'পাশ্চাত্য ইরানের শক্তি ও স্বাধীনতার বিরোধী'
https://parstoday.ir/bn/news/event-i153902-'পাশ্চাত্য_ইরানের_শক্তি_ও_স্বাধীনতার_বিরোধী'
পার্সটুডে- ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ীর মতামত ও চিন্তাধারার আলোকে "আমরা ও পাশ্চাত্য” শীর্ষক সম্মেলনের সমাপনী অনুষ্ঠান আজ (সোমবার) রাজধানী তেহরানে সম্পন্ন হয়েছে। ইরানের জাতীয় রেডিও ও টেলিভিশন সংস্থার আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত এই সম্মেলনে বহু বিশিষ্ট চিন্তাবিদ, অধ্যাপক ও গবেষক অংশ নিয়েছেন।
(last modified 2025-11-11T14:44:42+00:00 )
নভেম্বর ১০, ২০২৫ ২০:৫৪ Asia/Dhaka
  • আমরা ও পাশ্চাত্য সম্মেলনের ছবি
    আমরা ও পাশ্চাত্য সম্মেলনের ছবি

পার্সটুডে- ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ীর মতামত ও চিন্তাধারার আলোকে "আমরা ও পাশ্চাত্য” শীর্ষক সম্মেলনের সমাপনী অনুষ্ঠান আজ (সোমবার) রাজধানী তেহরানে সম্পন্ন হয়েছে। ইরানের জাতীয় রেডিও ও টেলিভিশন সংস্থার আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত এই সম্মেলনে বহু বিশিষ্ট চিন্তাবিদ, অধ্যাপক ও গবেষক অংশ নিয়েছেন।

ইরানের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সচিব ড. আলী লারিজানি অনুষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি ইরান ও পশ্চিমের ঐতিহাসিক সম্পর্কের প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে বলেন, ইতিহাসজুড়ে ইরান ও পাশ্চাত্যের সম্পর্ক নানা কারণে উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গেছে, এসব কারণের মধ্যে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামরিক দিকও ছিল। এটাকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অন্যতম অস্থির ও জটিল অধ্যায় হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে।

লারিজানি ইরান-পাশ্চাত্য এই সম্পর্ককে পাঁচটি ঐতিহাসিক পর্বে ভাগ করে বলেন, প্রথম পর্বটি ছিল প্রাচীন যুগ, যখন ইরান আকেমেনীয়, পার্থীয় ও সাসানীয় রাজবংশের অধীনে একটি শক্তিশালী সভ্যতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। পৃথিবীর অপর প্রান্তে অর্থাৎ পাশ্চাত্যে তখন ছিল গ্রিক ও রোমান সভ্যতা। সেই সময় এই দুই বৃহৎ সভ্যতা বিশ্বশক্তির কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হতো।

তিনি আরও বলেন, সে সময় ইরান রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, পাশ্চাত্য কখনোই এর ওপর স্থায়ী আধিপত্য বিস্তার করতে পারেনি। যদিও দুই পক্ষের মধ্যে কিছু যুদ্ধ হয়েছিল, তবে কোনো যুদ্ধই পাশ্চাত্যের জন্য স্থায়ী বিজয়ে পরিণত হয়নি।

ড. আলী লারিজানি পশ্চিমের আধিপত্যবাদী প্রবণতার ঐতিহাসিক শিকড় সম্পর্কে বলেন, প্রাচ্যে মুসলিম দেশগুলো ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে ইরানের জোরালো বাণিজ্যিক সম্পর্ক থাকার সময়ও বহু বছর ধরে পাশ্চাত্য ছিল ইরানের প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদার। কিন্তু তাদের রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাগত আধিপত্যবাদী আচরণই এই সম্পর্ককে সংকটে ফেলেছে।

তিনি ইসলামি বিপ্লব-পরবর্তী ইরানের সঙ্গে পাশ্চাত্যের আচরণের কথা উল্লেখ করে বলেন, ইরানের নেতারা কখনোই পশ্চিমের প্রতি প্রকাশ্যে বৈরিতা প্রদর্শন করেননি, বরং পশ্চিমই তার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আচরণের মাধ্যমে ইসলামি বিপ্লবকে টার্গেট করেছে। তারা ইরানের স্বাধীনতাকে নতুন স্লোগানের আড়ালে ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিল, কিন্তু ইমাম খোমেনী (রহ.)'র দৃঢ় অবস্থানের মুখে ব্যর্থ হয়।

লারিজানি আরও বলেন, পাশ্চাত্য সম্পর্কে ইরানের সর্বোচ্চ নেতার দৃষ্টিভঙ্গি সবসময় ভারসাম্যপূর্ণ। তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্যের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সতর্কতা বজায় রাখার পরামর্শ দিয়েছেন, কারণ তাদের স্বভাবই আধিপত্যবাদী। সর্বোচ্চ নেতা সবসময় বৈজ্ঞানিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা এবং কল্যাণকর প্রকল্পগুলোকে সমর্থন করেছেন, কিন্তু যখন পাশ্চাত্য তার অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামরিক ক্ষমতা ব্যবহার করে ইরানের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে চেয়েছে, তখন তিনি দৃঢ়ভাবে প্রতিরোধ করেছেন। ইরানের জনগণও সাম্প্রতিক যুদ্ধে একই দৃঢ়তা নিয়ে নিজেদের স্বাধীনতা রক্ষা করেছে।

ড. লারিজানি আরও বলেন, বিপ্লবের পর ইরানের জনগণ যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমের পক্ষ থেকে দেশের স্বাধীনতা দুর্বল করার সব প্রচেষ্টার বিপরীতে দৃঢ় প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে এবং সর্বোচ্চ নেতা দৃঢ়ভাবে এই ষড়যন্ত্রগুলো মোকাবিলা করেছেন।

লারিজানি বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্টের নীতির সমালোচনা করে বলেন: “শক্তির মাধ্যমে শান্তি” — এই স্লোগানটি বাস্তবে জাতির স্বাধীনতার প্রধান শত্রু হওয়ার প্রতীক। তিনি আন্তর্জাতিক নিয়ম-কানুন ভেঙে ক্ষমতাকে আইনের জায়গায় বসাতে চান। এই চিন্তার অর্থ হলো, দেশগুলো হয় আত্মসমর্পণ করবে, নয়তো যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকবে- ঠিক সেই নীতি যা পাশ্চাত্য বহু শতাব্দী ধরে অনুসরণ করেছে, আর ট্রাম্প কেবল সেটিকে প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছে।

তার মতে, এই নীতির ফল হলো আন্তর্জাতিক অরাজকতা বৃদ্ধি। যেমন ইরাক যুদ্ধ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন ছাড়াই শুরু হয়েছিল এবং একই পথ এখন ইরানের বিরুদ্ধেও অনুসরণ করা হচ্ছে। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সৃষ্টি করা ইসরায়েলি শাসনও একই বিশৃঙ্খল স্লোগান পুনরাবৃত্তি করছে। কিন্তু ইতিহাস প্রমাণ করেছে- যে অরাজকতা তারা সৃষ্টি করে, শেষ পর্যন্ত সেই অরাজকতার আগুন তাদেরই গ্রাস করে; যেমন আমেরিকা “দায়েশ (আইএস)” সৃষ্টি করেছিল, কিন্তু পরে নিজেই তার ফাঁদে পড়েছে।

লারিজানি সাম্প্রতিক যুদ্ধ প্রসঙ্গে বলেন, ইরানের জনগণের শক্তি ও সশস্ত্র বাহিনীর দৃঢ়তা শত্রুদের পিছু হটতে বাধ্য করেছে এবং তাদের দ্রুত যুদ্ধের ইতি টানার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে।

তিনি আরও বলেন, ইতিহাসে কখনোই বিশ্ব জনমতের কাছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইহুদিবাদী ইসরায়েলের চেহারা এত ঘৃণিত ও জঘন্য হয়ে দেখা দেয়নি। তাদের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড তাদের প্রকৃত ঔপনিবেশিক স্বভাবকে উন্মোচন করেছে।

জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সচিব যুক্তরাষ্ট্রের ভণ্ডামিপূর্ণ আলোচনার নীতি প্রসঙ্গে বলেন, তাদের আলোচনার উদ্দেশ্য ন্যায্য সমঝোতা নয়, বরং আত্মসমর্পণে বাধ্য  করা। ইরান কি আলোচনার মধ্যে ছিল না, যখন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ শুরু করল? এর চেয়ে লজ্জাজনক আর কী হতে পারে যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রকাশ্যে বলে বসেন- “আমি ইরানি জাতিকে ধোঁকা দিয়েছি”!

তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, যুদ্ধের প্রথম দিকের দিনগুলোতে শত্রুরা সামরিক চাপ ও ব্যাপক প্রচারযুদ্ধের মাধ্যমে জনগণকে হতাশ করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সর্বোচ্চ নেতা দৃঢ়তা ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জনগণের উদ্দেশে বক্তব্য দেন এবং শত্রুর পরাজয়ের সুসংবাদ দেন।

লারিজানি বলেন, যুদ্ধের প্রথম তিন দিন ছিল সবচেয়ে সংকটময় সময়, কিন্তু সর্বাধিনায়কের পরিকল্পনা এতটাই নিখুঁত ও দূরদর্শী ছিল যে, যুদ্ধের গতিপথ সম্পূর্ণ বদলে যায়। তিনি সরাসরি নেতৃত্ব দিয়েছেন, সেটা ছিল দৃঢ় ও অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট; তিনি ফ্রন্ট লাইনের প্রত্যেক কমান্ডারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন এবং জবাবের পদ্ধতি কেমন হবে সে বিষয়ে নির্দেশনা দিতেন।

তিনি আরও বলেন, সর্বোচ্চ নেতার প্রজ্ঞাপূর্ণ নেতৃত্ব যুদ্ধক্ষেত্রের পাশাপাশি সব দিককে অন্তর্ভুক্ত করেছিল, যেমন যুদ্ধ-ফ্রন্টের পেছনের পরিস্থিতি, সরবরাহ ব্যবস্থা বিশেষ করে জনগণের জীবনযাত্রা যেন ব্যাহত না হয়, সে বিষয়েও তিনি নিবিড়ভাবে তদারকি করেছেন।

সম্মেলনে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতার কর্ম-কীর্তি সংরক্ষণ ও প্রকাশনা দপ্তরের গবেষণা বিষয়ক উপপ্রধান ড. মোহাম্মদ ইসহাকী বলেন, ইরানের সর্বোচ্চ নেতার জীবনধারা ও চিন্তাধারা কুরআনের দিকনির্দেশনা এবং আল্লাহর বিধানসমূহের ওপর প্রতিষ্ঠিত। ইরান এর ভিত্তিতেই বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকট এবং চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আধিপত্য ও সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থাকে পশ্চিমা সভ্যতার প্রকৃত রূপ হিসেবে তুলে ধরেছেন, যে ব্যবস্থা জাতিগুলোকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করার চেষ্টা করছে, কিন্তু ইসলামী বিপ্লবের কুরআনী নেতৃত্বের কাছে পরাজিত হয়েছে।

সম্মেলনের বিজ্ঞান বিষয়ক সচিব মুসা হাক্কানিও এই সম্মেলনে বক্তব্য রেখেছেন। তিনি বলেছেন, আমরা আজ ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে অবস্থান করছি। এই সম্মেলনের উদ্দেশ্য হলো সর্বোচ্চ নেতার দৃষ্টিকোণ থেকে এই পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিকে বিশ্লেষণ করা। আসলে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার পরিবর্তনের সময় এবং এক নতুন ঐতিহাসিক মোড়ের সূচনাকালে এই আয়োজন করা হয়েছে। 

তিনি বলেন, গত দুই বছরে সংঘটিত ঘটনাবলি এবং আসন্ন পরিবর্তনগুলো এই আন্তর্জাতিক রূপান্তরেরই অংশ। আল-আকসা তুফান অভিযান, ১২ দিনের যুদ্ধ, রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত, আমেরিকা-চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং মার্কিন প্রেসিডেন্টের আধিপত্যবাদী নীতি—সবই বিশ্ব ব্যবস্থায় গভীর পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করছে।

হাক্কানি বলেন, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা অন্তত এক হাজার বছরের পুরনো শিয়া বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী। তিনি ইতিহাসের দক্ষ গবেষক, তিনি ইরান, পাশ্চাত্য ও ইউরোপের ইতিহাস গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছেন। তিনি প্রায় ৬০ বছর ধরে পশ্চিমের প্রভাবের বিরুদ্ধে সংগ্রামের অগ্রভাগে রয়েছেন এবং ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে একটি বিপ্লব, একটি বিপ্লবী রাষ্ট্র এবং প্রতিরোধ ফ্রন্টের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।#

পার্সটুডে/এসএ/১০

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।