পশ্চিমাদের নিরাপত্তা গ্যারান্টির প্রতি আফ্রিকার দেশগুলোর কেন আস্থা নেই?
আফ্রিকায় পশ্চিমা সামরিক ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের ইতিহাস নব্য-ঔপনিবেশিকতা এবং এই মহাদেশের সম্পদ শোষণ করার ধারাবাহিকতার প্রতি নির্দেশ করে। এসব হস্তক্ষেপ শান্তি ও স্থিতিশীলতা তো প্রতিষ্ঠা করেইনি বরং আফ্রিকাকে আরও বেশি অস্থিতিশীলতা এবং পরনির্ভরতা দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে।
ইতিহাসজুড়ে আফ্রিকান দেশগুলো সন্ত্রাস, গৃহযুদ্ধ এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাসহ অসংখ্য চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। পশ্চিমা শক্তিগুলো বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স এবং ব্রিটেনের মতো সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নামে এবং শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার দাবি করে আফ্রিকান দেশগুলোর সঙ্গে অসংখ্য সামরিক চুক্তি করেছে। কিন্তু এই চুক্তিগুলো কাঙ্খিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন তো করতে পারেইনি বরং আফ্রিকা বৃহত্তর অস্থিশীলতার দিকে পরিচালিত হওয়া হওয়ার পাশাপাশি এই মহাদেশটি আরো বেশি মাত্রায় পাশ্চাত্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠে।
সন্ত্রাসের সুযোগ
ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো, নাইজেরিয়া, লিবিয়া, মালি, সোমালিয়া এবং সুদানের মতো দেশগুলো সন্ত্রাসবাদসহ নানা মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। ওয়াহাবি চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত সালাফি-জিহাদি সংগঠনগুলো বিশেষ করে আল-কায়েদা এবং আইএসআইএলের মতো উগ্র গোষ্ঠীগুলো এই দেশগুলোর অস্থিতিশীলতার জন্য প্রধান ভূমিকা পালন করছে। এসব উগ্র গোষ্ঠীগুলো সেখানে তাদের প্রভাব বিস্তার করার লক্ষ্যে কাঠামোগত ও সামাজিক দুর্বলতা ব্যবহার করে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে পশ্চিমা দেশগুলো এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে সামরিক সহায়তা প্রদান এবং সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান পরিচালনার চুক্তি সম্পাদন করেছে যা প্রায়শই ব্যর্থ হয়েছে।
সম্পদের আধিপত্য
পাশ্চাত্যের ঔপনিবেশিকতার প্রভাব সম্পর্কে একটি সাক্ষাৎকারে সিয়েরা লিওনের প্রেসিডেন্টের স্ত্রী ফাতিমা মাদা বলেছিলেন, "আমাদের দেশের খনিজ সম্পদ সমস্ত মানুষের চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমাদেরকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয় না। এসব সম্পদ হাতিয়ে নিতে বড় শক্তিগুলো সব সময় বিশৃঙ্খলা ও বিরোধীদের সমর্থন দিয়ে দেশের উন্নয়নে বাধা দেয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি ঔপনিবেশিক স্বার্থ বজায় রাখতে এবং মহাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ শোষণের জন্য আফ্রিকায় অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিতে পশ্চিমা শক্তিগুলোর ধ্বংসাত্মক ভূমিকা দেখা যায়।
ঔপনিবেশিক সীমানা
আফ্রিকায় ইউরোপীয় উপনিবেশ ১৬ শতকে শুরু হয়েছিল এবং বার্লিন সম্মেলনের (১৮৮৪-১৮৮৫) মাধ্যমে শেষ হয়েছিল। এই সম্মেলনে ইউরোপীয় দেশগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে আফ্রিকাকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। এই বিভাজন আফ্রিকার বিদ্যমান জাতিগত, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক সীমানাকে উপেক্ষা করেছে এবং কৃত্রিম সীমানা তৈরির দিকে পরিচালিত করেছে যার ফলে এই মহাদেশ অনেক সংঘাতের উৎস হতে চলেছে।
হস্তক্ষেপের ধারাবাহিকতা
আফ্রিকান দেশগুলোর আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার পর সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো সামরিক ও অর্থনৈতিক চুক্তির মাধ্যমে তাদের প্রভাব বজায় রাখার চেষ্টা করেছিল। আত্তীকরণ নীতি এবং সামরিক চুক্তি ব্যবহার করে ফ্রান্স আফ্রিকান দেশগুলির সামরিক ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রেখেছে। ফ্রান্স এবং এর সাবেক উপনিবেশগুলোর মধ্যে সামরিক চুক্তি ফ্রান্সকে এই দেশগুলোতে তার সামরিক উপস্থিতি বজায় রাখতে এবং প্রয়োজনে সামরিক হস্তক্ষেপ করার অনুমতি দেয়। উদাহরণস্বরূপ, আইভরি কোস্ট গৃহযুদ্ধের সময় (২০০৪-২০০২) বিরোধপূর্ণ পক্ষগুলোর একটির পক্ষে ফ্রান্সের সামরিক হস্তক্ষেপ এই ধরণের চুক্তির একটি স্পষ্ট উদাহরণ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০১৮ সালে ঘানার সাথে চুক্তির মতো সামরিক চুক্তিগুলা ব্যবহার করে আফ্রিকাতে তার সামরিক প্রভাব প্রসারিত করার চেষ্টা করছে। চুক্তিগুলো ঘানার অভ্যন্তরে ব্যাপক প্রতিবাদের সম্মুখীন হয়েছে। স্থানীয় সরকারের কাছ থেকে অনুমোদনের প্রয়োজন ছাড়াই মার্কিন সৈন্যদের ঘানার মাটিতে সামরিক অভিযান মোতায়েন এবং পরিচালনা করার অনুমতি দেয়া হয়। এসব চুক্তির সমালোচকরা এগুলোকে জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে মনে করেন।
সামরিক হস্তক্ষেপ
২০১১ সালে লিবিয়ায় ন্যাটোর সামরিক হামলা যার ফলে মুয়াম্মার গাদ্দাফির পতন এবং মৃত্যু হয়েছিল এটি পশ্চিমা সামরিক হস্তক্ষেপের একটি উদাহরণ যা স্থিতিশীলতার পরিবর্তে আরও বিশৃঙ্খলা ও অস্থিতিশীলতার দিকে লিবিয়াকে ঠেলে দিয়েছে। এই হামলার পর লিবিয়া একটি ব্যর্থ দেশে পরিণত হয়েছে এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী ও মিলিশিয়া গোষ্ঠী দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। এই অস্থিতিশীলতা আফ্রিকা অঞ্চলে ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলেছে এবং এই অঞ্চলকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর প্রভাব বিস্তারের দিকে নিয়ে গেছে।
আফ্রিকায় পশ্চিমা সামরিক ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের ইতিহাস নব্য-ঔপনিবেশিকতা এবং এই মহাদেশের সম্পদ শোষণ করার ধারাবাহিকতার প্রতি নির্দেশ করে। এসব হস্তক্ষেপ শান্তি ও স্থিতিশীলতা তো প্রতিষ্ঠা করেই নি বরং আফ্রিকাকে আরও বেশি অস্থিতিশীলতা এবং পরনির্ভরতা দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। এসব কারণে আফ্রিকান দেশগুলো পশ্চিমের নিরাপত্তা গ্যারান্টিগুলোতে আস্থা রাখতে পারে না এবং তাদের নিরাপত্তা বিশেষ করে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য তারা এখন আঞ্চলিক পর্যায়ে বাস্তব ও পারস্পরিক সহযোগিতা প্রতিষ্ঠা করতে চায়।#
পার্সটুডে/এমবিএ/১৮
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।