন ও দর্শনে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছিলেন। ইউরোপ তখন আগুনে মানুষ পোড়াচ্ছিল “ঈশ্বরের নামে।” চার্চ বলত, “The Earth is flat,” অথচ মুসলিম বিজ্ঞানী আল-বিরুনি (৯৭৩–১০৪৮) তাঁর Al-Qanun al-Masudi-তে পৃথিবীর ব্যাস ও ঘূর্ণনের হিসাব নির্ভুলভাবে নির্ধারণ করেছিলেন। ইবনে সিনা, আল-রাজি, আল-হাযেন তাঁরা তখন মানবসভ্যতার আলোকবর্তিকা, কিন্তু ইউরোপীয় চার্চ তাদের কাজকে “heretical Arab philosophy” বলে নিন্দা করত (Ref: Vatican Commentaries on Aristotle, 1325, Manuscript 88B)।

১৫শ শতকের পর যখন ইউরোপ উপনিবেশ বিস্তার শুরু করে, তখন তারা নিজেদের অন্ধকার ইতিহাস মুছে ফেলতে একটি কৌশল নেয় “Medieval Barbarism” শব্দবন্ধটি ইসলামী সভ্যতার সঙ্গে জুড়ে দেয়। এভাবেই ইতিহাসের দায় স্থানান্তরিত হয়। এডওয়ার্ড সাঈদ Orientalism (1978, p. 69)-এ লিখেছিলেন, “Europe projected its own dark medieval past upon the East, especially upon Islam, to claim moral superiority.” অর্থাৎ ইউরোপ নিজেদের অপরাধ ঢাকতে ইসলামকে বানিয়েছে “অন্ধকার যুগের প্রতীক।”

কিন্তু দলিল বলে ভিন্ন কথা। Bertrand Russell তাঁর A History of Western Philosophy (1945, p. 409)-এ স্পষ্ট লিখেছেন, “From the fifth to the fifteenth century, Europe was sunk in ignorance and superstition, largely due to the tyranny of the Church.” এই স্বীকারোক্তিই প্রমাণ করে, তথাকথিত ‘মধ্যযুগীয় বর্বরতা’র দায় ইসলাম নয়, বরং ইউরোপীয় চার্চের অন্ধ শাসন।

যে সময় ইউরোপ জ্বলছিল পোপের আগুনে, সে সময় কর্ডোভায় রাত জেগে আল-জাহরাওয়ি অস্ত্রোপচার শেখাচ্ছিলেন; বাগদাদে আল-খওয়ারিজমি বীজগণিতের জন্ম দিচ্ছিলেন; দামেস্কে ইবনে আল-নাফিস মানব রক্ত সঞ্চালনের তত্ত্ব দিচ্ছিলেন। ইতিহাসের সেই আলোকিত সভ্যতাকেই পশ্চিমা ইতিহাস “মধ্যযুগীয় বর্বরতা” বলে বদনাম করছে! এ যেন চোর নিজেকে সাধু প্রমাণ করতে প্রকৃত সাধুকে চোর ঘোষণা করেছে।

আজ তাই ইতিহাসকে নতুন করে পড়ার সময় এসেছে। “মধ্যযুগীয় বর্বরতা” মানে ইসলামী সভ্যতা নয় বরং ইউরোপের চার্চীয় অন্ধকার, যেখানে মানবতা, জ্ঞান ও স্বাধীনতার শ্বাসরোধ করা হয়েছিল “ঈশ্বরের নামে।” সত্যিকারের আলোর উৎস ছিল তখন ইসলামি বিশ্ব, আর বর্বরতার প্রতীক ছিল খ্রিস্টীয় ইউরোপ। ইতিহাসের নথি, আর্কাইভ ও দার্শনিক রচনাই আজ সেই সত্যের সাক্ষী। খেয়াল করলে দেখা যায়- ইসলামের কোন কোন ধারা চার্চের সেইসব গোঁয়ার্তুমি চর্চা শুরু করেছে। যাদের কাছে কেবলই ডলার আর ভোগ বিলাস আছে কিন্তু জ্ঞান-গবেষণা নেই।

লেখক: ইতিহাস, রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক

পার্সটুডে/এমএআর/৫