জাগরোস পর্বতমালায় লুকিয়ে থাকা 'কাফরি প্রণালি' ইরানের এক অজানা রত্ন
-
কাফরি প্রণালি, ইলাম, ইরান।
পার্সটুডে: পশ্চিম ইরানের ইলাম প্রদেশের এক নির্জন কোণে অবস্থিত 'তাঙ-এ কাফরি' বা কাফরি প্রণালি তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও প্রাচীন ইতিহাসের জন্য পরিচিত। এটি একটি অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর কিন্তু তুলনামূলকভাবে অল্প-পরিচিত অঞ্চল, যা এখনও পর্যটকদের কাছে এক রহস্যময় গন্তব্য।
এই গিরিখাত ঘিরে রয়েছে ঘন ওক বৃক্ষরাজি যার ডালপালা মাথার ওপর একটি সবুজ ছাউনি তৈরি করে, সূর্যের আলো বনের মেঝেতে ছড়িয়ে দিয়ে বিরল উদ্ভিদ ও প্রাণীর বাস্তুতন্ত্রকে লালন করে। এখানে গড়ে উঠেছে বিরল উদ্ভিদ ও প্রাণীর বাসস্থান। হাজার হাজার বছরের পানি ও সময়ের ছোঁয়ায় খোদাই হয়ে সৃষ্টি হয়েছে এই গিরিখাত, যাকে বলা হয় “জাগরোসের কন্যা”।
কাফরি প্রণালির যাত্রা শুরু হয় বাদরেহ শহর থেকে, যা ইলাম থেকে ৮০ কিলোমিটার এবং প্রদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় দার্রেহ শাহর থেকে ৩৮ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। নিকটতম শহুরে এলাকা ওয়ালিআসরের ঠিক উত্তরে তাং-ই কাফারির প্রবেশপথ অবস্থিত, যা হয় একটি দুর্গম পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে অথবা সেমারেহ বাঁধের হ্রদ নৌকা দিয়ে পার হয়ে পৌঁছানো যায়।
নৌপথে গেলে গিরিখাতের হৃদয়ে পৌঁছানোর অভিজ্ঞতা হয় একেবারে নাটকীয়। চারপাশে সুউচ্চ চুনাপাথরের দেয়াল, মাথার ওপর ঘন ওক বন, এবং নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া সৈমারেহ নদী—সব মিলিয়ে এক অতুলনীয় দৃশ্য।

প্রাচীন সভ্যতার পদচিহ্ন
কাফরি প্রণালি অঞ্চলে খননকার্যে বেরিয়ে এসেছে নিওলিথিক যুগ, সাসানিদ যুগ ও লৌহ যুগের নিদর্শন—যেমন ধনুকাকৃতি স্তম্ভ, প্লাস্টার অলংকরণ, প্রাচীন ধাতব বস্তু ও মৃৎপাত্র। এই সব নিদর্শনগুলো প্রমাণ করে, এখানে অন্তত ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মানববসতি গড়ে উঠেছিল।
সম্প্রতি, সৈমারেহ বাঁধের পানির স্তর কমে যাওয়ার পর এক বিশাল সাসানিদ স্থাপত্য আবিষ্কৃত হয়েছে। শাদ্দাদ প্রণালি অঞ্চলে পাওয়া যায় পুরোনো পাথরের সারি এবং প্রাচীন ব্রোঞ্জ যুগের মৃৎপাত্র, যা একসময় এখানে গড়ে ওঠা জনবসতির ইতিহাস তুলে ধরে।
জীবন্ত বন, প্রাণের ছোঁয়া
কাফরি প্রণালির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য এর জীববৈচিত্র্যপূর্ণ বনভূমি। বিশেষ করে এখানে দেখা যায় পারস্য স্কুইরেল নামের ছোট, লালচে বাদামী কাঠবিড়ালি, যারা ওক গাছের ডালে বসবাস করে। বসন্তকালে মা কাঠবিড়ালিদের তাদের ছানাদের নিয়ে গাছ বেয়ে চলাফেরা করার দৃশ্য জঙ্গলের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে তোলে। এই বনাঞ্চল শহরের প্রভাব থেকে মুক্ত এবং ইরানের অন্যতম প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য সংরক্ষিত অঞ্চল হিসেবে পরিচিত।
ধর্ম ও স্থাপত্যের ছোঁয়া
গিরিখাতের আশেপাশে ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক স্থাপনা। এর মধ্যে অন্যতম হলো কালাম আগুন মন্দির, যা দুটি সবুজ পাহাড়ের মাঝে অবস্থিত এবং ইরানের জাতীয় ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকাভুক্ত। এটি একটি প্রাচীন জরথুস্ট্রীয় উপাসনালয়, যা ইলাম শহর থেকে প্রায় ১২০ কিমি দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। এছাড়া শাদ্দাদ গুহা, যেটি আংশিকভাবে পানিতে ডুবে গেছে, এখনো প্রাচীন সংস্কৃতির নিদর্শন বহন করে চলেছে। এই গুহাটি একসময় আশ্রয় বা উপাসনার স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হতো বলে ধারণা করা হয়।
গিরিখাতের শেষে দেখা মেলে বারে হালে বাঁধের, একটি প্রাচীন পানি ব্যবস্থাপনার প্রকৌশল কাঠামো। বিকেলের আলোয় যখন সূর্য পাহাড়ের পেছনে মিলিয়ে যায়, তখন বাঁধের ছায়া নদীর জলে পড়ে এক অপূর্ব দৃশ্য তৈরি করে।

প্রকৃতির রূপ পরিবর্তন করে ঋতু অনুযায়ী
কাফরি প্রণালি এলাকায় ঋতুভেদে দৃশ্যপট বদলায়। শীত ও শরতে কুয়াশা ও ঠাণ্ডায় আবৃত থাকে উপত্যকা, আর বসন্তকালে (মার্চ–মে) গড়ে ওঠে প্রকৃতির সবচেয়ে রঙিন দৃশ্যাবলি—বনভূমিতে ওক গাছের পাতা গজায়, বুনো ফুলে ভরে যায় উপত্যকা, নদীর পানির স্তর হয় অনুকূল।
এক অনাবিষ্কৃত বিস্ময়
আজকের বিশ্ব যেখানে নগরায়ণ ও পরিবেশ বিপর্যয়ে বিপর্যস্ত, সেখানে কাফরি প্রণালি দাঁড়িয়ে আছে এক নিখুঁত সৌন্দর্য ও প্রাচীন ঐতিহ্যের নিদর্শন হিসেবে। শহরের কোলাহল থেকে দূরে, প্রচলিত পর্যটন মানচিত্রের বাইরে এই গিরিখাত উপহার দেয় ইরানের ভূতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক আত্মার এক নির্ভেজাল স্পর্শ।
নৌকায় গিরিখাতের ভেতর দিয়ে যাওয়া হোক, কিংবা পায়ে হেঁটে ওক-বনে ঘেরা পথ অতিক্রম করা—তাঙ-এ কাফরি প্রতিবারেই নতুন করে বিস্ময় জাগায়। কারণ এখানে পাথর, পানি ও সময় একে অপরের সঙ্গে চিরন্তন সংলাপে মিলিত হয়।#
পার্সটুডে/এমএআর/৫