সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামের ইতিহাসে ১৩ অবন
(last modified Sat, 04 Nov 2017 10:03:27 GMT )
নভেম্বর ০৪, ২০১৭ ১৬:০৩ Asia/Dhaka
  • সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামের ইতিহাসে ১৩ অবন

ইরানের ইতিহাসে স্বৈরাচারী শাহ সরকার ও তার পৃষ্ঠপোষক সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার বিরুদ্ধে জনগণের সংগ্রামের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়েছেল ফার্সি বছরের ১৩ অবন।

ওই তিনটি ঐতিহাসিক ঘটনা হচ্ছে ইসলামি ইরানের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম খোমেনী (রহ.)’কে তুরস্কে নির্বাসন করা, ইসলামি বিপ্লব বিজয়ের আগ মুহূর্তে স্বৈরাচারী শাহ সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে বেশ কিছু ছাত্রের হতাহত হওয়া এবং বিপ্লবের পর 'গুপ্তচরবৃত্তির আখড়া' হিসেবে খ্যাত মার্কিন দূতাবাস দখল। এই তিনটি ঘটনায় ইরানি জনগণের বিপ্লবী চেতনার পাশাপাশি তাদের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী প্রবল মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে।  এখানে আমরা ফার্সি ১৩ অবনের বার্ষিকী উপলক্ষে ইরানি জনগণের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ইতিহাস নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করব।  

ইরানের ইসলামি বিপ্লবের ইতিহাসে ১৩ অবনের তিনটি ঘটনার মধ্যে মার্কিন দূতাবাস দখলের ঘটনা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব বহন করে। ফার্সি ১৩৫৭ সালের ১৩ অবন মোতাবেক ১৯৭৯ সালের নভেম্বর মাসে ইরানের একদল ছাত্র মার্কিন সরকারের ইরান বিরোধী ধারাবাহিক ষড়যন্ত্র রুখে দিতে তেহরানস্থ মার্কিন দূতাবাস দখল করে নেন। এর ফলে ইরানের মাটিতে বসে দেশটির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার পথ আমেরিকার জন্য বন্ধ হয়ে যায়। ইরানের ইতিহাসে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে বহুবার সংগ্রাম করেছে দেশটির জনগণ; যেগুলোর প্রতিটি সংগ্রামেরই আলাদা আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। এসব সংগ্রামের মধ্যে ১৯৫৩ সালে ইরানের তৎকালীন বৈধ সরকারের বিরুদ্ধে ইঙ্গো-মার্কিন ষড়যন্ত্রে সংঘটিত অভ্যুত্থান, ১৯৬৩ সালে স্বৈরাচারী শাহ সরকারের বিরুদ্ধে ইমাম খোমেনী (রহ.)’র নেতৃত্বে গণজাগরণ এবং ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের নাম উল্লেখ করা যায়।

স্বৈরাচারী শাহ সরকারের শাসনামলে ইরানের ওপর আমেরিকার প্রভাব এতটা বেশি ছিল যে, মার্কিন সরকার ইরানে ক্যাপিচুলেশন আইন বাস্তবায়ন করার ধৃষ্ঠতা দেখায়। বিশ্বের ইতিহাসে আমেরিকার এই আইন বাস্তবায়নকারী দেশের নজীর নেই বললেই চলে। এই আইনে বলা হয়েছে, ইরানে অবস্থানরত আমেরিকার নাগরিকরা কোনো অপরাধ করলে এমনকি কাউকে খুন করলেও তাকে ইরানের আইনে বিচার করা যাবে না বরং তাকে মার্কিন কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দিতে হবে। সে সময় শাহ সরকারের সঙ্গে আমেরিকার রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা এত বেশি বেড়ে যায় যে, মার্কিন সরকারের আঙুলের ইশারায় ইরানের সরকার চলতে থাকে। জনবিচ্ছিন্ন শাহ সরকারের এই আচরণ সহ্য করা স্বাধীনচেতা ইরানি জনগণের পক্ষে সম্ভব ছিল না।  ইমাম খোমেনী (রহ.) ১৯৬৩ সালে জনগণের সামনে মার্কিন ষড়যন্ত্রের স্বরূপ তুলে ধরে আমেরিকাকে ‘বড় শয়তান’ বলে অভিহিত করেন। তিনি ক্যাপিচুলেশন আইনকে ‘ইরানি জাতির দাসত্বের দলিল’ হিসেবে উল্লেখ করে এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। বিপদ বুঝে ইমামকে জনগণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যে অত্যাচারী শাহ সরকার ওই বছরের ১৩ অবন তাকে দেশ থেকে বহিস্কার করে এবং তুরস্কে নির্বাসনে পাঠায়।

ওই ঘটনার দুই দশকেরও কম সময়ের মধ্যে ইসলামি বিপ্লব চূড়ান্ত বিজয় লাভ করে এবং ইমাম খোমেনী (রহ) ১৬ বছরের নির্বাসিত জীবন শেষে বীরের মর্যাদায় স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। আমেরিকা তার সর্বশক্তি দিয়ে গণআক্রোশ থেকে শাহ সরকারকে রক্ষা করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। কিন্তু বিপ্লব বিজয়ের পরও আমেরিকার ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। তেহরানস্থ মার্কিন দূতাবাসে বসে কূটনৈতিক তৎপরতার ছদ্মাবরণে সদ্য প্রতিষ্ঠিত ইসলামি শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলতে থাকে। আমেরিকার উদ্দেশ্য ছিল যেকোনো কৌশলে বিপ্লবের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত সরকারকে উৎখাত করে আবার আমেরিকার পদলেহী কাউকে ক্ষমতায় বসানো। ইরানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সচেতন ছাত্ররা এ বিষয়টি উপলব্ধি করে ১৯৭৯ সালের ১৩ অবন মার্কিন দূতাবাস দখল করে ইরানের মাটিতে বসে আমেরিকার ষড়যন্ত্র করার পথ চিরতরে বন্ধ করে দেন। 

এদিকে ফার্সি ১৩৩২ সালের ২৮ মোরদাদ তথা ১৯৫৩ সালের আগস্ট মাসে ইরানের তৎকালীন মোসাদ্দেক সরকারকে উৎখাতে আমেরিকার ভূমিকা নিয়ে মার্কিন দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্টে ২০১৬ সালের নভেম্বরে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। ওই নিবন্ধে ইরানের বর্তমান সরকার উৎখাতের লক্ষ্যে এখনকার মার্কিন কর্মকর্তাদের প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করে বলা হয়, ... “মার্কিন কর্মকর্তারা ঐতিহাসিক বাস্তবতা ভুলে গিয়ে একটি বিপজ্জনক খেলায় মেতে উঠেছেন যা ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ” ওই নিবন্ধে আরো বলা হয়:

“১৯৫৩ সালের অভ্যুত্থানে আমেরিকার ভূমিকা নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শত শত দলিল প্রকাশ করেছে। ইঙ্গো-মার্কিন ষড়যন্ত্রের ফল হিসেবে ড. মোসাদ্দেকের নেতৃত্বাধীন বৈধ সরকারের পতন হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেক ইরানের তেল সম্পদের ওপর বিদেশিদের কর্তৃত্ব অবসানের লক্ষ্যে এই সম্পদকে জাতীয়করণ করেছিলেন যা আমেরিকার ভালো লাগেনি। তাই তাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা হয়। মার্কিন কর্মকর্তারা ভেবেছেন ওই ঘটনা হয়তো মানুষ ভুলে গেছে। কিন্তু বাস্তবতা সেরকম নয়। ইরানের জনগণ ওই ঘটনা ভোলেনি, ভোলেনি মধ্যপ্রাচ্যের কোনো মানুষও।”

আসলে মার্কিন কর্মকর্তারা ইরানের ব্যাপারে বারবার যে ভুল করছেন তা হলো তারা ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানকে বিশ্বের আর দশটা অনুগত সরকারের সঙ্গে তুলনা করছেন। তারা ভাবছেন প্রলোভন দেখিয়ে কিংবা হুমকি বা অবরোধ দিয়ে হয়তো ইরানি জনগণকে আত্মসমর্পনে বাধ্য করা যাবে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন সম্প্রতি মার্কিন সিনেটের পররাষ্ট্র সম্পর্ক বিষয়ক কমিটিতে দেয়া বক্তব্যে বলেন,

“শান্তিপূর্ণ উপায়ে ইরানের সরকার পরিবর্তনের প্রচেষ্টায় দেশের ভেতর থেকে যারা আমেরিকাকে সাহায্য করতে চাইবে ওয়াশিংটন তাদেরকে সবরকম পৃষ্ঠপোষকতা দেবে।” মার্কিন কর্মকর্তাদের এ ধরনের বক্তব্য ইরান সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতার চরম মাত্রা ফুটিয়ে তোলে।

মার্কিন সরকার যে কেবল বর্তমানেই ইরানের ইসলামি সরকারকে উৎখাত করতে চায় তা নয়। ১৯৭৯ সালে মার্কিন দূতাবাস দখলের পর থেকেই ওয়াশিংটনের সে প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল। আমেরিকা পারস্য উপসাগরে যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়ে বহুবার ইরানে হামলা চালানোর হুমকি দিয়েছে। ইরানে কমান্ডো অভিযান চালানোর মার্কিন প্রচেষ্টা তাবাস মরুভূমিতে ব্যর্থ হয়েছে। ইরানকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একঘরে করে রাখার প্রচেষ্টা সফল হয়নি এবং ইরানকে ‘শয়তানের অক্ষশক্তি’ হিসেবে অভিহিত করার পরও তেহরানের কোনো ক্ষতি করতে পারেনি ওয়াশিংটন। তবে এসব ঘটনায় আমেরিকার ইরান বিরোধী ভয়াবহ শত্রুতা ও বিদ্বেষের বিষয়টি ফুটে উঠেছে। এ সম্পর্কে বিশিষ্ট মার্কিন চিন্তাবিদ ও লেখক নওম চমস্কি বলেন:

“মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যেকে তাদের পৈত্রিক সম্পত্তি বলে মনে করে। কাজেই এই অঞ্চলে একটি স্বাধীনচেতা দেশের অস্তিত্ব মেনে নেয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।”

কিন্তু নিজের বিদ্বেষী তৎপরতার ক্ষেত্রে মার্কিন সরকারের অন্তত ইরানের ইসলামি বিপ্লবের গত চার দশকের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত। ইসলামি বিপ্লবের পর গত চার দশকে ইরানের জনগণ সাম্রাজ্যবাদ ও ইহুদিবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে প্রমাণ করেছেন, কারো পক্ষে ইরানের ক্ষতি করা সম্ভব নয় বরং ইরানের ক্ষতি করতে গেলে আগ্রাসী শক্তিই চরম ক্ষতির সম্মুখীন হবে।

ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হজরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী চলতি বছর ১৩ অবনের বার্ষিকী পালনের আগে এক ভাষণে ইরানের তরুণ সমাজের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছেন: “সচেতন ও প্রজ্ঞাসম্পন্ন এই তরুণ সমাজ নিঃসন্দেহে সব বাধার প্রাচীর পেছনে ফেলে ইরানকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে নিয়ে যাবে। তবে এ কাজ করার পূর্বশর্ত হচ্ছে ইরানের প্রধান শত্রু  আমেরিকাকে চিনতে পারা। ”

ইসলামি বিপ্লব বিজয়ের পর থেকে এখন পর্যন্ত ইরানের ক্ষতি করার লক্ষ্যে কোনো প্রচেষ্টাই বাদ রাখেনি আমেরিকা। কিন্তু তাদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এর কারণ হচ্ছে, ইরানি জনগণ এখন মার্কিন সরকারের সব কূটকৌশল ও ষড়যন্ত্র আগে থেকেই উপলব্ধি করতে পারে যার কারণে অঙ্কুরেই এসব ষড়যন্ত্র বিনষ্ট হয়ে যায়। এ সম্পর্কে আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেন, “ইরান-বিদ্বেষের কারণে আমেরিকা অনেকটা অন্ধ হয়ে আছে। এ কারণে তারা বাস্তবতা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়ে অতীতের ভুলের পুনরাবৃত্তি করছে। ”#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/আশরাফুর রহমান/৪

 

ট্যাগ