মহান বীর শহীদ সোলাইমানির জনপ্রিয়তা ও মহাসাফল্যের রহস্য
https://parstoday.ir/bn/news/iran-i76558-মহান_বীর_শহীদ_সোলাইমানির_জনপ্রিয়তা_ও_মহাসাফল্যের_রহস্য
মহাবীর শহীদ কাসেম সোলাইমানির শাহাদাত উপলক্ষে সবাইকে গভীর শোক ও সমবেদনা জানাচ্ছি।
(last modified 2025-09-11T14:06:22+00:00 )
জানুয়ারি ০৮, ২০২০ ১৯:৫৩ Asia/Dhaka

মহাবীর শহীদ কাসেম সোলাইমানির শাহাদাত উপলক্ষে সবাইকে গভীর শোক ও সমবেদনা জানাচ্ছি।

সাম্প্রতিক মার্কিন সন্ত্রাসী হামলায় শহীদ-হওয়া ইরানের ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর কুদস্ ব্রিগেডের সাবেক কমান্ডার শহীদ কাসেম সোলাইমানি বেশ কয়েক বছর ধরেই বিশ্বের বড় বড় সংবাদ মাধ্যম ও মিডিয়ায় আলোচিত ব্যক্তিত্ব হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি অর্জন করেছিলেন। মূলতঃ তার নেতৃত্বে পশ্চিমা মদদপুষ্ট আইএসআইএল বা দায়েশের মত তাকফিরি বা ধর্মান্ধ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর-বিরোধী বহুজাতিক জিহাদে  অকল্পনীয় সাফল্য লাভই ছিল এর কারণ। সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলতেন, লে. জেনারেল কাসেম সোলাইমানি  বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সেনাপতি ও রণ-কৌশলী। আন্তর্জাতিক খ্যাতি এবং ব্যাপক জনপ্রিয়তার অধিকারী এই ব্যক্তিত্ব সাম্প্রতিক সময়ে হয়ে উঠেছেন সংবাদ-মাধ্যমের আলোচনার অন্যতম প্রধান কেন্দ্রবিন্দু এবং বিশ্বের মুক্তিকামী জাতি, জনগণ ও নেতৃবৃন্দের কাছে শীর্ষস্থানীয় প্রধান প্রিয় ব্যক্তিত্ব বা চোখের মনি। এর একটা বড় কারণ হল বিশ্বের প্রধান সাম্রাজ্যবাদী, তাগুতি ও শয়তানি শক্তি মার্কিন সরকারের এক বেআইনি, অন্যায্য ও নির্লজ্জ হামলায় শহীদ হয়েছেন এই বিপ্লবী ইরানি সমরবিদ। সম্প্রতি ইরাকের প্রধানমন্ত্রী আদেল আল মাহদির রাষ্ট্রীয় মেহমান হিসেবে ইরাক সফরের সময় বাগদাদ বিমানবন্দরে মার্কিন ড্রোনের বোমা হামলায় তিনি শহীদ হন।

 মহান বীর শহীদ সোলাইমানির জনপ্রিয়তা ও মহাসাফল্যের রহস্য

ওই একই হামলায় শহীদ হন ইরাকের জনপ্রিয় আধা-সামরিক বাহিনী হাশদ্ আশ শাব্‌য়ি বা পপুলার মোবিলাইজেশন ইউনিটের উপপ্রধান আবু মাহদি আল মুহানদিস। কয়েকজন ইরানি ও ইরাকি সেনা কর্মকর্তাও শহীদ হন সন্ত্রাসী মার্কিন হামলায়। ইরাক ও ইরানের সর্বস্তরের কোটি কোটি মানুষ সন্ত্রাস-বিরোধী যুদ্ধের এই দুই জনপ্রিয় কমান্ডারের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে, শোক প্রকাশ করতে এবং মার্কিন বিরোধী গণ-বিক্ষোভে অংশ নিতে রাজপথগুলোতে নেমে আসেন। কেবল ইরান, ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন ও লেবানন নয় বিশ্বের অন্য অনেক অঞ্চলেরও কোটি কোটি মানুষ অশ্রুসিক্ত নয়নে স্মরণ করছেন এই বীরদের। কিন্তু কোনো কোনো পশ্চিমা গণমাধ্যমের বিশ্লেষণের বিপরীতে অনেকেই বলছেন জীবন্ত কাসেম সোলাইমানিদের চেয়ে মৃত সোলাইমানিরা অনেক বেশি বিপজ্জনক হবেন সাম্রাজ্যবাদী, সন্ত্রাসী ও তাগুতি গোষ্ঠীগুলোর জন্য এবং এ ধরনের আরও অনেক বীরের আবির্ভাব ঘটবে ইরান ও পশ্চিম এশিয়া অঞ্চলে। 

ইরানের ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর কুদস্ ব্রিগেডের সাবেক কমান্ডার শহীদ কাসেম সোলাইমানি সাম্রাজ্যবাদী ও তাগুতি শক্তিগুলোর ইঙ্গিতে ইরানের ওপর ইরাকের চাপিয়ে দেয়া ৮ বছরের যুদ্ধের সময়ই সাহসী ও শাহাদত-পিয়াসী দক্ষ কমান্ডার হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তার একনিষ্ঠতা, ধার্মিকতা, উদারতা, সাহসিকতা, বিনয়, নম্রতা ও অন্য অনেক মহান গুণ সহযোদ্ধা এবং অনুগত সেনাদের গভীরভাবে আকৃষ্ট করেছিল তাঁর প্রতি। তাই তিনি যদি বলতেন তাহলে তার জন্যও জীবন দিতে প্রস্তুত থাকত তার সহযোদ্ধা বা অনুগত যোদ্ধারা। কিন্তু যে কথা মনে রাখা বেশি জরুরি তা হল ইরানের ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর কুদস্ ব্রিগেডের সাবেক কমান্ডার শহীদ কাসেম সোলাইমানি হলেন খাঁটি ইসলামী আদর্শেরই ফসল। তার সাফল্যগুলোর রহস্যই হল এই আদর্শ। তিনি ছিলেন ইরানের ইসলামী বিপ্লবের রূপকার ইমাম খোমেনি (র) ও বর্তমানে এই বিপ্লবের কাণ্ডারি  আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ির একান্ত অনুরাগী ও একনিষ্ঠ অনুসারী। আর এ দুই মহান নেতাও হচ্ছেন ইসলামের ঐতিহ্যবাহী সংগ্রামী ধারারই অনুসারী। অন্য কথায় তারা হচ্ছেন বিশ্বনবী (সা) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের আদর্শের খাঁটি অনুসারী।

 মহান বীর শহীদ সোলাইমানির জনপ্রিয়তা ও মহাসাফল্যের রহস্য

আসলে ইরানের ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর কুদস্ ব্রিগেডের সাবেক কমান্ডার শহীদ কাসেম সোলাইমানি মহান আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল বা একনিষ্ঠ নির্ভরতার পাঠ নিয়েছেন বিশ্বনবী (সা) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের আদর্শের খাঁটি অনুসারী হিসেবে খ্যাত ঐতিহ্যবাহী বিপ্লবী আলেমদের কাছ থেকেই। এই ধারার আলেমরাই তথা খোমেনী ও খামেনির মত ব্যক্তিত্বরাই হচ্ছেন বর্তমান যুগে হযরত ইমাম হুসাইনের (আ) রেখে যাওয়া পবিত্র প্রতিরোধ ও শাহাদাতের সংস্কৃতির সংরক্ষক এবং এই সংস্কৃতির অনন্য বিকাশকারী। ফলে সোলাইমানিরা যুদ্ধ ও ষড়যন্ত্রে কখনও বিচলিত হন না। কুরআনের এ বক্তব্যে তাদের গভীর আস্থা ছিল যে: তোমরাই বিজয়ী হবে যদি তোমরা মুমিন হও। অন্যদিকে দায়েশসহ ধর্মান্ধ ও তাগুতি শক্তিগুলো হুসাইনি আদর্শে উজ্জীবিত গণ-বাহিনীর জিহাদের জোয়ারে পশ্চিম এশিয়ার ইতিহাসের আস্তাকুড়ে ঠাঁই নিয়েছে বা নিতে যাচ্ছে।

সোলাইমানিদের মত কৌশলী ও খোদাভীরু সমর নেতার আবির্ভাব না ঘটলে আজ ওয়াহাবি-তাকফিরিবাদ বা ধর্মান্ধতা-আশ্রিত বিকৃত ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়া পশ্চিমা মদদপুষ্ট সন্ত্রাসী ও প্রতারিত হওয়া সরলমনা যুবকরা ইসলামের প্রকৃত চেহারাকে পুরোপুরি আড়াল করে ফেলত মুসলিম বিশ্ব থেকে। মুসলিম দেশগুলোতো বটেই এমনকি পাশ্চাত্যেও তাকফিরি সন্ত্রাসের বিস্তার ঘটতো। ফলে পাশ্চাত্যের অমুসলিম শিক্ষিত সমাজে ইসলামের প্রতি যে আকর্ষণ দিনকে দিন বাড়ছিল তা ব্যাপক মাত্রায় বাধাগ্রস্ত হত। অন্যদিকে ইহুদিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও নব্য-উপনিবেশবাদ বিশ্বব্যাপী আরও ভয়ানক ও বিস্তৃত হয়ে উঠত। কাসেম সোলাইমানির মত বিচক্ষণ ও দূরদর্শী সমর-নেতারা শাহাদাতের সংস্কৃতি, ইসলামী ঐক্য ও কূটনৈতিক প্রজ্ঞাকে কাজে লাগিয়ে কেবল সিরিয়া ও ইরাককেই মুক্ত করেননি একইসঙ্গে লেবাননে এবং গাজায় ইহুদিবাদী ইসরাইলের মত দানবীয় শক্তিকেও বার বার পরাজয়ের স্বাদ গ্রহণে বাধ্য করেছে। সোলাইমানির কূটনৈতিক প্রজ্ঞার কারণে রাশিয়া ও চীনের মত শক্তিগুলোও প্রতিরোধ সংগ্রামের সহযোগী হয়েছে খুব কঠিন প্রয়োজনের সময়ে।

লেবাননের শহীদ মুগনিয়া, হিজবুল্লাহর মহাসচিব সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ এবং ইরাকের আবু মাহদি আল মুহানদিসের মত নেতারা মুসলিম বিশ্বে খাঁটি জিহাদি আদর্শের ধারাকে বেগবান করতে সক্ষম হয়েছেন। আর এসবেরই মূল কৃতিত্বের অধিকারী হল মরহুম ইমাম খোমেনীর নেতৃত্বে সূচিত ইরানের ইসলামী বিপ্লব এবং এর বর্তমান দক্ষ কাণ্ডারি আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ির নেতৃত্বে একই বিপ্লবের অব্যাহত জয়যাত্রা। অন্য কথায় সোলাইমানির মত ব্যক্তিত্বরা হলেন আশুরা সংস্কৃতির ফসল। আর এ জন্যই তারা ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তাদের সাফল্যের রহস্যগুলো জানতে হলে জানতে হবে প্রকৃত মোহাম্মাদি ইসলামকে এবং জানতে হবে ইসলামের প্রকৃত ইতিহাস ও এর মহানায়কদের আদর্শের গভীরতাকে।

শহীদ সোলাইমানি শাহাদতের অল্প কিছু সময় আগে এক চিরকুটে লিখেছিলেন:

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

হে খোদা, আমাকে পবিত্র করে গ্রহণ করুন।

হে খোদা, আপনার সাথে মোলাকাতের আশেক আমি... সেই রকম মোলাকাত যা মূসা (আ.)-কে দাঁড়াতে আর শ্বাস নিতে অক্ষম করেছিল...

সাম্প্রতিক মার্কিন সন্ত্রাসী হামলায় শহীদ-হওয়া সন্ত্রাস-বিরোধী বহুজাতিক জিহাদের কিংবদন্তীতুল্য সফল ইরানি সমরবিদ লে. জেনারেল কাসেম সোলাইমানি বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সেনাপতি ও রণ-কৌশলী হিসেবে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এবং ব্যাপক জনপ্রিয়তার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও অত্যন্ত বিনয়ী ও নম্র ছিলেন।

 শহীদ হওয়ার জন্য সব সময় প্রস্তুত ও ব্যাকুল এই সেনাপতি শাহাদতের অনেক আগেই ওসিয়তনামা লিখে রেখেছিলেন। ওসিয়তনামার একাংশে অসাধারণ খোদাভীরু এই সেনাপতি লিখেছিলেন, তাঁকে যেন ৮ বছরের প্রতিরোধ যুদ্ধের সময় শহীদ-হওয়া তাঁর সহযোদ্ধাদের কবরের পাশেই দাফন করা হয় এবং তাঁর কবরকেও ওইসব শহীদ সহযোদ্ধাদের কবরের মতই যেন সাধারণ রাখা হয়। আর তাঁর কবরের ফলকে বড় কোনো বিশেষণ না লিখে শুধু যেন লেখা হয় ‘সৈনিক কাসেম সোলাইমানি!

 তিনি প্রায়ই বলতেন, আমকে সেনাপতি বলবেন না, আমি সাধারণ সৈনিক মাত্র!

 শহীদ সোলাইমানি ইরানের ওপর মার্কিন উস্কানিতে চাপিয়ে দেয়া ইরাকের ৮ বছরের যুদ্ধের সময় শহীদ-হওয়া তার সহযোদ্ধাদের কথা স্মরণ করে প্রায়ই অশ্রু-সজল হতেন এবং তাদের সঙ্গে শহীদ হতে পারেননি বলে গভীর দুঃখ প্রকাশ করতেন । তিনি নিজে ও ওই শহীদ যোদ্ধারা ছিলেন   ‘সারাল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর কুরবানি’ নামক একটি বিশেষ ইউনিট বা গ্রুপের সদস্য। এই গ্রুপের সদস্য হিসেবেই সোলাইমানি বেশ কয়েকটি অভিযানে সফল কমান্ডার হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন এবং পরবর্তীকালে ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর কুদস্ ব্রিগেডের কমান্ডার হওয়ার গৌরব অর্জন করেন।

 ইহুদিবাদী ইসরাইলের হাত থেকে মুসলমানদের প্রথম কিবলা তথা আল-আক্‌সা মসজিদসহ পবিত্র শহর বায়তুল মোকাদ্দাসকে মুক্ত করা কুদস্‌ ব্রিগেডের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা কিছুকাল আগে সোলাইমানির সঙ্গে এক সাক্ষাতে শাহাদাতের জন্য তাঁর ব্যাকুল আকাঙ্ক্ষার কারণে দোয়া করে বলেছিলেন: মহান আল্লাহ আপনাকে শহীদ হিসেবে কবুল করবেন। মহান আল্লাহ এই দোয়া কবুল করেছেন।

সবাইকে আবারও গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। 

পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবুসাঈদ/৮

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।