ডিসকভার ইরান:
ইস্ফাহান: যেখানে প্রতিটি খাবারে জড়িয়ে আছে ইতিহাসের সুঘ্রাণ
পার্সটুডে: ইরানের মধ্যাঞ্চলীয় প্রদেশ ইস্ফাহানের বাতাসেই যেন মিশে আছে জাফরান আর ভুনা গোশতের মিশ্র সুবাস। এই মোহনীয় ঘ্রাণই যেন ডাক দেয় ঐতিহ্যবাহী পদ 'বিরিয়ানি'র।
সোনালি রঙে রাঙানো গোশত, জাফরান ও দারুচিনির মনমাতানো গন্ধ, সঙ্গে গরম সাঙ্গাক রুটি ও তাজা 'সবজি-খোরদান' (মূলা, পেঁয়াজপাতা ও সুগন্ধি শাকসবজির ঝুড়ি)—এসব মিলে তৈরি হয় এক অনন্য রন্ধন অভিজ্ঞতা, যা কেবল খাওয়ার আনন্দ ছাড়িয়ে এক সাংস্কৃতিক ভ্রমণ।
খাবারটি ধারণ করে ইস্ফাহানের গৌরবময় ইতিহাস, বিস্ময়কর সংস্কৃতি এবং এখানকার মানুষের দীর্ঘস্থায়ী রন্ধনশৈলীর প্রতি ভালোবাসা।
ইরানের খাবার বরাবরই তার সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতিফলন। এ খাবার মানুষের ভূগোল, ইতিহাস ও পরিচয়কে ধারণ করে। এই রন্ধন ঐতিহ্যের ভাণ্ডারে ইস্ফাহান বিশেষভাবে আলাদা, যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পর্যটকদের আকর্ষণ করে আসছে।
ইস্ফাহানের সুগন্ধি শাক-সবজি, হাতে গুঁড়ো করা মশলা এবং শতাব্দী প্রাচীন রেসিপি ভ্রমণকারীদেরকে এমন একটি শহর অন্বেষণের সুযোগ দেয়, যার খাবারটি তার ইউনেস্কো স্বীকৃত স্থাপত্যের মতোই জটিল ও শৈল্পিক।

স্থানীয় স্বাদ: ইস্ফাহানের সংস্কৃতির দ্বারপ্রান্ত
ইস্ফাহানের খাবার শহরের সমৃদ্ধ সংস্কৃতির প্রবেশদ্বার। ঐতিহ্যবাহী রান্না এখানে প্রতিফলিত করে ভূগোল ও ইতিহাসকে—মরুভূমির আবহাওয়া থেকে শুরু করে পারস্য সাম্রাজ্যের বিস্তৃত বাণিজ্যপথ, যা নিয়ে এসেছে নানা রকম মশলা, শাকসবজি ও উপাদান।
পায়েসসদৃশ স্টু বা ঘন তরকারি এবং হৃদয়গ্রাহী গোশতের খাবার, যা প্রায়শই তাজা রুটির সাথে পরিবেশন করা হয়, এখানকার রন্ধনপ্রণালীর প্রাধান্য বিস্তার করে। এই খাবারগুলো শহরের পরিচয়, যা পর্যটকদেরকে নিমজ্জনশীল উপায়ে স্থানীয় জীবনের সাথে যুক্ত হওয়ার একটি সুযোগ দেয়।
আজকাল শহরের খাবার ক্রমশ সৃজনশীল পর্যটনের অংশ হয়ে উঠেছে। ভ্রমণকারীরা যোগ দিচ্ছেন ফুড ওয়ার্কশপে, দেখছেন ঐতিহ্যবাহী রান্নাঘরে খাবার তৈরির কৌশল, আর চেখে দেখছেন শতাব্দীপ্রাচীন রেসিপিতে তৈরি পদ।
ফলে খাবার আর পণ্য নয়—এখন এটি সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা, যেখানে ভ্রমণকারীরা উপলব্ধি করেন প্রতিটি রেসিপির পেছনের দক্ষতা, ধৈর্য ও শিল্পকলা।
বাজার ও পথঘাট: ইস্ফাহানের রান্নার হৃদস্পন্দন
ইস্ফাহানের সরগরম বাজার যেন ইন্দ্রিয়ের উৎসব। ঐতিহ্যবাহী বাজারের গলিতে, মশলাগুলো রঙিন স্তূপে সাজানো থাকে, ইটের চুলা থেকে তাজা রুটির গন্ধ ভেসে আসে এবং বিক্রেতারা বিরিয়ানি, কুকু কান্দি এবং অন্যান্য সুস্বাদু খাবারের নমুনা নিয়ে ডাকাডাকি করে।
ঐতিহাসিক আর্মেনীয় কোয়ার্টার জুলফার বাজার তার সুগন্ধি পণ্য যেমন জাফরান ও শুকনো ফল থেকে বাদাম ও সুগন্ধি ভেষজের জন্য বিশেষভাবে বিখ্যাত, যা দর্শনার্থীদেরকে ইস্ফাহানের রন্ধনসম্পর্কিত ঐতিহ্যের প্রত্যক্ষ স্বাদ প্রদান করে।
মুখ্য সড়ক থেকে দূরে ছোট্ট খাবারের দোকানে মেলে দীর্ঘকালীন খাবার যেমন “কালেহ জোশ” ও “ইয়াখমে তোরশ।”
এসব খাবার আজকাল খুব কম ঘরেই রান্না হয়, ফলে পর্যটকরা এর মাধ্যমে পান একেবারে আসল স্বাদ—শহরের নিত্যদিনের জীবন আর ঐতিহাসিক খাদ্য ঐতিহ্য।
ইস্ফাহানের রন্ধনের আত্মা
'বিরিয়ানি' হলো শহরের প্রতীকী খাবার। কিমা করা খাসির গোশত, জাফরান, পুদিনা, পেঁয়াজ ও দারচিনি দিয়ে বানানো এই খাবার বাদাম দিয়ে সাজানো হয়। সাধারণত সাঙ্গাক রুটি ও তাজা শাকসবজির সঙ্গে খাওয়া হয়। এর সঙ্গে থাকে এক বাটি “আবগোশত”—খাসির স্টু। শতাব্দীপ্রাচীন এই খাবারের গাঢ় স্বাদ ও আলাদা রূপ এটিকে ভ্রমণকারীদের জন্য অপরিহার্য করে তুলেছে।
'খোরেশ্ত মস্ত' বা দই-স্টু হলো ঠান্ডা ডেজার্ট, যা তৈরি হয় খাসির গোশত, ফেটানো দই, জাফরান ও চিনি দিয়ে। টক-মিষ্টি স্বাদের অনন্য মিশ্রণ এটিকে ইরানের প্রচলিত ডেজার্ট থেকে আলাদা করেছে।
'ইয়াখমে তোরশ'—চাল, খাসির গোশত, এপ্রিকট, বেল ও খেজুর সিরাপ বা চিনি দিয়ে রান্না করা টক-মিষ্টি স্টু। অ্যানিমিয়া ও হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী বলে এটি প্রচলিত ছিল। ধৈর্য ও যত্নের প্রক্রিয়াই এই খাবারের পরিচয়।
'কুকু কন্দি' হলো আলুভিত্তিক ডেজার্ট—আলু, ডিম, গোলাপজল, জাফরান, চিনি ও লেবুর রসের সংমিশ্রণ—যা এক কোমল সুবাস ও স্মৃতিময় স্বাদ এনে দেয়।
কাচি হাফত দোখতারুন- একটি সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ ডেজার্ট, যা কিংবদন্তির সঙ্গে জড়ানো। বলা হয়, মঙ্গলবারে সাত মেয়ে মিলে এটি তৈরি করত। গমের আটা, পিস্তাবাদাম, কাজুবাদাম ও গোলাপজল দিয়ে বানানো এই খাবারটি সুফলে-সদৃশ টেক্সচার ও মোলায়েম সুবাসের কারণে ঐতিহ্য ও গল্পের মিশেল বহন করে।
'কালেহ জোশ' এসেছে ইরানের যাযাবর গোষ্ঠী থেকে। বেগুন সেদ্ধ করে তাতে কাশ্ক (ওয়েহ), শুকনো পুদিনা, আখরোট ও পেঁয়াজ মিশিয়ে বানানো হয় এক স্যুপ, যা সহজ, পুষ্টিকর ও প্রতীকী। সাধারণত এটি খাওয়া হয় রুটির সঙ্গে—যাযাবর জীবনের সরাসরি স্বাদ।
ডুবে যাওয়া রন্ধন অভিজ্ঞতা
ইস্ফাহানে পর্যটকরা যোগ দেন ইন্টারেকটিভ ওয়ার্কশপ ও রান্না শেখার ক্লাসে, যেখানে তারা প্রত্যক্ষ করেন ও অংশ নেন ঐতিহ্যবাহী রান্নার প্রক্রিয়ায়। অংশগ্রহণকারীরা শিখে নেন মশলার সূক্ষ্ম মিশ্রণ, ময়দা মাখা কিংবা দীর্ঘসময় ধরে স্টু নাড়ার কৌশল—যা শহরের খাদ্য ঐতিহ্যের গভীর পরিচয় দেয়।
কেউ ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় দেন মিষ্টি তৈরির ওয়ার্কশপে—যেখানে স্থানীয় রাঁধুনিরা শেখান কুকু কন্দি বা কাচি হাফত দোখতারুন বানানো।
ঐতিহ্যবাহী রান্নাঘরে শাক কাটা, স্টু নাড়া ও পেস্ট্রি ভাঁজ করার শব্দে ভরে থাকে পরিবেশ—যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে আসা এক জীবন্ত ঐতিহ্যের অনুভূতি জাগায়।
প্রতিটি ইন্দ্রিয়ের অভিজ্ঞতা—জাফরানের সুবাস, ময়দার স্পর্শ—ভ্রমণকারীদের যুক্ত করে শহরের জীবন্ত ইতিহাসের সঙ্গে।
পর্যটন ধারা ও অংশগ্রহণ
ইস্ফাহানে পর্যটকরা স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক—দুই শ্রেণির। গবেষণায় দেখা যায়, স্থানীয় পর্যটকরা প্রায়ই তরুণ, যারা অনন্য অভিজ্ঞতা খুঁজে বেড়ায়। আন্তর্জাতিক পর্যটকরা তুলনামূলক বয়স্ক, যারা সাংস্কৃতিক নিমজ্জন ও আসল স্বাদে আকৃষ্ট হন।
পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, নারীরা খাদ্য নিরাপত্তা ও প্রাকৃতিক উপাদানকে বেশি গুরুত্ব দেন, আর পুরুষেরা জোর দেন স্বাদ ও নতুনত্বের ওপর। এসব ধারা ইস্ফাহানের সৃজনশীল রন্ধন পর্যটনকে প্রভাবিত করেছে।
ওয়ার্কশপ, বাজার ভ্রমণ ও হাতে-কলমে অভিজ্ঞতা এমনভাবে সাজানো হয় যাতে দেশি-বিদেশি ভ্রমণকারীরা সমানভাবে অংশ নিতে পারেন। এছাড়াও শহরে আয়োজিত হয় খাদ্য উৎসব ও গ্যাস্ট্রোনমিক ইভেন্ট। ছোট গ্রামীণ সমাবেশ থেকে শুরু করে নগরীর উৎসব—সবখানেই স্থানীয় স্বাদ, জাফরান চাষ, পেস্ট্রি বানানো আর ঐতিহ্যবাহী রেসিপি তুলে ধরা হয়।
ভ্রমণকারীরা এখানেই পান ইরানি শেফদের কাজ কাছ থেকে দেখার সুযোগ, শেখেন স্থানীয় কৌশল, এমনকি নিজেরাই রান্নায় হাত লাগান। এগুলো ভ্রমণকারীদের যুক্ত করে স্থানীয় উৎপাদক ও গৃহকর্ত্রীদের সঙ্গে, যেখানে জোর দেওয়া হয় ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততার ওপর।
উপসংহার
ইস্ফাহানের খাবার হলো জীবন্ত, শ্বাস-প্রশ্বাসময় এক সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও ইতিহাসের প্রকাশ। সৃজনশীল রন্ধন পর্যটন নিশ্চিত করে যে ভ্রমণকারীরা শুধু খাবেন না, বরং অংশ নেবেন, শিখবেন ও অনুভব করবেন সেই সব রীতি, স্বাদ ও শিল্পকলাকে, যা ইস্ফাহানকে সংজ্ঞায়িত করে।
শহরের বাজার, রান্নাঘর ও ওয়ার্কশপগুলোতে খাবার হয়ে ওঠে এক সংযোগের ভাষা—যা ভ্রমণকারীদের যুক্ত করে স্থানীয়দের সঙ্গে এবং অংশীদার করে তোলে শতাব্দীপ্রাচীন ঐতিহ্যে।
খাবারের মাধ্যমে ইস্ফাহান আবিষ্কার করা মানে শহরের অন্তরঙ্গ চেহারাকে দেখা, যেখানে প্রতিটি পদ বলে যায় একেকটি গল্প। যারা সত্যিকার অর্থে ইরানকে বুঝতে চান, তাদের জন্য ইস্ফাহানের সমৃদ্ধ রন্ধন ঐতিহ্যে নিমজ্জনই হতে পারে সবচেয়ে অন্তরঙ্গ ও স্মরণীয় অভিজ্ঞতা।#
পার্সটুডে/এমএআর/২৫