‘গোপন পম্পেই’ খ্যাত সেইমেরেহ শহর : প্রাচীন ইরানের এক জাদুময় জানালা
পার্সটুডে: সেইমেরেহ, ইরানের ইলাম প্রদেশে অবস্থিত একটি প্রাচীন শহর, যা এক সময় 'মাদাক্তু' নামে পরিচিত ছিল। এলামীয় সভ্যতা থেকে সাসানিয় শাসনামল পর্যন্ত নানা ঐতিহাসিক স্তরের ছাপ রয়েছে এই শহরে। এখানে রয়েছে সংরক্ষিত প্রাসাদ, অগ্নিমন্দির, কারখানা, ইসলামের প্রাথমিক যুগের মসজিদের ধ্বংসাবশেষও।
প্রেস টিভির বরাত দিয়ে পার্সটুডে জানিয়েছে, ১০ম শতকের একটি বিধ্বংসী ভূমিকম্প যেন সময়কে থামিয়ে দেয়, মাটির নিচে চাপা পড়ে যায় এই সমৃদ্ধ শহরটি—যেমনটা হয়েছিল রোমান নগরী পম্পেইয়ের সঙ্গে। এর ফলে আজও অনবদ্যভাবে সংরক্ষিত রয়েছে সেইমেরেহ'র প্রাচীন রাস্তাঘাট ও ভবনের ধ্বংসাবশেষ। পুরাতাত্ত্বিকদের মতে, নগরীর বিস্তার ছিল প্রায় ১৪২ থেকে ২০০ হেক্টর পর্যন্ত—ইলাম প্রদেশে এটিই বৃহত্তম প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান।
মাদাক্তু থেকে সেইমেরেহ
সেইমেরেহ নগরীর ইতিহাস আরও প্রাচীন। একে এক সময় ‘মাদাক্তু’ বলা হতো—এটি ছিল এলামীয় শাসনব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজধানী। খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতকে এটি আসিরীয়দের হাতে ধ্বংস হয়। কিন্তু ধ্বংসই এর শেষ ছিল না।
পরবর্তী সময়ে সাসানিয়ান সাম্রাজ্যের অধীনে নতুন করে গড়ে ওঠে এই নগরী—নতুন নাম হয় সেইমেরেহ। এই নবনির্মিত নগরীতে দেখা যায় চওড়া রাস্তা, বাজারঘাট, অলঙ্কৃত ভবন, উন্নত জলনিকাশী ব্যবস্থা এবং সুপরিকল্পিত নগরায়ন।

ভূমিকম্পে থেমে যায় এক যুগ
সেইমেরেহর গৌরবময় অধ্যায় শেষ হয়ে যায় হিজরি ৩৩৪ সালে (৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ), একটি বিধ্বংসী ভূমিকম্পের মাধ্যমে। ঐতিহাসিক দলিল ও ভূতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে জানা যায়, এই ভূমিকম্পে নগরীর বেশিরভাগ অংশ ধ্বংস হয়ে যায়।
পুরাতাত্ত্বিকরা ধারণা করছেন, ভূমিকম্পের আগেই অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক কারণে মানুষজন সেইমেরেহ ছেড়ে চলে যেতে শুরু করেছিল। নগরীর আকস্মিক ধ্বংস এবং সংরক্ষণের নিদর্শন দেখে একে অনেকেই ‘ইরানের গোপন পম্পেই’ নামে আখ্যা দিয়েছেন।

ইতিহাসের ধুলোমাটির নিচে চাপা এক শহর
সেইমেরেহর প্রাচীন নিদর্শন প্রথম গবেষকদের নজরে আসে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে। হেনরি রলিনসন, জ্যাক দ্য মর্গান এবং হলমস প্রত্নতাত্ত্বিক মিশনের মতো গবেষকেরা এ স্থান ঘুরে গেছেন। পরবর্তীকালে পরিচালিত ৯ দফা খনন কার্যক্রমে বের হয়ে এসেছে বহু অমূল্য ধ্বংসাবশেষ।
এর মধ্যে রয়েছে ইরানের অন্যতম প্রাচীন একটি মসজিদ, সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি বা অভিজাতের আবাসস্থল, মৃৎশিল্প ও কাঁচ উৎপাদনের কর্মশালা, বন্যা প্রতিরোধব্যবস্থা এবং প্রাচীন প্লাস্টার শিল্পকর্ম।
বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হলো শহরের শিল্প কাঠামো। এখানে পাওয়া কাঁচ ও মৃৎশিল্প তৈরির চুল্লি প্রমাণ করে যে, সেইমেরেহ শুধু একটি রাজনৈতিক কেন্দ্রই ছিল না, বরং এটি ছিল কারুশিল্প ও বাণিজ্যের এক প্রাণকেন্দ্র। এসব নিদর্শন শহরটির আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সাথে গভীর সংযোগের ইঙ্গিত দেয়।
বিশ্ব ঐতিহ্যের পথে সেইমেরেহ
১৯৩১ সালেই সেইমেরেহ ইরানের জাতীয় ঐতিহ্য তালিকাভুক্ত হয়। বর্তমানে ইরান সরকার সেইমেরেহ এবং কাবির কুহ সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটকে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

পর্যটকদের জন্য, সেইমেরেহ একটি বিরল অভিজ্ঞতা
একটি শহরের কাঠামোর মধ্য দিয়ে হাঁটা যা একটি সহস্রাব্দ ধরে নীরব। এছাড়াও মারবরেহের মতো জলপ্রপাত এবং বাহরাম চুবিনের মতো দর্শনীয় গিরিখাতগুলো এমন একটি স্থানের সম্পূর্ণ চিত্র উপস্থাপন করে যেখানে ইতিহাস এবং প্রকৃতি পরস্পর যুক্ত হয়।
প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্যও এটি স্বর্গরাজ্য। বসন্তকালে পাহাড়ি উপত্যকাগুলোয় ফোটে ফ্রিটিলারিয়া ইমপেরিয়ালিস ফুল, যাকে ইরানের মুকুটফুল বলা হয়। কাবির কুহ পর্বতের পাথুরে ঢালে দাঁড়িয়ে থাকা এই ফুল যেন ইতিহাস ও প্রকৃতির মিলনস্থল হয়ে দাঁড়ায়। মারবারেহ জলপ্রপাত ও বাহরাম চুবিন নামের প্রাকৃতিক গিরিখাতও যোগ করে সৌন্দর্যের আরেক মাত্রা।#
পার্সটুডে/এমএআর/৭