পরিবারের ধ্বংস সাধন কেনো পশ্চিমাদের লক্ষ্য?
পরিবার-ব্যবস্থা ধ্বংসের বিশ্বযুদ্ধ
যৌন বিচ্যুতিমূলক আদর্শ প্রচার করা এবং পরিশুদ্ধ জীবনধারাকে (পারিবারিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা জীবনধারা) প্রশ্নবিদ্ধ করা পাশ্চাত্যের অনেক সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সুদূরপ্রসারি ষড়যন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য ও স্পষ্ট অংশ হয়ে উঠেছে।
একইসঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কের কদর্যতাকে এবং মানবীয় ও মানবিক প্রকৃতির পরিপন্থী বিষয়গুলোকে স্বাভাবিক বিষয়ে রূপান্তরিত করা ধর্মবিরোধী ও অবিশ্বাসীদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মতাদর্শিক স্বৈরতন্ত্র
হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ড কেবলমাত্র সমকামিতাসহ অন্যান্য বিকৃত যৌনাচারি জীবনধারা মেনে নেয়ার ব্যাপারে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্দেশিত মডেলগুলি গ্রহণ না করায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে আর্থিক সহায়তা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছে; এমনকি প্রাপ্ত প্রমাণ ও নথি অনুসারে, বিকৃত যৌনাচারে লিপ্ত গোষ্ঠীগুলোর অধিকার এবং তাদের অবাধ কার্যকলাপে বাধা না দেয়ার জন্য জাতিসংঘের কিছু সংস্থার পক্ষ থেকে মুসলিম দেশগুলিও চাপের মুখে রয়েছে।
আমরা যখন এই কুরুচিপূর্ণ খেলার উপাদানগুলিকে পাশাপাশি রাখি, তখন একটি বিকৃত কিন্তু উদ্দেশ্যমূলক চিত্র আমাদের সামনে প্রতিভাত হয়ে ওঠে! আর সেটি হচ্ছে, পারিবারিক কাঠামোর বিরুদ্ধে একটি বিশ্বযুদ্ধের পরিকল্পনা, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কয়েকটি ইউরোপীয় দেশের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক, সরকারি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানে প্রস্তুত করা হয়েছে এবং অঘোষিতভাবে কিন্তু লক্ষণীয় উপায়ে বাস্তবায়িত হচ্ছে।
পরিবারিক কাঠামোর বিরুদ্ধে বিশ্বযুদ্ধকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে:
কেন এই আগ্রাসন?
প্রথমেই আসে পরিবারের ওপর হামলার কারণ। মানব সমাজের সবচেয়ে খাঁটি এবং মৌলিক কেন্দ্র হিসেবে মানুষের সহজাত মূল্যবোধ লালনের উত্সভূমি হচ্ছে পরিবার।
পরিবার হলো সবচেয়ে বড় নৈতিক মানবিক প্রতিষ্ঠান। পরিবার মানুষের আবেগ অনুভূতি প্রকাশের প্রধানতম এবং অন্তরঙ্গ কেন্দ্র। শিশুর শিক্ষা ও বেড়ে ওঠার প্রথম এবং সবচেয়ে খাঁটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে এই পরিবার। পাশ্চাত্য যদি একটি সমাজকে এই মূল্যবান প্রতিষ্ঠান থেকে বঞ্চিত করতে পারে, তবে তারা ওই সমাজকে মৌলিকতা, পরিচয় এবং আধ্যাত্মিকতা শূন্য করে দিতে সক্ষম হবে।
এক্ষেত্রে, মানবতা এমন কিছু মানবসদৃশ যন্ত্রের মুখোমুখি হয় যেগুলি ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিদের তৈরি করা মূল্যবোধের সঙ্গে যেকোন কিছু মেনে নিতে বাধ্য হয়৷ বিশ্বকে যদি নৈতিকতা এবং আধ্যাত্মিকতা বিবর্জিত একটি স্থানে পরিণত করা যায় তাহলে সেখানে মানুষকে শোষণ করার এবং জৈবিক চাহিদা পূরণের অবাধ সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব হবে।
যুদ্ধের পরিধি
দ্বিতীয় বিষয় এই যুদ্ধের পরিধি। শিরোনাম থেকে বোঝা যায়, এই আক্রমণ বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত।
বহু বছর আগে, যখন পাশ্চাত্যে নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধকে নাস্তিকতা (অথেইজম), অবাধ ইন্দ্রীয়সুখবাদ (হেডোনিজম) এবং ব্যক্তিক স্বেচ্ছাচারিতাবাদ তথা লক্ষ্যহীনতাবাদ ( অন্য কথায় নিহিলিজম বা সব কিছুকেই অর্থহীন বলে ভাবে যে নাস্তিক্যবাদ) আকারে হত্যা করা হচ্ছিল, তখন কেউ কল্পনাও করতে পারেনি যে, এই আক্রমণের পরিধি এতটা বিস্তৃত হবে এবং মূল্যবোধহীনতা মূল্যবোধে রূপ নেবে ও সমাজবিরোধী কার্যকলাপগুলো সামাজিক কার্যকলাপের মর্যাদা পাবে এবং তা গোটা বিশ্বকে গ্রাস করে ফেলবে।
যৌন বিচ্যুতি ও যৌন বিকারগ্রস্ত কার্যকলাপকে সমর্থনের মাধ্যমে পরিবারিক কাঠামোর উপর পাশ্চাত্যের এই আক্রমণ একটি নির্দিষ্ট ভৌগলিক সীমারেখায় আবদ্ধ নয়। যেমনটি আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, এখানে আমরা একটি সর্বগ্রাসী ও বৈশ্বিক যুদ্ধের মুখোমুখি যেখানে প্রতিটি জাতি ও ধর্মকে কোনো না কোনোভাবে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে।
এখানে যুদ্ধের সুদূরপ্রসারি লক্ষ্য এবং শত্রুর কমান্ড সেন্টারের মধ্যে কোনো বিরোধ বা পার্থক্য নেই। তবে প্রতিটি ধর্ম, সংস্কৃতি এবং জাতির মোকাবেলায় তাদের ব্যবহৃত যুদ্ধাস্ত্র ও সরঞ্জামগুলি আলাদা। আমাদেরকে আগে শত্রুর ষড়যন্ত্রের প্রকৃতি এবং এর উপাদানগুলি উপলব্ধি করতে হবে। আর তা করতে পারলেই পরিবারিক কাঠামোর বিরুদ্ধে শত্রুর বিশ্বগ্রাসী সার্বিক ষড়যন্ত্র বুঝে ওঠা সম্ভব হবে।
নারীর ভূমিকা
তৃতীয় বিষয়টি হলো, পরিবারের মূল কেন্দ্র হিসেবে নারীর ভূমিকার প্রতি মনোযোগ দেয়া। নারী যেহেতু একটি পরিবারে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে, তাই নারীর সহজাত মূল্যবোধকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে বেছে নিয়েছে পাশ্চাত্য।
একটি সমাজের নারী যদি তার সহজাত মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলে, তাহলে তার পক্ষে আর পরিবারে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করা সম্ভব হবে না বরং সে পারিবারিক মূল্যবোধের পতন ঘটাবে। স্বাধীনতা ও নারী অধিকারের ভিত্তিহীন স্লোগান দিয়ে নারীদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশে নৈতিকতাবিরোধী যে স্রোত বইছে তার মূলে রয়েছে এই বিষয়টি।
আমাদের কর্তব্য
শেষ বিষয়টি পারিবারিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতার শত্রুদের ঘোষিত যুদ্ধের মোকাবিলায় আমাদের কর্তব্য সম্পর্কিত। শত্রুর ষড়যন্ত্র সঠিকভাবে উপলব্ধি, সজ্ঞানে শত্রুর চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের মোকাবেলায় কার্যকর আক্রমণাত্মক ও প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং মানব প্রকৃতি ও পারিবারিক কাঠামোকে রক্ষা করার লক্ষ্যে একটি বৈশ্বিক অবকাঠামো তৈরির ভিত্তিতে এই কর্তব্য নির্ধারণ করা সম্ভব।
বিশ্বের আলাদা আলাদা অঞ্চলে বসবাস করা সত্ত্বেও যেসব পরিবার ও জনগোষ্ঠী একটি সুস্থ নৈতিক জীবন যাপন করতে চায় তাদের উচিত ভৌগলিক ও ধর্মীয় পরিচিতির ঊর্ধ্বে উঠে মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া এবং পারিবারিক প্রতিষ্ঠান ও এর প্রকৃতির শত্রুদের বিপজ্জনক খেলায় জড়িত হওয়া থেকে বিরত থাকা; যাতে তারা নিজেদের এবং তাদের সন্তানদের জন্য একটি সুস্থ জীবনাদর্শ রক্ষা করার পাশাপাশি এই মূল্যবোধগুলি ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে স্থানান্তর করে যেতে পারে।
এই বিষয়ে কার্যকর সমাধানগুলির একটি হল বিশ্বব্যাপী স্বাধীনচেতা দেশ ও জাতিগুলির পক্ষ থেকে পারিবারিক কাঠামা সুরক্ষা করার জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান গঠন করা।
লেখক: হুজ্জাতুল ইসলাম ড. মোহাম্মদ মাহদি ঈমানিপুর,
ইসলামী আইনের অধ্যাপক।
পার্সটুডে/এমএমআই/এমএএইচ/২৪
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।