ট্রাম্পের ২০ দফা পরিকল্পনা; গাজায় যুদ্ধে পরাজয় থেকে ইসরায়েলকে রক্ষার চেষ্টা
https://parstoday.ir/bn/news/world-i152510-ট্রাম্পের_২০_দফা_পরিকল্পনা_গাজায়_যুদ্ধে_পরাজয়_থেকে_ইসরায়েলকে_রক্ষার_চেষ্টা
পার্সটুডে : আঞ্চলিক প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলো মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২০ দফা গাজা পরিকল্পনাকে 'ইহুদিবাদী ইসরায়েলকে পরাজয় থেকে বাঁচানোর চেষ্টা' হিসেবে অভিহিত করেছে।
(last modified 2025-10-01T09:32:58+00:00 )
সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২৫ ১৬:২২ Asia/Dhaka
  • ওয়াশিংটনে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্পের পাশে ছিলেন নেতানিয়াহু
    ওয়াশিংটনে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্পের পাশে ছিলেন নেতানিয়াহু

পার্সটুডে : আঞ্চলিক প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলো মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ২০ দফা গাজা পরিকল্পনাকে 'ইহুদিবাদী ইসরায়েলকে পরাজয় থেকে বাঁচানোর চেষ্টা' হিসেবে অভিহিত করেছে।

ফিলিস্তিনের ইসলামি জিহাদ আন্দোলন, হামাস এবং ইয়েমেনের আনসারুল্লাহ ঘোষণা করেছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের গাজা বিষয়ক নতুন পরিকল্পনা মূলত ইসরায়েলি শাসকগোষ্ঠীকে গাজার যুদ্ধে পরাজয় থেকে রক্ষা করার জন্য তৈরি করা হয়েছে।

দখলদারিত্বের নতুন নির্দেশিকা: ইসলামি জিহাদ

ইসলামি জিহাদ আন্দোলনের মহাসচিব জিয়াদ আন-নাখালা বলেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়োমিন নেতানিয়াহু'র যৌথ সংবাদ সম্মেলনের বিবৃতি দখলদারিত্ব অব্যাহত রাখার নির্দেশিকা ছাড়া আর কিছুই নয়।

তিনি আরও বলেন, ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে যেসব লক্ষ্য যুদ্ধে অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে, তা রাজনৈতিকভাবে হাসিল করতে চাইছে। তাই এই তথাকথিত মার্কিন-ইসরায়েলি পরিকল্পনা আসলে গোটা অঞ্চলকে বিস্ফোরণের দিকে ঠেলে দেওয়ার নির্দেশনা।

হামাসের অবস্থান: অস্ত্র, বন্দি মুক্তি ও দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধবিরতি

একই বিষয়ে হামাস নেতা তাহের আল-নোনো আল-আরাবি টিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, প্রতিরোধের অস্ত্র ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। 'ইসরায়েলি' বন্দিদের মুক্তি- যুদ্ধের অবসান ও গাজা থেকে দখলদার বাহিনীর প্রত্যাহারের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং এ বিষয়ে তারা আন্তরিক। তবে বন্দি মুক্তি অবশ্যই এমন এক চুক্তির অংশ হতে হবে যা যুদ্ধ শেষ করবে এবং দখলদার সেনাদের প্রত্যাহার নিশ্চিত করবে।

তিনি আরও জানান, হামাস দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধবিরতিতে প্রস্তুত এবং গাজা উপত্যকার জন্য স্বাধীন প্রশাসন গঠনে মিশরের প্রস্তাব মেনে নিয়েছে। একই সঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন, তারা মার্কিন পরিকল্পনাটি এমনভাবে বিবেচনা করবেন যাতে ফিলিস্তিনিদের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষা হয়। হামাস যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করতে চায় না এবং ফিলিস্তিনি স্বার্থবিরোধী নয় এমন যেকোনো প্রস্তাব তারা গুরুত্বের সঙ্গে অধ্যয়ন করবে। আল-নোনো স্পষ্ট করে বলেন, ফিলিস্তিনি জনগণ অপ্রাপ্তবয়স্ক নয় এবং তারা বাইরে থেকে কোনো অভিভাবকত্ব মেনে নেবে না।

হামাসের আরেক নেতা মাহমুদ মারদাউই বলেন, ট্রাম্পের পরিকল্পনা মূলত আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র স্বীকৃতির অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা। ঘোষিত পরিকল্পনা অস্পষ্ট এবং এতে কোনো নিশ্চয়তা নেই।

তিনি জানান, হামাস এমন কোনো প্রস্তাব গ্রহণ করবে না যাতে ফিলিস্তিনি জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ও গণহত্যা থেকে সুরক্ষা অন্তর্ভুক্ত নেই। মারদাউই আরও বলেন, ট্রাম্পের পরিকল্পনা এখনো হামাসের কাছে পৌঁছেনি, এমনকি কোনো ফিলিস্তিনি পক্ষও তা পায়নি। যদিও তারা পরিকল্পনাটি সরাসরি দেখেননি, তবু এর বিধানসমূহ স্পষ্টতই 'ইসরায়েলি' দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন।

আনসারুল্লাহর প্রতিক্রিয়া: হামাসকে বিচ্ছিন্ন করার প্রচেষ্টা

ইয়েমেনের আনসারুল্লাহ আন্দোলনের জ্যেষ্ঠ সদস্য মোহাম্মদ আল-ফারাহ এ সম্পর্কে বলেন, ট্রাম্পের গাজার নতুন যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনা অবিবেচক এবং অকার্যকর। এর মূল উদ্দেশ্য হলো হামাসকে বিচ্ছিন্ন করা এবং বিশ্বব্যাপী ইসরায়েলবিরোধী ক্ষোভ নিয়ন্ত্রণ করা। তার মতে, এই পরিকল্পনার কোনো বাস্তবায়নযোগ্য কাঠামো নেই।

অনেক বিশ্লেষক ও ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ গোষ্ঠীর দৃষ্টিতে ট্রাম্পের ২০ দফা পরিকল্পনা হলো গাজায় সামরিক ও রাজনৈতিক ব্যর্থতা থেকে ইসরায়েলি শাসনকে রক্ষার প্রচেষ্টা। ইসরায়েল গাজা যুদ্ধে তার সামরিক লক্ষ্যগুলো অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে; যেমন প্রতিরোধের অবকাঠামো ধ্বংস করা, বন্দি ইসরায়েলিদের মুক্ত করা, কিংবা গাজার আশেপাশের ইসরায়েলি বসতিগুলোতে নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনা। এখন ট্রাম্পের পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দু হলো হামাসকে নিরস্ত্র করা এবং গাজাকে আন্তর্জাতিক সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া—যা মূলত সেই লক্ষ্যগুলো রাজনৈতিক পথে অর্জনের চেষ্টা।

ওয়াশিংটনের হোয়াইট হাউসে স্থানীয় সময় গতকাল সোমবার ২০ দফা গাজা শান্তি পরিকল্পনা তুলে ধরেন ট্রাম্প। যৌথ সংবাদ সম্মেলনে পাশে ছিলেন ইসরায়েলের উগ্রবাদী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। এই পরিকল্পনায় ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোকে সম্পূর্ণভাবে নিরস্ত্র করার এবং গাজার প্রশাসন থেকে বাদ দেওয়ার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। অর্থাৎ, যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল রাজনৈতিকভাবে প্রতিরোধের প্রধান শক্তিগুলোকে সরাতে চাইছে।

টনি ব্লেয়ার ও GITA: পশ্চিমা নিয়ন্ত্রণের নতুন রূপ

পরিকল্পনা অনুযায়ী, যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার গাজার অস্থায়ী প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব নেবেন এবং তিনি 'গাজা ইন্টারন্যাশনাল ট্রানজিশন অথরিটি' বা GITA-র নেতৃত্ব দেবেন। ব্লেয়ার, যিনি দীর্ঘদিন ধরে আমেরিকা ও ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ, তাকে সামনে আনার মানে হলো পশ্চিমা-নিয়ন্ত্রিত আন্তর্জাতিক কাঠামোর মাধ্যমে গাজাকে নিয়ন্ত্রণ করা। এটি ফিলিস্তিনি জনগণ ও প্রতিরোধ শক্তির ইচ্ছাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছু নয়।

গাজার বাসিন্দাদের মিশর বা জর্ডানে স্থানান্তরের প্রস্তাবকেও প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলো 'জাতিগত নিধন' ও 'জোরপূর্বক উচ্ছেদ' হিসেবে বর্ণনা করেছে। পরিকল্পনায় ইসরায়েলি সেনাদের দখলকৃত গাজা অঞ্চল থেকে প্রত্যাহারের কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা উল্লেখ করা হয়নি। ফলে প্রতিরোধ গোষ্ঠীর মতে, এটি কেবল আন্তর্জাতিক চাপ কমানোর জন্য ইসরায়েলের এক রাজনৈতিক কৌশল।

প্রতিরোধ গোষ্ঠীর দৃষ্টিতে, ট্রাম্পের পরিকল্পনা সংকট সমাধানের পথ নয়, বরং ইসরায়েলি শাসনকে পরাজয় থেকে বাঁচানোর চেষ্টা এবং ফিলিস্তিনি জনগণের উপর মার্কিন-ইসরায়েলি ইচ্ছা চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা। এটি ইসরায়েলি দখলদারিত্ব শেষ করার বদলে সেটিকে দীর্ঘায়িত করবে।

ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ ও বহু বিশ্লেষকের মতে, ট্রাম্পের ২০ দফা পরিকল্পনা ফিলিস্তিনি জনগণের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করে না। পরিকল্পনার কাঠামো, বিষয়বস্তু ও লক্ষ্য সবই ফিলিস্তিনিদের ঐতিহাসিক, মানবিক ও বৈধ চাহিদাকে উপেক্ষা করে, এবং কেবল ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়।

এই পরিকল্পনা ফিলিস্তিনিদের অংশগ্রহণ ছাড়াই তৈরি হয়েছে, যেখানে গাজা বা পশ্চিম তীরের জনগণের মতামত নেওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। এটি আন্তর্জাতিক আইনের মৌলিক নীতি "জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার"-এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। পরিকল্পনায় প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোকে পুরোপুরি নিরস্ত্র করার কথা বলা হলেও, ইসরায়েলি দখলদারিত্বের অবসান, বসতি নির্মাণ বন্ধ করা বা ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে কোনো নিশ্চয়তা দেওয়া হয়নি। ফলে এই পরিকল্পনা প্রতিরোধকে প্রতিরক্ষা থেকে বঞ্চিত করবে, কিন্তু ফিলিস্তিনিদের জন্য নিরাপত্তা বা স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে না।

ট্রাম্পের পরিকল্পনা মূলত গাজায় ইসরায়েলের পরাজয় রোধে একটি হাতিয়ার, যা মার্কিন-ইসরায়েলি স্বার্থের ভিত্তিতে নতুন শৃঙ্খলা চাপিয়ে দিতে চায় এবং ফিলিস্তিন সংকটের কোনো ন্যায্য সমাধান দেয় না।#

পার্সটুডে/এমএআর/৩০