ইউরোপের অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা: ইসরায়েলের সামরিক অর্থনীতিতে নজিরবিহীন ধাক্কা
-
ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভ
পার্সটুডে: চুক্তি বাতিল এবং নিষেধাজ্ঞার কারণে ইসরায়েলি অর্থনৈতিক স্তম্ভ হিসেবে পরিচিত 'অস্ত্রবাণিজ্য' এক বিলিয়ন ডলারের রাজস্ব ক্ষতির ঝুঁকির সম্মুখীন হয়েছে।
ফার্স নিউজ এজেন্সির উদ্ধৃতি দিয়ে পার্সটুডে জানিয়েছে, ইসরায়েলের অস্ত্রশিল্প, যা বহুদিন ধরে দেশটির অর্থনৈতিক আয়ের প্রধান উৎস এবং রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, বর্তমানে এক নজিরবিহীন চ্যালেঞ্জের মুখে। নতুন নিষেধাজ্ঞা ও সামরিক চুক্তি বাতিলের ঢেউ এই খাতের ভবিষ্যতের ওপর গভীর ছায়া ফেলেছে।
ইউরোপ থেকে বিলিয়ন ইউরোর চুক্তি বাতিল
ইসরাইলের বিশেষায়িত অর্থনৈতিক দৈনিক 'ক্যালকালিস্ট'-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, গাজা যুদ্ধের বিরুদ্ধে জনগণের চাপ ও বিক্ষোভের মুখে, গত কয়েক মাসে ইসরাইলের প্রায় ৬০০ মিলিয়ন ইউরোর অস্ত্র চুক্তি বাতিল হয়েছে এবং কয়েক বিলিয়ন ডলারের চুক্তি হারানোর ঝুঁকিও এই রাষ্ট্রকে হুমকির মুখে ফেলেছে। বিশেষভাবে, স্পেন সরকার গত কয়েক মাসে 'রাফায়েল'-এর মতো বড় ইসরাইলি কোম্পানিগুলোর সাথে তাদের বেশ কয়েকটি অস্ত্র চুক্তি বাতিল করেছে। মাত্র একটি ক্ষেত্রে, স্পেন আনুষ্ঠানিকভাবে নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার পর এই কোম্পানি থেকে অস্ত্র আমদানির ২০৭ মিলিয়ন ইউরোর একটি চুক্তি বাতিল করেছে। এই চুক্তিগুলোতে বিভিন্ন ধরনের এয়ার গাইডেন্স সিস্টেম, স্পাইক মডেলের অ্যান্টি-ট্যাঙ্কএ ক্ষেপণাস্ত্র, রকেট লঞ্চার এবং ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র অন্তর্ভুক্ত ছিল, যা ইসরাইলের জন্য উল্লেখযোগ্য আয়ের উৎস।
রাজনৈতিক চাপের হাতিয়ার হিসেবে নিষেধাজ্ঞা
এই চুক্তি বাতিল ও নিষেধাজ্ঞাগুলোকে স্পেন সরকারের রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের কৌশল হিসেবে দেখা হচ্ছে—যাতে ইসরায়েলকে গাজায় সামরিক অভিযান থামাতে এবং 'গণহত্যা' বন্ধে বাধ্য করা যায়।
স্পেন শুধু অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা জারি করেনি, বরং ইসরায়েলের উদ্দেশ্যে কাঁচামাল রপ্তানি সীমিত করেছে, জাহাজ চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে এবং অবৈধ ফিলিস্তিনি বসতি থেকে আসা পণ্যের আমদানি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে। এই পদক্ষেপগুলো সম্প্রতি রাজকীয় ফরমানের মাধ্যমে আইনগতভাবে কার্যকর হয়েছে। ইউরোপে বাড়তে থাকা এ ধরনের পদক্ষেপ ইসরায়েলকে ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক একঘরেমির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা শিল্পের সতর্কবার্তা
ইসরায়েলের সরকারি প্রতিরক্ষা শিল্প সংস্থা সতর্ক করেছে যে, নতুন চুক্তির বাতিল বা স্থগিতকরণ দেশটির অর্থনীতিতে বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি বয়ে আনবে। এই সমস্যা বিশেষভাবে রাফায়েল, 'এলবিট' এবং ইসরাইল এরোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজের মতো বড় কোম্পানিগুলোর জন্য সংকট সৃষ্টি করছে।
প্রযুক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় ধাক্কা
অন্য এক ঘটনায়, মার্কিন কোম্পানি মাইক্রোসফট ঘোষণা করেছে যে, তারা ইসরায়েলের গোয়েন্দা শাখা 'ইউনিট ৮২০০'-কে আর কোনো ক্লাউড ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সেবা দেবে না। এই পদক্ষেপটি ফিলিস্তিনিদের উপর নজরদারির জন্য প্রযুক্তির অপব্যবহারের অভিযোগ প্রকাশ্যে আসার পর নেওয়া হয়েছে। এটিকে ইসরায়েলের সামরিক প্রযুক্তি খাতের ওপর আন্তর্জাতিক চাপের প্রতীক হিসেবে দেখা হচ্ছে।
অস্ত্রশিল্প: অর্থনীতি ও প্রভাবের স্তম্ভে ফাটল
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা শিল্প প্রতি বছর ১০ থেকে ১২ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে অবদান রাখে। এ খাত শুধু হাজার হাজার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান তৈরি করে না, বরং বিশ্বের ৭০টিরও বেশি দেশে অস্ত্র রপ্তানির মাধ্যমে তেল আবিবের রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারেও বড় ভূমিকা পালন করে। রাফায়েল, এলবিট সিস্টেমস এবং ইসরায়েল এয়ারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ এ খাতের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়।
তবে বহু বছর ধরে অর্থনৈতিক শক্তি ও সামরিক সক্ষমতার প্রতীক হিসেবে পরিচিত এই খাত এখন বড় ধরনের ক্ষতির মুখে। চুক্তি বাতিল, নিষেধাজ্ঞা ও আন্তর্জাতিক সীমাবদ্ধতা শুধু বিশাল আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়নি, বরং 'মাঠে পরীক্ষিত অস্ত্র' হিসেবে যে ভাবমূর্তি তেল আবিব প্রচার করত, সেটিকেও গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
ফলে, ইসরায়েলের এই সংবেদনশীল ও কৌশলগত অর্থনৈতিক খাতের ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চয়তার মুখে। বড় বড় প্রতিরক্ষা কোম্পানিগুলোকে নতুন করে তাদের রপ্তানি নীতি ও আন্তর্জাতিক কৌশল পর্যালোচনা করতে বাধ্য করা হচ্ছে।#
পার্সটুডে/এমএআর/২৯
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।