ইয়েমেনিদের শক্ত হামলায় স্তম্ভিত সৌদি শাসকগোষ্ঠী: চিন্তিত আমেরিকা
https://parstoday.ir/bn/news/west_asia-i74311-ইয়েমেনিদের_শক্ত_হামলায়_স্তম্ভিত_সৌদি_শাসকগোষ্ঠী_চিন্তিত_আমেরিকা
ইয়েমেনের সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইয়াহিয়া সারি সম্প্রতি সৌদি আরবের বিরুদ্ধে 'নাসরুম মিনাল্লাহি' অর্থাৎ 'আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য' নামে অভিযান চালানোর খবর দিয়েছেন।
(last modified 2025-09-29T12:37:45+00:00 )
অক্টোবর ০৮, ২০১৯ ১৭:৩২ Asia/Dhaka
  • জেনারেল ইয়াহিয়া সারি
    জেনারেল ইয়াহিয়া সারি

ইয়েমেনের সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইয়াহিয়া সারি সম্প্রতি সৌদি আরবের বিরুদ্ধে 'নাসরুম মিনাল্লাহি' অর্থাৎ 'আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য' নামে অভিযান চালানোর খবর দিয়েছেন।

ইয়েমেনের বিরুদ্ধে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের সামরিক আগ্রাসন শুরুর ৫৫তম মাসে এ হামলা চালানো হয়েছে। নানা কারণে ইয়েমেনিদের এ অভিযানের ব্যাপক গুরুত্ব রয়েছে। ইয়েমেনের সেনা ও স্বেচ্ছাসেবী গণবাহিনী বিমান প্রতিরক্ষা বাহিনীর সহায়তায় ওই হামলা চালায়। একদিকে, বিমান প্রতিরক্ষা বাহিনীর সহযোগিতায় এটি ছিল স্থল অভিযান।  সৌদি আরব সাধারণত স্থল যুদ্ধে খুব একটা আগ্রহী হয় না কারণ স্থল যুদ্ধে অংশ নেয়ার মতো পর্যাপ্ত সেনা তাদের নেই। অন্যদিকে, ইয়েমেনের বিভিন্ন বাহিনীর সমন্বিত অভিযান সৌদি আরবকে হতবাক ও বিস্মিত করেছে। এ অভিযান থেকে বোঝা যায়, ইয়েমেনিরা সৌদি আরবের বিরুদ্ধে স্থল ও সম্মুখ যুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত এবং তারা যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী। কিন্তু এ ধরনের প্রস্তুতি কিংবা আত্মবিশ্বাস সৌদি নেতৃত্বাধীন ভাড়াটে সেনাদের নেই। সৌদি আরবের বিরুদ্ধে এ অভিযান এ কারণে গুরুত্বপূর্ণ যে এরফলে সৌদি বাহিনী ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। ইয়েমেনের সেনা ও আনসারুল্লাহ বাহিনীর এ হামলায় সৌদি সেনাবাহিনীর তিনটি ব্রিগেড ধ্বংস হয়েছে। এ ছাড়া, বহু অস্ত্র উদ্ধার ও  হাজার হাজার সেনাকে বন্দী করা করা হয়েছে।

এর কিছুদিন আগে সৌদি আরবের আরামকো তেল স্থাপনায় ইয়েমেনি যোদ্ধাদের ড্রোন হামলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ইয়েমেনিরা ওই হামলার দায় স্বীকার করলেও সৌদি আরব ও তার মিত্ররা এর জন্য কোনো প্রমাণ ছাড়াই সরাসরি ইরানকে দায়ী করে ইয়েমেনিদের হামলার সক্ষমতাকে ছোট করে দেখানোর চেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু ড্রোন হামলা রেশ কাটতে না কাটতেই ইয়েমেনি যোদ্ধারা সৌদি আরবের বিরুদ্ধে 'নাসরুম মিনাল্লাহি' অর্থাৎ 'আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য' নামে বড় ধরণের স্থল অভিযান চালায়। এ হামলার মাধ্যমে তারা সৌদি আরবের অবজ্ঞাসূচক কথাবার্তার উপযুক্ত জবাব দেয়।

সৌদি তেলক্ষেত্রে ইয়েমেনিদের হামলা

ইয়েমেনিদের এ অভিযানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে এর মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব যা সৌদি আরবের বিরুদ্ধে গেছে। এতে সৌদি সেনাদের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এ অভিযান চালানোর আগে ইয়েমেনিরা গত ছয় মাস ধরে তথ্য সংগ্রহ করেছে। ইয়েমেনিরা সৌদি আরবকে এটা বুঝিয়ে দিয়েছে যে, সমস্ত সামরিক অভিযান তারাই চালিয়েছে। কারণ স্থল যুদ্ধ হওয়ায় সৌদি আরব তাদের এ পরাজয়ের জন্য অন্য কোনো দেশকে দায়ী করতে পারেনি। এমনকি হামলা চালানোর পর ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত সৌদিরা কোনো মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকে।

'নাসরুম মিনাল্লাহি' অর্থাৎ 'আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য' নামে অভিযান চালিয়ে ইয়েমেনিরা সৌদি আরবকে বেশ কয়েকটি বার্তা দিয়েছে। প্রথমত বার্তা হচ্ছে, সৌদি আরব টাকা দিয়ে যুদ্ধসহ সব কিছুতে বিজয়ী হতে চায়। কিন্তু তাদের এটা জেনে রাখা উচিত অর্থ দিয়ে যুদ্ধের ময়দানে ভাড়াটে সেনাদের মনোবল চাঙ্গা রাখা যায় না এবং জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করতে তাদেরকে বাধ্য করা যায় না। এ কারণে ইয়েমেনিদের হামলায় বহু সৌদি ভাড়াটে সেনা পালিয়ে গেছে, কেউ মারা পড়েছে এবং অন্তত দুই হাজার সেনা গ্রেফতার হয়েছে।

সৌদি আরবের জন্য দ্বিতীয় বার্তা হচ্ছে, ইয়েমেনিরা আত্মরক্ষার পর্যায় অতিক্রম করে এখন পাল্টা হামলা চালানোর মতো যোগ্যতা অর্জন করেছে। এ থেকে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের বোঝা উচিত যুদ্ধের ওপর নিয়ন্ত্রণ কিংবা এর গতিপ্রকৃতি নির্ধারণের অবস্থায় তারা নেই বরং তারা যুদ্ধের অবসান ঘটাতে বাধ্য। এর অন্যথায় সৌদি আরবকে আরো দুঃখজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। ইয়েমেনের আনসারুল্লাহ আন্দোলনের মুখপাত্র আব্দুস সালাম বলেছেন, আগ্রাসন অব্যাহত থাকলে সৌদি আরবকে আরো বড় ব্যর্থতার সম্মুখীন হতে হবে।

সৌদি আরবের জন্য তৃতীয় বার্তা হচ্ছে, হুমকি বাস্তবায়নে ইয়েমেনিদের সক্ষমতা। সৌদি আরবের আরামকো তেল স্থাপনায় ড্রোন হামলার পর সৌদি আরব ইয়েমেনের আবাসিক এলাকায় কয়েক দফা বিমান হামলা চালায়। সে সময় আনসারুল্লাহ বাহিনীর কমান্ডাররা সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, সৌদি আগ্রাসন অব্যাহত থাকলে তারাও উপযুক্ত জবাব দেবে। শেষ পর্যন্ত সৌদি বাহিনীর তিনটি ডিভিশন ধ্বংস করে এবং হাজার হাজার সেনা আটক কোরে ইয়েমেনিরা তাদের শক্তির প্রমাণ দিয়েছে। ইয়েমেনিরা এও দেখিয়ে দিয়েছে তারা কেবল মুখে হুমকি দেয় না বাস্তবায়নও করে।

ইয়েমেনিদের ড্রোন হামলা

সৌদি আরব ও তার মিত্রদের জন্য চতুর্থ বার্তা হচ্ছে, প্রতিরোধ যোদ্ধারাই বিজয়ী এবং আমেরিকা ও তার মিত্রদের আগ্রাসী নীতি ব্যর্থ হবে। ইয়েমেনি যোদ্ধাদের হাতে হাজার হাজার সৌদি সেনা আটকের ঘটনা এর প্রমাণ। এ ঘটনা অপর আগ্রাসী দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতের জন্যও হুঁশিয়ারি সংকেত। আমিরাতেরও উচিত আগ্রাসন বন্ধ করা। কেননা আমিরাতের বহু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও অবকাঠামো ইয়েমেনি যোদ্ধাদের ক্ষেপণাস্ত্রের আওতায় রয়েছে।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সৌদি আরবের বিরুদ্ধে 'আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য' নামে অভিযানের বেশ কিছু প্রভাব রয়েছে। প্রথমত, ইয়েমেনিদের এ হামলা সৌদি শাসকগোষ্ঠী ও সেনাবাহিনীকে হতাশ ও বিচলিত করে তুলেছে। 'আল-নাশরা' ওয়েব সাইটের এক প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, "দু'টি তেল স্থাপনায় ইয়েমেনিদের হামলায় যদি সৌদি আরবের ৫০ শতাংশ তেল উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়, যদি তাদের যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া জন্য অস্ত্র কেনার মতো  অবস্থাও না থাকে এবং নাজরানের স্থল যুদ্ধে এতোবড় পরাজয়ের ঘটনা যা কিনা সৌদি সামরিক ও শাসকবর্গকে স্তম্ভিত করে দিয়েছে এবং এমনকি ওয়াশিংটনকেও চিন্তিত করে তুলেছে তাহলে বলা যায় ইয়েমেনিদেরকে খাটো করে দেখার আর কোনো সুযোগ নেই।"

ইয়েমেনিদের সফল সামরিক অভিযানের দ্বিতীয় প্রভাব হচ্ছে, এর ফলে সৌদি জোটের সদস্যদের মধ্যে মারাত্মক ভাঙন ধরেছে। কারণ শরীকরা নিশ্চিত হয়ে গেছে এ যুদ্ধে তাদের পরাজয় অবধারিত। এর আগে সৌদিতে ইয়েমেনিদের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় আমিরাত বুঝতে পেরেছে তারা বিজয়ী হতে পারবে না। ফলে তারা অনেক সেনা প্রত্যাহার করে নিয়েছিল।

সামরিক অভিযানের তৃতীয় প্রভাব হচ্ছে, এ অভিযান ইয়েমেনি যোদ্ধাদের মধ্যে মনোবল বৃদ্ধির পাশাপাশি নিজেদের শক্তি-সামর্থ্যের প্রতি তাদের আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে। বিশেষ করে নাজরানের বিমানবন্দরসহ বিশাল এলাকার ওপর নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হওয়ায় তারা আরো বেশি আশাবাদী হয়ে উঠেছে। নাজরান দখল করে তারা যুদ্ধের গতিপ্রকৃতিই পাল্টে দিয়েছে। এ অবস্থায় ইয়েমেনের আনসারুল্লাহ ও তার মিত্রদের উপেক্ষা করার সুযোগ নেই সৌদি আরবের।

চতুর্থ প্রভাব হচ্ছে, ইয়েমেনিদের এ অভিযানের ফলে সৌদি আরব এখন যুদ্ধ বন্ধ করতে বাধ্য হবে। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান এরই মধ্যে আনসারুল্লা যোদ্ধাদের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবকে রাজনৈতিক আলোচনা শুরুর জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে অভিহিত করেছেন।

যাইহোক, সৌদি আরব ইয়েমেনের আনসারুল্লা আন্দোলনকে অবৈধ বলে মনে করে। কিন্তু সেই আনসারুল্লাহর যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়ে সৌদি আরব প্রকারান্তরে আনসারুল্লাহকে বৈধ শক্তি হিসেবে শিকার করে নিয়েছে। #

পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/৮