জুন ২৭, ২০২২ ০৮:৩০ Asia/Dhaka
  • পারস্যের স্রোতধারায় বাংলা ভাষায় ফারসি শব্দ

সৈয়দ রেজাউল করিম বেলাল: গণমাধ্যম আধুনিক সমাজের একটি অপরিহার্য অংশ। সমাজের উপরি কাঠামো অবকাঠামো কিংবা মানবিক আচরণের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গণমানুষের তথ্য, শিক্ষা, বিনোদনসহ নানাবিধ চাহিদা মেটায় গণমাধ্যম তথা রেডিও-টেলিভিশন-সংবাদপত্র। গণমাধ্যম জনগণকে প্রভাবিত করে, বিভিন্ন বিষয়ে সচেতন করে এবং স্বপ্ন দেখায়। 

ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান-এর জাতীয় সম্প্রচার সংস্থার (আইআরআইবি) বিশ্ব কার্যক্রমের বাংলা অনুষ্ঠান প্রচার শুরু ৪০ বছর আগে, ১৯৮২ সালের ১৭ এপ্রিল। আইআরআইবি রেডিও তেহরান এর অনলাইন সংস্করণ 'পার্সটুডে' কাজ শুরু করেছে ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে, মূলধারার গণমাধ্যম হিসেবে। এই বেতারের বাংলাদেশ প্রতিনিধি’র প্রেরিত খবরা-খবর চোখে পড়ে রেডিও তেহরান-এর খবর এবং ওয়েবপেইজে।

তরুণ বয়সে সাংবাদিকতা জীবনে গণমাধ্যমের সাথে যুক্ত থাকার পাশাপাশি রেডিও শোনা এবং বেতারের শ্রোতা হিসেবে যুক্ত থাকার সৌভাগ্য অর্জন করেছি। একজন সাংবাদিক বা লেখক হিসেবে অনুসন্ধানী চোখে খুঁজে পাই এমন একটি শব্দ, যার নাম 'বেতার'। বাংলা ভাষায় ‘বেতার’-এর শব্দার্থ কি, এটা জানতে খুঁজলাম বাংলাপিডিয়া/উইকিপিডিয়া। বেতার হলো ‘তার ব্যতীত’ যোগাযোগের একটি শক্তিশালী মাধ্যম। এতে তড়িৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ ব্যবহার করে তথ্য প্রেরণ বা গ্রহণ করা হয়। রেডিও (বেতার), টেলিভিশন (দূরদর্শন), মোবাইল ফোন ইত্যাদি তারবিহীন যে কোনো যোগাযোগের মূলনীতিই হলো ‘বেতার’।

ভাষা বিশ্লেষণে আরো জানলাম:- ‘বেতার’ শব্দটি বাংলা নয়- এটি ফারসি শব্দ। এই কৌতুহল থেকে ‘ফারসি ভাষা’ নিয়ে কিছু লেখা।

কেবল পারস্য উপসাগর থেকে বঙ্গোপসাগরের মতো বিষয় নয়। নিজের কৌতূহল থেকে ফারসি ভাষা নিয়েও জানার এবং লেখার জন্যে কিছু খুঁজছি। আমরা জানি ‘পারস্য’ ইরান- এর প্রাচীন নাম। ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত বহিঃবিশ্বে ইরান ‘পারস্য’ নামে অভিহিত হতো, যদিও ইরানিরা বহুযুগ নিজেদের দেশকে ইরান নামেই ডেকে এসেছে। দেশটিতে গণমাধ্যম নতুন নয়। এর যাত্রা শুরু শতবর্ষ আগে।

রেডিও'র কার্যক্রম দেখা যায় ১৯২৬ থেকে এবং টেলিভিশন ১৯৫৮ সালে। তবে, জাতীয় পর্যায়ে অর্থাৎ ন্যাশনাল ইরানিয়ান টেলিভিশন (এনআইটিভি) নামে ছিল ১৯৬০ থেকে ১৯৬৬ এবং রেডিও-কে যুক্ত ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৭৯ পর্যন্ত। যার নাম ছিল ‘ন্যাশনাল ইরানিয়ান রেডিও এন্ড টেলিভিশন’ (এনআইআরটি) এবং পরে ইসলামিক রিপাবলিক অব ইরান ব্রডকাস্টিং (আইআরআইবি)। বর্তমানে ইরান-এ গণমাধ্যম পুরোপুরি সরকারি নিয়ন্ত্রণে।

কয় শ' বছর আগের পারস্য সাম্রাজ্য এখন ইরান। পূর্ব নাম ছিল পারস্য। তেহরান রেডিও’ র নিউজ ওয়েবসাইটের নাম Pars Today (আজকের পার্স) পার্সিয়া থেকে পারস্য শব্দকে পারস Pars বলা হয়। ফারসি /ফার্স শব্দের সাথে বাঙ্গালি এবং বাংলাদেশের মানুষের হাজার বছরের যোগাযোগ। কেবন বাদশা বা মোঘল’রাই নয়। এসেছেন অনেক পীর-কামেল বণিক-ব্যবসায়ীরা। ফারসি ভাষা ও ইসলামের প্রসার ঘটেছে এ বাংলায় ফার্সি লোকদের আগমনে।

আমাদের উপমহাদেশে শাসন করেছে পারস্য বংশোদ্ভূত শাসকরা এবং দীর্ঘ পাঁচশত বছর ধরে উপমহাদেশের রাষ্ট্রভাষা ছিল ফার্সি। বাংলা ভাষা ভাণ্ডারের একটি বিরাট অংশ দখল করে আছে ফার্সি শব্দমালা। পারস্য তথা ইরান পৃথিবীর প্রাচীনতম কাল থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত অস্তিত্বশীল বৃহৎ সভ্যতাগুলোর মধ্যে অন্যতম। সর্বশেষ ১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে আয়াতুল্লাহ্ খোমেনির নেতৃত্বে বর্তমান ইরান এগিয়ে যাচ্ছে। পশ্চিমাবিশ্ব ইরানের এই অগ্রগতি থামাতে সবসময় বৃদ্ধপরিকর- তবে, ইরান এগিয়ে যাচ্ছে তার ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায়।

ফারসি শব্দের প্রবেশ ও আত্তীকরণ

পৃথিবীর সকল ভাষাই নিজস্ব গতি-প্রকৃতির সাথে সংযুক্তি রেখে বিদেশি শব্দ আয়ত্ত করেছে। তেমনি আমাদের বাংলা ভাষাও কয়টি ভাষা থেকে শব্দ আত্মস্থ করে সমৃদ্ধ হয়েছে। তার মধ্যে আরবি-ফারসি-উর্দু ও ইংরেজির প্রভাব অন্যতম।

ভাষাচর্চা ও গ্রহণে পারস্য ভাবধারায় ভারতবর্ষে প্রভাবিত ছিল। আব্বাসীয় খিলাফতকালে (৭৫০-১২৫৮ খ্রি.) পার্সিয়ান ভাষা আরবের প্রশাসনিক ভাষায় পরিণত হয় এবং তখন বহু আরবি শব্দ মধ্যযুগীয় পার্সিয়ান ভাষায় পরিবর্তিত হয়। এই পার্সিয়ান বা ফারসি ভাষা ব্যাপকভাবে গৃহিত হয় ইরান, তুরস্কসহ ভারত উপমহাদেশের দেশগুলোতে। কারণ, তখন বেশির ভাগ ইসলামিক স্কলার ও ইমাম পারস্য শিক্ষিত ছিলেন। ভাষা বিচারে রমাদান, ঈদল আদহা কুরআনের আরবি শব্দ-যা পরে ফারসি-তে রূপান্তরিত হয়। যেমন- ‘রমাদান’ হয় রমজান, ‘সাত্তম’-রোজা হয়ে যায়, ‘সালাত-নামাজে পরিণত হয়, ‘দুহর’-হয় জোহর, ‘ওদু’- হয় অজু।

বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজি নজরুল ইসলাম ফারসিতে পারদর্শী ছিলেন। তিনি শত শত গজল লিখে বাংলার গালিব হয়ে আছেন। নজরুলের বিখ্যাত গান- ‘রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ - এ 'রমজান' ও 'রোজা' শব্দের ব্যবহার বাংলা ভাষায় পারস্য ভাষারই ছাপ বহন করে। নজরুল ‘রমজান’ লিখেছেন বলে ‘রমজান’ শব্দটি অশুদ্ধ হয়ে যায়নি। বাংলা গদ্যের প্রথম যুগে মুসলমানী বাংলা বলে একটি কথা প্রচলিত ছিল। কোনো কোনো মুসলমান লেখক তাঁদের রচনায় প্রচুর আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করে এক রকমের গদ্য রচনা করতেন।

বাংলা ভাষা তার সমৃদ্ধি এবং প্রকাশ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বহু ভাষার শব্দ আত্মীকৃত করে নিয়েছে - নিজস্ব নিয়ম-শৃঙ্খলার মাধ্যমে। এর মধ্যে আরবি ফারসি শব্দের সংখ্যাও সামান্য নয়। এক সময় আইন আদালতের ভাষায় আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহারের কোনো বিকল্প ছিল না। বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহে কর্মসূত্রে বসবাস করছে। তাদের মাধ্যমে আরবি-ফারসি কিছু শব্দ প্রতিনিয়তই আমাদের ভাষায় প্রবেশ করছে। সে সম্পর্কে কোনো সন্দেহ নেই। এ বিষয়ে লক্ষ্য রেখে বাংলা একাডেমী বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত ‘আরবি-ফারসি-উর্দু’ শব্দের একটি অভিধান প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে ফারসি ভাষার ভুক্তির সংখ্যা প্রায় ৪,৫০০টি, শব্দ বিন্যস্ত হয়েছে বর্ণনাক্রমিকভাবে। বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট কবি-সাহিত্যিকদের উদ্ধৃতি উপস্থাপন করে শীর্ষশব্দের প্রয়োগরীতি দেখানো হয়েছে।

বিশ্বের কোনো ভাষাই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, বরং তার ওপর রয়েছে অন্যান্য ভাষার প্রভাব। সামাজিক জীবনে বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ পরস্পরের সঙ্গে মেলামেশার কারণে এক ভাষার প্রভাব অন্য ভাষার ওপর পড়ে। বিজিত জাতি যেমন বিজয়ী জাতির ভাষা গ্রহণ করে, তেমনি বিজয়ী জাতিও বিজিতের ভাষা গ্রহণ করে। এভাবেই ভাষার সংমিশ্রণ ঘটে। সুদীর্ঘ আটশত বছর ধরে এই দেশে মুসলিম শাসনের কারণে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে আরবি ফারসি ভাষার ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। ১২০৪ সালে যখন এদেশে মুসলিম শাসনের সূচনা হয়, তখন থেকে এ অঞ্চলে আরবি ফারসি ভাষাও বিস্তার লাভ করে। সামাজিক আচার-ব্যবহার, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এবং দৈনন্দিন জীবনে নানা কাজে-কর্মে, প্রশাসনিক প্রয়োজনে আরবি ফারসি ভাষাও বিস্তার লাভ করে এবং আমাদের ভাষায় স্থান করে নিয়েছে। বিশেষ করে আমাদের আইন আদালতের ভাষায়, আরবি-ফারসি-উর্দু শব্দসমূহ অন্তর্ভূক্তির ফলে বাংলা ভাষায় শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া মধ্যযুগের কবিদের রচনায়ও বহুসংখ্যক আরবি-ফারসি শব্দের প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়।

বাংলা ভাষায় আরবি ফারসি শব্দের সংখ্যা সঠিক নির্ণয় করা যায়নি। চবৎংড় Perso Arabic Elements in Bengali (ফারসো অ্যারাবিক এলিমেন্টস্ ইন বেঙ্গালী) গ্রন্থে আরবি ফারসিজাত শব্দের সংখ্যা ৫১৮৬টি বলে উল্লেখ করা হয়। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্-এর মতে দুই হাজারের বেশী। প্রকৃত অর্থে ভাষা বহতা নদীর মতো, সে তার নিজস্ব গতিতে চলে। ষাট বছর আগে ড. এনামুল হক তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেন, আরবি-ফারসি শব্দের সংখ্যা ৫,০০০। অন্য ভাষা বিজ্ঞানীদের মতে এ সংখ্যা প্রায় ৯,০০০/।

১৩ শতকে দরবারি ভাষা ফারসি থেকে বাংলা ভাষায় বিভিন্ন শব্দের আগমন ঘটে। ষোড়শ শতকের শেষ দিকে সম্রাট আকবরের সময়ে বঙ্গদেশ মোঘল সাম্রাজ্যভূক্ত হলে ফারসি শব্দ বাংলায় প্রবেশ করতে থাকে।

বাংলাপিডিয়া'য় উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাংলা ভাষায় প্রচুর ফারসি শব্দ এবং ফারসির মাধ্যমে আরবি ও তুর্কি শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটেছে; কোন কোন ক্ষেত্রে এদের প্রভাবে মূল বাংলা শব্দেরই বিলুপ্তি ঘটেছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বিলুপ্তপ্রায় কয়েকটি বাংলা শব্দ বন্ধনীতে উল্লেখ করা হলো; খরগোশ (শশারু), বাজ (সাঁচান/সয়চান), শিকার (আখেট), নালিশ (গোহারি), বিদায় (মেলানি), জাহাজ (বুহিত), হাজার (দশ শ) ইত্যাদি।

দীর্ঘকাল মুসলমান শাসনের কারণে রাজস্ব, প্রশাসন, রাজকীয় সম্ভাষণ, যুদ্ধ, ব্যবসা ইত্যাদি সংক্রান্ত বহু ফারসি শব্দ এবং ফারসির মাধ্যমে আরবি শব্দ বাংলা ভাষায় প্রবেশ করে। যেমন:- রাজস্ব, প্রশাসন ও আইনসংক্রান্ত  শব্দ- জরিমানা, জেরা, অছিয়তনামা, তামাদি, দারোগা, নালিশ, ফয়সালা, ফরিয়াদ, রায়, সালিশ, ফরমান, মুনশি, ওকালতনামা, পেশকার ইত্যাদি। রাজকীয় উচ্চপদ, যুদ্ধবিগ্রহ ও শিকারসংক্রান্ত:- জমিদার, তহশিলদার, তালুক, তালুকদার, বাদশা, বেগম, বাহাদুর, কামান, তীর ইত্যাদি। ধর্মসংক্রান্ত: খোদা, পয়গম্বর, ফিরিশতা, বেহেশত, দোজখ, মসজিদ, ঈদগাহ, খানকাহ্, দরগাহ, নামাজ, রোজা, জায়নামাজ, ওজু, গুনাহ্, নেক্কার, বদকার, পরহেজকার ইত্যাদি। শিক্ষাসংক্রান্ত:- কাগজ, বিলাসদ্রব্য, ব্যবসা ও সভ্যতার উপকরণবিষয়ক:- আতর, আয়না, গোলাপ, চশমা, দালাল, মখমল ইত্যাদি। পোষাক- পরিচ্ছদসংক্রান্ত:- আচকান, জোব্বা, চাদর, পর্দা, শালওয়ার ইত্যাদি। খাদ্যবিষয়ক:- বিরিয়ানি, গোশত, হালুয়া, কাবাব, কিমা, মোরব্বা, সবজি, কিশমিশ, বাদাম ইত্যাদি।জাতিসংক্রান্ত: হিন্দু, ফিরিঙ্গি ইত্যাদি। পেশাসংক্রান্ত: কারিগর, খিদমাতগার, চাকর, দোকানদার, বাজিকর, জাদুকর ইত্যাদি। পরিবার ও আত্মীয়সংক্রান্ত: বাবা, মা, দাদা, খালা, দোস্ত, ইয়ার ইত্যাদি। নাম সংক্রান্ত:- দিল-আফরুয, দিলরুবা, নুরজাহান, জামশীদ, রোস্তম, সোহরাব ইত্যাদি। স্থানবিষয়ক:- হাম্মামখানা, গোসলখানা, মোসাফেরখানা, ইয়াতীমখানা, কারখানা, আসমান, যমীন, বাজার ইত্যাদি।

বাংলা ভাষায় ফারসির প্রভাব:

তুর্কি-আফগানদের শাসনাধীনে বাংলার প্রশাসন হিন্দু জমিদারদের হাতে ন্যস্ত হয় এবং তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন কায়স্থ। স্বভাবতই এতদঞ্চলের জনগণের জীবন ও ভাষার ওপর সোনারগাঁও ও গৌড়ের মুসলিম দরবারের প্রভাব ছিল অতি সামান্য। বাংলায় যে-সকল মুসলমান স্থায়িভাবে বসতি স্থাপন করেছিল তারা স্থানীয় জনসাধারণ কর্তৃক প্রভাবিত হয়েছিল। পঞ্চদশ শতকের শেষ এবং ষোড়শ শতকের প্রথম ভাগে বাংলার মুসলিম বাদশাহরা বাংলা সাহিত্যের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতা করেন। উপরন্ত মুসলিম শাসনের সূচনাকালে মুসলমানদের সঙ্গে স্থানীয় জনগণের যোগাযোগের ফলে প্রচুর ফারসি শব্দ বাংলা ভাষায় অনুপ্রবেশ করে।

সম্রাট আকবর কর্তৃক বঙ্গ বিজয়ের মাধ্যমে বাংলায় মুগল শাসনের সূত্রপাত ঘটে। মুগলআমলে ফারসির প্রভাব পূর্বের তুলনায় আরও ব্যাপক হয়। ১৬০৫ খ্রিষ্টাব্দে আকবরের মৃত্যুর পর এক সাংস্কৃতিক বিবর্তন প্রক্রিয়া শুরু হয়, যার পরিণতিতে ইন্দো মুসলিম সংস্কৃতির উদ্ভব ঘটে এবং হিন্দুস্থানি/উর্দু ভাষা এর বাহন হয়। সপ্তদশ ও অষ্টদশ শতকে হিন্দুস্থানি ভাষা ভারতে ফারসি ভাষা ও ইসলামি চেতনা বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। ফলে অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে উচ্চশ্রেণীর লোকজন, এমনকি হিন্দুরাও কথ্য বাংলায় ব্যাপকভাবে ফারসি শব্দ ব্যবহার করতে থাকে। উত্তর প্রদেশ, বিহার এবং বাংলার মুনশিরা ধনিক শ্রেণীর ছেলেমেয়েদের ফারসি পড়াতেন। সেকালে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের লোকেরাই মাদ্রাসা ও মকতব প্রতিষ্ঠা করেন। ১৬৮৬ খ্রিষ্টাব্দে রচিত কৃষ্ণরাম দাসের ‘রাইমঙ্গলে’ এর প্রমাণ পাওয়া যায়: ‘অবিলম্বে উত্তরিল রাজার নগরে। বালকে পারসী পড়ে আখন হুজুরে’’।। ‘কানেতে সোনার কলম দোয়াত সম্মুখে। কিতাবত সুনিপুণ কায়স্থগণ লেখে’।। 

ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটে ইরানে। এ ভাষা চারটি পর্যায়ে বিকাশ লাভ করে:- আবেস্তা, প্রাচীন ফারসি, পাহলভি ও আধুনিক ফারসি। ফার্সি (উচ্চারণ ফোরসি) হলো মধ্য এশিয়ায় প্রচলিত ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের ইরানীয় শাখার অন্তর্ভূক্ত একটি ভাষা। পারস্যের প্রাচীন জনগোষ্ঠীর ভাষা থেকে ফারসি ভাষার উদ্ভব হয়েছে। ইরানে এটি ফর্সি বা পর্সি নামে পরিচিত। আফগানিস্তানেও এটি বহুল প্রচলিত, সেখানে এটা ‘দ্যারী’ নামে পরিচিত। ভাষাটির আরেকটি রূপ তাজিকিস্তান এবং পামির মালভূমি অঞ্চলে প্রচলিত। তাজিকিস্তানে এর সরকারি নাম তজিকী। এছাড়া উজবেকিস্তান, তুর্কেমেনিস্তান, আজারবাইজান, বাহরাইন, কাতার এবং কুয়েতেও অনেক ফার্সিভাষী লোক বসবাস করে।

বাংলা সাহিত্যে ফারসির প্রভাব

ফারসি ভাষাভাষী তুর্কি আগান বিজয়িগণ বাংলাকে তাঁদের নতুন আবাসভূমি হিসেবে গ্রহণ করেন। ফলে একটি সাংস্কৃতিক বিবর্তনের কাল সূচিত হয়। এ বিবর্তনকালে পরবর্তী সাতশ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়। পরিণতিতে বাংলা ভাষা শাসকদের শক্তিশালী ভাষার প্রভাবে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়। মুসলিম কবি ও লেখকগণ মৌলিক বাংলা সাহিত্য রচনা বা ইসলামি বিষয়াবলি বাংলা ভাষায় অনুবাদে আত্মনিয়োগ করেন। এ কারণেই বাংলা ভাষায় অসংখ্য ফারসি শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটে। উনিশ শতকের মধ্যভাগে প্রয়োজনীয় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এতদঞ্চলে ফারসি’র গুরুত্ব ধীরে ধীরে কমতে থাকে। ইংরেজী শাসনামলে ১৮৩৭ খ্রিষ্টাব্দে কাউন্সিল অব ইন্ডিয়ার প্রেসিডেন্ট একটি অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে অফিস-আদালত তথ্য রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ডে ফারসির ব্যবহার নিষিদ্ধ করেন। অধ্যাদেশটির বাতিলের দাবিতে তখনকার কলকাতার আট হাজার মুসলমান-হিন্দুরা স্বাক্ষরিত স্মারকলিপি পেশ করে ব্রিটিশ গর্ভনমেন্টের নিকট।  ঢাকা থেকেও ৪৮১ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি প্রতিবাদ জানান লিখিতভাবে। নিষিদ্ধ সত্ত্বেও অত্র এলাকায় ফারসি চর্চা অব্যাহত ছিল। শিক্ষিত বাঙালি মুসলমান জনগণ এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। মাদ্রাসা, স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ফারসি বিষয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালু থাকে। ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠালগ্ম থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফারসি ও উর্দু বিভাগ চালু হয়। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ফারসি ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে পাঠ্য ছিল। বর্তমানে সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠসূচিতে না থাকলেও ঐতিহ্যগত ভাষা ও সাহিত্য হিসেবে বাংলাদেশ ও ভারতে বিশ্ববিদ্যালয় এবং সমকালীন ভাষা হিসেবে আধুনিক ভাষা ইনষ্টিটিউটের (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) পাঠ্যসূচিতে ফারসি অন্তর্ভূক্ত রয়েছে।

রাষ্ট্রভাষা:

ছয়শত বছরের অধিককালব্যাপী (১২০১-১৮৩৭) ফারসি ছিল বাংলার রাষ্ট্রভাষা। এই দীর্ঘ সময়ে হাজার হাজার ফারসি গ্রন্থ রচিত হয়েছে। অসংখ্য কবি ফারসি ভাষায় কাব্য রচনা করেছেন। সেসব সাহিত্যকর্ম/পান্ডুলিপি অথবা গ্রন্থের আকারে বাংলাসহ সমগ্র উপমহাদেশ বিভিন্ন গ্রন্থগারে সংরক্ষিত আছে। আঠারো শতকের মধ্যভাগ থেকে উনিশ শতকের সমাপ্তিকাল পর্যন্ত ‘সুলতানুল আখবার ও দূরবীণ’ সহ পাঁচটি ফারসি দৈনিক পত্রিকা কলকাতা থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হতো। যা এতদঞ্চলে ফারসি ভাষায় জনপ্রিয়তা প্রমাণ করে।

 

লেখক:

সাংবাদিক ও গবেষক

চেয়ারম্যান, সিআরআই লিসনার্স ক্লাব অব বাংলাদেশ।

ট্যাগ