বিশ্লেষণ:
ট্রাম্প কি বিশ্বে শান্তি আনছেন না কেবলই হৈচৈ আর বাগাড়ম্বর করছেন?
-
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প
পার্সটুডে-মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করছেন যে তিনি বিশ্বের অনেক আন্তর্জাতিক সংঘাতের অবসান ঘটিয়েছেন।
আমেরিকান ম্যাগাজিন "ফরেন পলিসি" সম্প্রতি একটি নিবন্ধে লিখেছে: সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বারবার দাবি করেছেন যে তিনি বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংঘাতের অবসান ঘটাতে এবং শান্তি চুক্তিতে মধ্যস্থতা করতে সক্ষম হয়েছেন।
ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ভলোদিমির জেলেনস্কির সাথে কথোপকথনে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন: "আমি ছয়টি যুদ্ধের অবসান ঘটিয়েছি," কিন্তু পরের দিন একট টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে তিনি সংখ্যাটি ''সাত"-এ উন্নীত করেন। এই নিবন্ধটি এই দাবিটি পরীক্ষা করে দেখাচ্ছে।
ভারত ও পাকিস্তান; ট্রাম্পের ভূমিকা অস্বীকার
২০২৫ সালের মে মাসে ট্রাম্প ঘোষণা করেন যে মার্কিন-মধ্যস্থতায় দীর্ঘ আলোচনার পর, ভারত ও পাকিস্তান "তাৎক্ষণিক এবং সম্পূর্ণ যুদ্ধবিরতিতে" সম্মত হয়েছে। পাকিস্তান সরকার এই দাবিকে স্বীকৃতি দিয়ে ট্রাম্পকে নোবেল পুরস্কার দেয়া উচিত বলে ঘোষণা করলেও ভারত ট্রাম্পের মধ্যস্থতার দাবি নাকচ করে দিয়ে বলেছে, পাকিস্তানের সঙ্গে সরাসরি আলোচনার মাধ্যমেই যুদ্ধ-বিরতি করা হয়েছে।
রুয়ান্ডা এবং গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র; স্থায়ী যুদ্ধ-বিরতির আলোচনা ব্যর্থ
জেলেনস্কির সাথে তার বৈঠকে ট্রাম্প রুয়ান্ডা ও কঙ্গোর মধ্যে সংঘাতের কথা উল্লেখ করে দাবি করেছিলেন যে তার প্রশাসন সাময়িকভাবে যুদ্ধ বন্ধ করতে ও একটি প্রাথমিক শান্তি চুক্তির ব্যবস্থা করতে ভূমিকা পালন করেছেন। হোয়াইট হাউসে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয় ও পরে একটি যুদ্ধবিরতিও প্রতিষ্ঠিত হয়, কিন্তু যুদ্ধবিরতিটি স্থায়ী হয়নি এবং একটি স্থায়ী চুক্তির জন্য আলোচনাও ব্যর্থ হয়েছে।
কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ড: ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতি
গত মাসে (জুলাই) কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ডের মধ্যে সীমান্ত সংঘর্ষে ৪০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত এবং ৩০০,০০০ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। ২৮শে জুলাই একটি ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতি শুরু হয় যার বেশিরভাগই মালয়েশিয়ার মধ্যস্থতায় হয়েছিল। যুদ্ধবিরতি ঘোষণার আগে, ট্রাম্প নিজের মালিকানাধীন ট্রুথ সোশ্যালে লিখেছিলেন যে যুদ্ধ বন্ধ হলেই কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দেশগুলোর সাথে বাণিজ্য আলোচনায় বসবে। চুক্তিতে পৌঁছানোর পর, তিনি নিজেকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে উপস্থাপন করেন।
আর্মেনিয়া এবং আজারবাইজান; অনিশ্চয়তায় ঢাকা সব কিছু
আজারবাইজানের রাষ্ট্রপতি ইলহাম আলিয়েভ এবং আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাশিনিয়ান যোগাযোগ রুট নিয়ে বিরোধের অবসান ঘটাতে ওয়াশিংটনে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। এই রুটটিকে এখন "আন্তর্জাতিক শান্তি ও সমৃদ্ধির ট্রাম্প হাইওয়ে" নাম দেয়া হয়েছে এবং একটি আমেরিকান কোম্পানিকে এর উন্নয়নের কাজ দেয়া হয়েছে, তবে বিরোধটি আসলে সমাধান হয়েছে কিনা বা চুক্তিটি কতদিন স্থায়ী হবে তা স্পষ্ট নয়।
ইসরায়েল ও ইরান: যুদ্ধ কি আসন্ন?
জুনের শেষের দিকে ট্রাম্প ঘোষণা করেছিলেন যে ইসরায়েল ও ইরান যুদ্ধ বন্ধ করেছে; তবে যুদ্ধের মূল কারণগুলো এখনও সমাধান করা হয়নি এবং এটি যে পুনরায় শুরু হবে না তার গ্যারান্টি নেই। ইরান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে স্থগিত পরোক্ষ আলোচনা কখন পুনরায় শুরু হবে তারও কোনও ইঙ্গিত নেই।
মিশর ও ইথিওপিয়ার বিরোধ; পুরোপুরি সমাধান হয়নি
ট্রাম্প দাবি করেছেন যে তিনি মিশর ও ইথিওপিয়ার মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন। দুই দেশ যুদ্ধে লিপ্ত ছিল না, তবে একটি জলবিদ্যুৎ বাঁধ নিয়ে তাদের মধ্যে মতবিরোধ ছিল। ট্রাম্প বলেছেন যে বিরোধের সমাধান হয়ে গেছে এবং "বর্তমানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে", তবে বিরোধ এখনও সম্পূর্ণরূপে সমাধান হয়নি।
সার্বিয়া ও কসোভো: দীর্ঘদিনের উত্তেজনা রয়ে গেছে
হোয়াইট হাউস ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে সার্বিয়া ও কসোভোর মধ্যে একটি অর্থনৈতিক চুক্তির দিকে ইঙ্গিত করে বলেছে এটি সংঘাত নিরসনের উদাহরণ। ১৯৯০ এর দশক থেকে দুটি দেশ যদিও যুদ্ধে লিপ্ত হয়নি, তবুও দীর্ঘদিনের উত্তেজনা রয়ে গেছে।
ইউক্রেন-রাশিয়ার উন্নয়ন; সংঘাত অব্যাহত
পুতিন, জেলেনস্কি এবং ইউরোপীয় নেতাদের সাথে ট্রাম্পের কূটনৈতিক বৈঠকের পর, ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি কিয়েভে ফিরে এসে ঘোষণা করেন যে যুদ্ধ-পরবর্তী নিরাপত্তা গ্যারান্টিতে অবদান রাখতে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। পুতিন ডনবাস অঞ্চলের সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ, ইউক্রেনে পশ্চিমা বাহিনীর অনুপস্থিতি এবং ন্যাটোতে ইউক্রেনের যোগদানের প্রচেষ্টা বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন, কিন্তু দুই পক্ষের মধ্যে সংঘাত অব্যাহত রয়েছে।
ভেনেজুয়েলার সাথে উত্তেজনা; মাদক কার্টেলদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অজুহাতে হামলা
ল্যাটিন আমেরিকান মাদক কার্টেলদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অজুহাতে ট্রাম্প প্রশাসন ভেনেজুয়েলার উপকূলে তিনটি ডেস্ট্রয়ার বা যুদ্ধ-জাহাজ ধ্বংসকারী জাহাজ পাঠাচ্ছে। জাহাজগুলির সাথে ৪,০০০ সামরিক কর্মী থাকবে। এছাড়াও, নিকোলাস মাদুরোকে ধরার জন্য সহায়ক তথ্যের পুরস্কারের পরিমাণ বাড়িয়ে পাঁচ কোটি ডলার করা হয়েছে। প্রতিক্রিয়ায়, মাদুরো ঘোষণা করেছেন যে তিনি সম্ভাব্য হুমকি মোকাবেলায় ৪৫লাখ সৈন্য মোতায়েন করেছেন।
উপসংহার
বিভিন্ন ইস্যুর পর্যালোচনা থেকে দেখা যায় যে শান্তির মধ্যস্থতা সম্পর্কে ট্রাম্পের অনেক দাবিই অতিরঞ্জিত, নতুবা মার্কিন ভূমিকা খুবই গৌণ। কিছু ক্ষেত্রে, চুক্তি বাস্তবে সম্পাদিত হয়েছে, কিন্তু তাদের স্থায়িত্ব প্রশ্নবিদ্ধ। অনেক ক্ষেত্রে, ট্রাম্প তার ভূমিকা আরও বড় করে তুলে ধরার জন্য বেসামরিক বা অর্থনৈতিক বিরোধকে "যুদ্ধ" হিসাবে চিত্রিত করার চেষ্টা করেছেন। আসলে (বিশ্বের সবচেয়ে বড় অশান্তির উৎস ইহুদিবাদী ইসরাইলের প্রধান সহযোগী) ট্রাম্প নানা ধরনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে নানা ইস্যু ও বিতর্কিত পদক্ষেপের মাধ্যমে নিজেকে শান্তির হোতা হিসেবে জাহির করার চেষ্টা করছেন যেসবের স্থায়িত্ব ও বাস্তবতা অনেকটাই প্রশ্নবিদ্ধ ও আরও বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরই সেসবের অবস্থা স্পষ্ট হবে। #
পার্স টুডে/এমএএইচ/২৬
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।