পাঠ্যবইয়ে নানা ভুল, এখন কী করণীয়: অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবইয়ে ভুলের কারণ এবং এ বিষয়ে করণীয় নিয়ে রেডিও তেহরানের সাথে কথা বলেছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড.মাহবুব উল্লাহ। পুরো সাক্ষাৎকারটি উপস্থাপন করা হলো। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।
রেডিও তেহরান: জনাব অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ, বাংলাদেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য সরকার এবার যে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করেছে তা ভুলে ভরা বলে অভিযোগ উঠেছে। আসলে কী ধরনের ভুল রয়েছে বইগুলোতে এবং কেন এই ভুল?
অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ: দেখুন, ভুল ২/৩ রকমের হতে পারে। একটা হচ্ছে ভাষা এবং তার সাথে বানান। আরেকটা হচ্ছে তথ্যগত ভুল। অর্থাৎ যা ঘটনা নয় বা সত্য নয় সেটাকে সত্য হিসাবে তুলে ধরা। তবে হ্যাঁ যেসব রচনাতে কল্পনার সুযোগ আছে অর্থাৎ যেখানে পুরো জিনিষটাই কাল্পনিক সেখানে সত্য-মিথ্যার কোনো ব্যাপার থাকে না। সাহিত্যে এ ধরনের জিনিষ আছে। কিন্তু যখন কোনো তথ্য পরিবেশন করা হবে তখন অবশ্যই সেই তথ্যের যথার্ততা যাচাই করে নিতে হবে।
আর তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছে- ভুল জিনিষটি আমরা যেভাবেই দেখি না কেন- প্রত্যেকটি কাজের পেছনে মানুষের ভাবাদর্শ কাজ করে। যারা লেখেন তাদের লেখার পেছনে এবং চিন্তার পেছনে একটা আইডিওলজি বা মতাদর্শ কাজ করে। একটা গণতান্ত্রিক সমাজে বহুরকমের মত থাকতে পারে । আর সেসব মতের প্রতিফলন কিন্তু আমরা যা কিছু পড়ি তারমধ্যে থাকতে পারে।
আর পাঠ্যপুস্তক যাদের জন্য লেখা হচ্ছে-অর্থাৎ কোন বয়সের শিশুর জন্য লেখা হচ্ছে সে বিষয়টাও বিবেচনায় নিতে হবে। যদি সেটা সঠিকভাবে বিবেচনায় না নিয়ে অপরিচিত বা উদ্ভট এবং চিন্তা ভাবনার বাইরে কিছু জিনিষ চালিয়ে দেয়া হয় তখন সেটাও শিশুদের সঠিক শিক্ষার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। আর এ ধরনের ভুল-ভ্রান্তিগুলো আসার কারণ হচ্ছে যারা এসব পাঠ্যপুস্তক রচনা করেছেন তাদের অসাবধানতা কিংবা জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা। কিংবা ছাপাখানার ভূত বলে যে কথাটা আছে সেকারণেও হতে পারে। ফলে পাঠ্যপুস্তকে ভুলের পেছনে নানা কারণ থাকতে পারে। তাছাড়া একটা পাঠ্যপুস্তক যখন রচনা করা হয় তার শেষ ধাপ যখন সম্পাদনা করা হয় তখন যদি সেই পরিষদ তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করেন এবং সর্বোপরি এনসিটিবি যে কর্তৃপক্ষ রয়েছে তারাও যদি শেষ বারের মতো সবকিছুতে চোখ বুলিয়ে না দেন তাহলেও ভুলের বা বিভ্রান্তির অবকাশ থাকে।
রেডিও তেহরান: সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় বৈষম্যমূলক বিষয় অন্তর্ভুক্তি এবং গুরুত্বপূর্ণ ও প্রগতিশীল লেখকদের লেখা বাদ দেয়াসহ নানা অসঙ্গতির কথা বলা হচ্ছে। এই অভিযোগগুলো কতটা সঠিক?
অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ: এ প্রশ্নের ক্ষেত্রে প্রথমে আমাদেরকে বুঝতে সাম্প্রদায়িকতা আসলে কী? আমাদেরকে বুঝতে হবে প্রগতিশীলতা কী? সেই সম্পর্কে যদি আমাদের সঠিক ধারনা না থাকে তাহলে যথেস্ট বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়।
এ ব্যাপারে আপনাকে আমি একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরছি। পশ্চিম বাংলা থেকে প্রকাশিত সংসদ অভিধানে ‘খালা’ শব্দটি আছে। সেখানে খালার পুং লিঙ্গে বলা হয়েছে ‘খালি’। অথচ খালি বলে কোনো শব্দ আমরা ব্যবহার করি না। এই ধরনের ভুল সংসদ অভিধানের মতো অভিধানেও আছে। আর এ ধরনের ভুলটা তখনই আসে যখন যে জনগোষ্ঠীর জন্য অভিধান রচনা করা হয়েছে তার বিভিন্ন অংশের কথাবার্তা, সংস্কৃতি এবং রীতিনীতির সঙ্গে যখন সঠিক পরিচয় না থাকে। তখনই এ ধরনের সমস্যাগুলো আসে। এছাড়াও মনোভঙ্গির একটা ব্যাপার রয়েছে। এখানে অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের একটা ব্যাপার হচ্ছে এই যে- আমরা মুসলিম যা কিছু সেটার সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতাকে যুক্ত করি বিপরীতে হিন্দুত্ববাদী বা অন্য যা কিছু তার সঙ্গে আমরা অসাম্প্রদায়িক বিষয়টি দেখি। আসলে কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা দুরকমই হতে পারে। হতে পারে সেটা মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা আবার হতে পারে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা। আর এ পুরো বিষয়টা বা দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে কিন্তু একটা রাজনীতি কাজ করে।
রেডিও তেহরান: বইয়ে ভুল ধরা পড়ার পর শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ সেগুলোকে আঠা লাগিয়ে ঢেকে দেয়ার কথা বলেছেন। ভুল সংশোধনের এই পদ্ধতি নিয়েও সমালোচনা চলছে। আপনি কীভাবে দেখছেন বিষয়টিকে?
অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ: দেখুন এ বিষয়টির সমালোচনা হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। কারণ বিনামূল্যে লক্ষ লক্ষ ছাত্র ছাত্রীকে বই বিতরণ করা হয়েছে। আর সেই সব বিতরণ করা পাঠ্যপুস্তকের ভুলগুলো আঠা লাগিয়ে শুদ্ধগুলো বসানো কতটুকু বাস্তবসম্মত সেটাও চিন্তা করার বিষয়। এটার একমাত্র সমাধান হতে পারে ভুলে ভরা যেসব বই আছে সেগুলোকে প্রত্যাহার করে নেয়া এবং একটা শুদ্ধ সংস্করণ বিতরণ করা। তবে মন্ত্রী যে ধরনের সমাধানের কথা বলেছেন সেটা সত্যিকারের সমাধান দেবে না। পুরো জিনিষটা আমার কাছে অবাস্তব বলে মনে হয়েছে।
রেডিও তেহরান: সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ছাত্ররা নতুন বছরে নতুন বই পেয়ে আনন্দ উৎসব করছে। কেবল ভুলত্রুটি নিয়ে সমালোচনা করে তাদের হতাশ করে দেয়া ঠিক নয়? মন্ত্রীর এ বক্তব্য সম্পর্কে আপনার অভিমত যদি একটু জানান।
অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ: দেখুন ভুলে ভরা বই নিয়ে ছাত্ররা উল্লাস করছে তাদের হতাশ করা ঠিক নয় বলে শিক্ষামন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন বিষয়টা আসলে সেখানেই সীমাবদ্ধ নয়। এখানে হতাশা শুধু ছাত্রদের নয় ভুলে ভরা বই এলে শিক্ষকদের জন্যও সেটা হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দেশে যারা শিক্ষাবিদ আছেন বা যারা শিক্ষার খোঁজ খবর রাখেন তাদের জন্যও এটা একটা হতাশার কারণ। ইদানিংকালে একটা বড় বিতর্ক হয়েছে সেটা হচ্ছে বাংলাদেশ শিক্ষার মান। আর সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে শিক্ষার মানে অবনতির পেছনে আমরা হয়তো অনেক কারণ খুঁজে পাব। কিন্তু তারমধ্যে একটা বড় কারণ হচ্ছে- গুণসম্পন্ন এবং মানসম্পন্ন পাঠ্যবই না লেখা হওয়া। আর সেটা হচ্ছে না বলেই কিন্তু আমাদের শিক্ষার মানকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। কাজেই আমরা চাইব কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের জন্য যেসব বই বিতরণ করা হয়েছে সেগুলো যেন সত্যিকারের মানবিক যে মূল্যবোধ, আমাদের যে সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট, আমাদের যে ইতিহাস ঐতিহ্য এগুলোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় এবং ছাত্ররা যাতে বই থেকে ভুল কিছু না শেখে।
রেডিও তেহরান: গত কয়েক বছর ধরেই নতুন বই সরবরাহের পর নানা ধরনের ভুলত্রুটির খবর বের হয়। এসব নিরসনের জন্য আসলে করণীয় কী?
অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ: প্রথমত যে বিষয়টি বলব সেটি আমি আমার নিজ জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি- আমরা যেসব পাঠ্যপুস্তক পড়েছি তাতে এধরনের ভুল ছিল না বললেই চলে। যেমন-যেখানে Hurt শব্দটির একটি সুনির্দিষ্ট অর্থ আছে। আবার Heart শব্দটিরও আরেকটি সুনির্দিষ্ট অর্থ আছে। যদিও দুটির উচ্চারণ একইরকম। এখানে যদি Hurt বদলে Heart লিখে ফেলে তখন সেটা যে কতবড় ভুল হয় সেটি ইংরেজি ভাষা যারা জানেন তারা খুব সহজেই বুঝতে পারেন। আর এরকম একটি ভুল কিন্তু নিছক ছাপার ভুল নয়। নিসন্দেহে এ ধরনের ভুলটা মূল যে লিখিত ভাষ্য সেখানে থাকার ফলেই কিন্তু এ ভুলটা হয়েছে। এ ধরনের ভুলকে খুব মারাত্মক ভুল হিসেবেই চিহ্নিত করব। আর এটা যিনি বই সম্পাদনা করেছেন তিনি হয় সাবধানতা অবলম্বন করেননি অথবা তাঁদের মধ্যে জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা রয়েছে।#
পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/১৫