ডিসকভার ইরান:
শাহ চেরাগ মাজার: শিরাজের হৃদস্পন্দন ও চিরন্তন ঐতিহ্য
-
শাহ চেরাগ মাজার
পবিত্র শাহ চেরাগ মাজারে প্রবেশ করা মানে যেন শিরাজের জীবন্ত আত্মার ভেতর দিয়ে হাঁটা। এটি সেই শহর, যেখানে হাফেজ ও সাদির কবিতার সুর মিশে যায় প্রার্থনার মৃদু গুঞ্জনের সঙ্গে। চারপাশের বাগান থেকে ভেসে আসে কমলালেবুর ফুলের সুগন্ধ, যা মাজারের উঠোনে প্রবাহিত হয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্যকে মিশিয়ে দেয় আধ্যাত্মিক প্রশান্তির সঙ্গে।
দেয়ালে ঝলমলে আয়না ও ফিরোজা রঙের টালি যেন গল্প বলে— এক জাতির, যারা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তাদের পবিত্র স্থান নির্মাণ করেছে, পুনর্নির্মাণ করেছে, আর সযত্নে সংরক্ষণ করেছে।
এই মাজারের আহ্বানে দেশি-বিদেশি জিয়ারতকারী ও পর্যটকরা ছুটে আসেন— যেখানে শতাব্দীব্যাপী ভক্তি মিলেমিশে আছে ইরানি শিল্প ও স্থাপত্যের চিরন্তন সৌন্দর্যের সঙ্গে।
শিরাজের মানুষের কাছে শাহ চেরাগ কেবল একটি পবিত্র স্থান নয়; এটি জীবন্ত প্রতীক— যেখানে বিশ্বাস ও কারুশিল্প একে অপরের পরিপূরক হয়ে দাঁড়ায়, আর আয়নায় মোড়া ছাদের প্রতিফলনে জ্বলজ্বল করে তার অনন্ত তাৎপর্য।
ইতিহাসে প্রোথিত মাজার
শাহ চেরাগ মাজারের নির্মাণ শুরু হয় ৬ষ্ঠ হিজরিতে (খ্রিস্টীয় ১২শ শতক), ফার্সের আতাবেগ রাজবংশের আমলে, যখন শিরাজ ছিল শিক্ষা ও ধর্মভক্তির অন্যতম কেন্দ্র। এতে শায়িত আছেন সপ্তম শিয়া ইমাম মুসা আল-কাজিম (আ.)-এর জ্যেষ্ঠ পুত্র এবং অষ্টম ইমাম ইমাম রেজা (আ)-এর ভাই আহমদ ইবনে মুসা (আ.)। ইমাম রেজা (আ.)-এর বিখ্যাত সমাধি ইরানের পূর্বাঞ্চলীয় শহর মাশহাদে অবস্থিত।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই মাজার শিরাজের আধ্যাত্মিক জীবনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। হিজরি ৭৪৫ সালে ইনজুয়িদ রাজবংশের রানি তাশি খাতুন মাজারটি সংস্কার ও সম্প্রসারণের নির্দেশ দেন। তিনি পাশাপাশি একটি বড় শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠা করেন এবং জিয়ারতের এই পবিত্র স্থানটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য কাছাকাছি দোকানগুলো ওয়াকফ করে দেন।
পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে অসংখ্য পর্যটক ও জিয়ারতকারী তাদের ভ্রমণ বিবরণীতে এই মাজারের প্রশান্তি ও শিরাজের জীবনে তার কেন্দ্রীয় ভূমিকার কথা লিখে গেছেন।
মাজারটি বারবার ভূমিকম্প, আক্রমণ ও পুনর্নির্মাণের মুখোমুখি হয়েছে।
১৫০৭ সালে শাহ ইসমাইল সাফাভি বড় ধরনের সংস্কারের আদেশ দেন, তবে ১৫৮৮ সালের এক ভূমিকম্পে তা আবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
১৮শ শতকে আফগান বাহিনীর ওপর জয়লাভের পর নাদির শাহ আফশার পুনরায় মাজারটি মেরামত করান।
‘শাহ চেরাগ’ নামের পেছনের গল্প
‘শাহ চেরাগ’ অর্থাৎ “আলোর রাজা”- এই নামটির পেছনে রয়েছে এক কিংবদন্তি, যা আজও শিরাজের স্মৃতিতে গভীরভাবে প্রোথিত।
বহু শতাব্দী আগে এক বৃদ্ধা প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে এক স্থানের ওপর থেকে অদ্ভুত আলোকচ্ছটা দেখতে পেতেন — সেটিই ছিল আহমদ ইবনে মুসা (আ.)-এর সমাধিস্থল।
তিনি বিশ্বাস করলেন, নিশ্চয়ই এটি কোনো মহান ব্যক্তির কবরস্থান। তিনি বিষয়টি জানালেন শিরাজের শাসক আমির আদুদ আদ-দৌলা দাইলামিকে।
শাসক নিজে ঘটনাস্থলে এলে বৃদ্ধা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে উজ্জ্বল আলো দেখেন এবং বিস্ময়ে বলে ওঠেন— “শাহ চেরাগ!”
আমির তখন খনন করার আদেশ দেন এবং আহমদ ইবন মুসা (আ.)-এর সমাধি আবিষ্কৃত হয়। সেই রাত থেকেই স্থানটি 'শাহ চেরাগ' নামে পরিচিত হয়ে যায়। এটি এমন একটি নাম, যা আজও শিরাজকে আলোকিত করে রেখেছে।
বিশ্বাসের স্থাপত্য
স্থাপত্যগতভাবে শাহ চেরাগ মাজার আজারী শৈলীর এক উজ্জ্বল উদাহরণ, যা পারস্য শিল্পকলার সূক্ষ্মতায় পরিপূর্ণ। উত্তর ও দক্ষিণের প্রবেশদ্বার দুটি একটি বিশাল প্রাঙ্গণে গিয়ে মিশেছে, যার চারপাশে ছায়াময় কক্ষগুলোর সারি।
ভেতরে প্রবেশ করলেই দেখা যায়— আয়নায় মোড়া দেয়ালগুলো প্রতিটি আলোকরশ্মিকে হাজার টুকরোয় বিভক্ত করে এক অপার্থিব দীপ্তি ছড়িয়ে দেয়। ফতেহ আলী শাহ কাজারের আমলে প্রথম রুপার জালি স্থাপন করা হয়। দ্বিতীয় জালিটি, তাও রুপার, ১৮২৭ সালে সম্পন্ন হয়।
আজ মাজারের জাদুঘরে ৮,০০০-এরও বেশি ঐতিহাসিক নিদর্শন সংরক্ষিত রয়েছে, যা বিভিন্ন রাজবংশের সময়ের। আর দক্ষিণ ইরানের অন্যতম বৃহৎ গ্রন্থাগারটিও এখানে — যেখানে রয়েছে প্রায় এক লক্ষ গ্রন্থ।
এই সবকিছু মিলে শাহ চেরাগ হয়ে উঠেছে শিরাজের সাংস্কৃতিক ঐশ্বর্যের প্রতীক — যেখানে শিল্প, জ্ঞান ও বিশ্বাস যুগে যুগে মিলেমিশে আছে।
অনেক বিশিষ্ট আলেম, কবি ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব তাদের চিরনিদ্রার স্থান হিসেবে শাহ চেরাগকে বেছে নিয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন শহীদ আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ আবদুল হোসেইন দস্তগায়েব, আয়াতুল্লাহ নাজাবত, ভেসাল শিরাজি এবং জান্দ রাজবংশের কয়েকজন সদস্য। এই কবরগুলো, যা মাজারের উঠোনজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে, মনে করিয়ে দেয়—ইরানে জ্ঞান ও বিশ্বাস সবসময়ই একে অপরের পরিপূরক হিসেবে শ্রদ্ধেয়।
সন্ত্রাসী হামলা ও অটল বিশ্বাস
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শাহ চেরাগ মাজার অন্তত দুটি সন্ত্রাসী হামলার মুখোমুখি হয়েছে। ২০২২ এবং ২০২৩ সালে তাকফিরি দায়েশ (আইএস) সন্ত্রাসীরা এই পবিত্র স্থানে হামলা চালায়, যাতে বহু জিয়ারতকারী হতাহত হন।
তবু জিয়ারতকারীরা থেমে থাকেননি। মাজারের প্রাঙ্গণ আবার ভরে উঠেছে দেশি-বিদেশি ভক্তদের পদচারণায়। পরিবারগুলো প্রার্থনা করছে, নীরবে দাঁড়িয়ে আছে আয়নাময় গম্বুজের নিচে— তাদের বিশ্বাস অটুট।
ইরানিদের কাছে শাহ চেরাগের টিকে থাকা বিশ্বাসের শক্তির প্রতীক — যা প্রমাণ করে, কোনো সন্ত্রাসই ভক্তির আলোককে নিভিয়ে দিতে পারে না।
গম্বুজের নিচে প্রতিফলিত আলোর ঝলকে তারা নিজেদের ও তাদের পূর্বপুরুষদের ছায়া দেখতে পান— যারা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে একই বিশ্বাসের আলোকের টানে এখানে ছুটে এসেছেন।
শিরাজের প্রাণবন্ত সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের অংশ হিসেবে, শাহ চেরাগ মাজার ইরানের আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য, সৌন্দর্যের প্রতি তার শ্রদ্ধা এবং বিশ্বাসের সাথে তার অটুট সংযোগের একটি আশ্রয়স্থল এবং প্রতীক হয়ে রয়েছে।#
পার্সটুডে/এমএআর/২৩