শ্রোতাদের মতামত
‘আল্লাহ অশান্তি পছন্দ করেন না; বিশ্ব শান্তির জন্য আমাদেরকে সোচ্চার হতে হবে’
মহান স্রষ্টা আল্লাহ তাআলা এই পৃথিবীতে মানুষের বসবাসের উপযুক্ত ক্ষেত্র হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। শুধু মানুষই নয়, ভূপৃষ্ঠে বিচরণকারী প্রতিটি প্রাণীর জন্যই একে বাসযোগ্য করেছেন। কিন্তু সেই পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষেরা আল্লাহ্ প্রদত্ত নির্দেশ ও বিধানকে অমান্য করে অশান্তিময় করে তুলেছে।
পৃথিবীর প্রত্যেকটি ধর্মেই শান্তির কথা বলা হয়েছে অথচ এমনটি হওয়ার কথা নয়। আজ সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে মানবকূলের একটি অংশই নির্বিচারে এইসকল বিপর্যয় ঘটিয়ে চলেছে; আর তাদেরকে যদি বলা হয়, তোমরা এরকম কেন করছ? তখন তারা দম্ভভরে বলতে থাকে আমরাইতো পৃথিবীতে শান্তিকামী, গণতন্ত্রকামী, এবং আমরাই সভ্য ও সংস্কারকামী। তোমরা আমাদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে আমাদের সঙ্গে এসো। প্রকৃতপক্ষে এরা হচ্ছে মিথ্যাচারী এবং এই বিশ্বে অনাসৃষ্টিকারী। মহান আল্লাহ এদের কথায় পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করেছেন এইভাবে,-
"তাদেরকে যখন বলা হয় পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করো না তখন তারা বলে, আমরা এত শান্তি স্থাপনকারী।" (সূরা বাকারা:১১)
বর্তমানে আমেরিকাসহ বিশ্বের পরাশক্তি দেশগুলোর দিকে তাকালে এই দৃশ্যই সকলের সামনে ভেসে উঠবে। তারা একদিকে বিশ্বের শান্তিকামী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগুলোকেকে দমন করার জন্য, পিষে মারার জন্য অগণিত মানববিধ্বংসী সমরাস্ত্র তৈরি, রপ্তানি ও সরবরাহ করছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। একচেটিয়া অস্ত্র ব্যবসা করে দুহাতে অর্থ লুটে নিচ্ছে। অন্যদিকে যখন তাদের মনঃপুত নয় এমন কারো কাছে অস্ত্রশস্ত্র থাকে অথবা থাকার সম্ভাবনা থাকে তখন তাদের বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা চালায়; লেলিয়ে দেয় তাদের ধামাধরা বিশ্ব মিডিয়া বাহিনীকে। এ সকল সাম্রাজ্যবাদী বেনিয়াদের মোকাবিলায় পৃথিবীতে ক্ষুদ্র জাতি গুলোর কোন আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার যেন নেই।
ইহুদিবাদি ইসরাইল আমেরিকার বন্ধু কাজেই তার নিকট শতাধিক পারমানবিক বোমা থাকলেও তাতে কোনো দোষের কথা নয়। কিন্তু অন্যরা যদি শান্তিপূর্ণভাবে, শান্তির লক্ষ্যে তথা শিল্প কলকারখানার জন্য আনবিক শক্তি ব্যবহার করে তবে তার জন্য এরাই হুংকার ছাড়ে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরানের শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচিকে বানচাল করতে আমেরিকা উঠেপড়ে লেগেছিল। ২০১৫ সালে আমেরিকাসহ ছয় জাতিগোষ্ঠীর (চীন, রাশিয়া, ব্রিটেন ফ্রান্স ও জার্মানি) সাথে ইরানের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যার বিনিময় তাদেরকে নিশ্চয়তা দিতে হয়েছিল যে তারা শান্তিপূর্ণভাবেই এই পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার করবে। কিন্তু চুক্তির মাঝখানে হঠাৎ করে ২০১৮ সালে আমেরিকা বেরিয়ে যাওয়াই এ চুক্তিটি দুর্বল হয়ে পড়ে। চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী বাকি দেশগুলো অসহায় হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় ইরান স্বাধীনভাবে তার পারমাণবিক শক্তিকে কাজে লাগানোর প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার অপরাধে আমেরিকা ও তার দোসররা ইরানের ওপর বার বার অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিয়েই চলেছে।
এসকল ঘটনার প্রেক্ষিতে ৪০ সদস্যের নতুন দল ঘোষণা করেছে ইরান। ইতিমধ্যে তারা কিছু দাবি জানিয়েছেন, যা পূরণ করা অবাস্তব বলে মনে করছেন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় কূটনীতিকরা। যেমন ২০১৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত ইরানের ওপর দেয়া যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সব নিষেধাজ্ঞা (এমনকি যেগুলো পরমাণু কর্মসূচির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয় সেগুলোও) তুলে নেয়ার দাবি জানিয়েছে ইরান। এছাড়া আলোচনা শুরুর আগে প্রাথমিক শুভেচ্ছা নিদর্শন হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাজেয়াপ্ত থাকা ইরানের ১০ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের সম্পদ ছাড়ের দাবি জানিয়েছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. সাইয়্যেদ ইব্রাহিম রাইসি।
বর্তমানে ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, লেবানন প্রভৃতি দেশের দিকে তাকালে দেখা যায় যে এদের দুর্দশার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী এই সকল সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো। যার মধ্যে সব চেয়ে বড় ভূমিকা পালন করছে আমেরিকা। এ সকল কথিত সভ্য, গণতন্ত্রের রক্ষাকর্তা ও তাদের কিছু তল্পিবাহক তাঁবেদার সরকার এই সকল অপকর্মে তাদের সহযোগী।
একদিন এরাই ইরানের বিজয়ী ইসলামী বিপ্লব, ইরানের সরকার ও ঈমানী চেতনায় উদ্দীপ্ত ইরানি জনগণকে ধ্বংস করার জন্য লক্ষ লক্ষ মারণাস্ত্র সরবরাহ করেছিল ইরাকে এবং তাদের হয়েই সাদ্দাম হোসেনে ইরানের বিরুদ্ধে লড়েছিল। তার পর আমরা দেখেছি, যখন সাদ্দাম তাদের স্বার্থের প্রতিকূলে গেছে, নানা অজুহাতে সেই সাদ্দাম হোসেনের তথা ইরাকের বিরুদ্ধে আক্রমণ হেনেছে। ইরাকে হামলা করে হাজার হাজার নারী ও শিশুকে হত্যা করেছে। সাদ্দাম হোসেনের সংগৃহীত মারণাস্ত্র তার পরবর্তী দেশের জন্যে হুমকি বিবেচনা করে ইরাক আক্রমণের সার্বিক প্রেক্ষাপট তৈরি করে সেখানে দেশটিকে বিরান ভূমিতে পরিণত করে দিয়েছে।
একটি শান্তিপূর্ণ এলাকাকে এভাবে পরাশক্তি অশান্তিময় করে তুলেছে আবার এরাই বলছে আমরা শান্তিকামী, এটা খুবই হাস্যকর! তারা মুখে গণতন্ত্রের কথা বলে, আবার মধ্যপ্রাচ্যের কতিপয় তাবেদারী বাদশাহী শাসকদের বেলায় চুপ থাকে। পরোক্ষে তাদের সর্বতভাবে সহযোগিতা করে কোটি কোটি পেট্রো ডলারের বিনিময়ে।
সম্প্রতি ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলায় উস্কানিদাতা হিসেবে মঞ্চে বিরাজমান খোদ আমেরিকা ও ইউরোপের লাঠিয়াল 'ন্যাটো'!
ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তানসহ বিশ্বের বহু দেশে সরাসরি আগ্রাসন পরিচালনাকারী আমেরিকা ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক হামলার সমালোচনা করেতে দেখা যাচ্ছে। এখানে রাশিয়াকে আক্রমণকারী অবিবেচক বললেও ইউক্রেনে যুদ্ধাবস্থা তৈরির জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী আমেরিকার প্রেসিডেন্ট মি. বাইডেন। তিনি রাশিয়াকে টার্গেট করে ইউরোপে হাজার হাজার সেনা মোতায়েন করেছেন। ন্যাটোকে রাশিয়ার জন্য হুমকি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।
আমেরিকা যখন ইউক্রেনসহ রুশ প্রতিবেশী বাল্টিক দেশগুলোয় সেনাও সমরাস্ত্র পাঠাচ্ছিল, তখনো রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলছিলেন, 'রাশিয়ার নিরাপত্তার লিখিত গ্যারান্টি চাই'। কিন্তু বাইডেন তাতে সাড়া দেননি। উল্টো রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপ করেছেন এবং উস্কানি যুগিয়েছেন ইউক্রেনকে। আমেরিকার কারণেই রাশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলো বলির পাঁঠায় পরিণত হয়েছে।
দীর্ঘদিন থেকেই পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ও বিলোপের দাবি উঠেছে। কিন্তু যাদের হাতে এ অস্ত্র রয়েছে এবং যারা এগুলো বিশ্বের আনাচে-কানাচে সরবরাহ করছে তারা কারা? তারা কি এসকল পরাশক্তি নয়?
আমরা মনে করি মানবজাতিকে ভবিষ্যৎ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে, বিশ্বের বিবেকবান মানুষকে সোচ্চার হতে হবে। মানব বিধ্বংসী অস্ত্র যারা অবৈধভাবে তৈরি করছে এবং যাদের হাতে এ সকল অবৈধ অস্ত্রের মজুত রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে জোরালো আওয়াজ তুলতে হবে। বিশ্বের বিবেকবান মানুষকে অগ্রসর হতে হবে, পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে এবং বিশ্বের শক্তিশালী ফোরাম হিসেবে জাতিসংঘের এ বিষয়ে বড় ভূমিকা থাকতে হবে বলে আমরা মনে করি। এক্ষেত্রে ভেটো ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধেও আওয়াজ তুলতে হবে। আজ সময় এসেছে শান্তির জন্যে কাজ করার; অশান্তি সৃষ্টিকারীদের দুরভিসন্ধিকে নস্যাৎ করে, দিকে দিকে তাদের মুখোশ উন্মোচনে জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে; একমুখী বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে।
আজ আমাদেরকে এ সম্পর্কে বিশেষভাবে ভাবতে হবে যে, আমাদেরকে শান্তির জন্য একযোগে কাজ করতে হবে, কেননা মহান আল্লাহ অশান্তি ও বিপর্যয় সৃষ্টি করা পছন্দ করেন না।
এস এম নাজিম উদ্দিন
মুর্শিদাবাদ, পশ্চিম বঙ্গ, ভারত।
পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/২৩
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।