হন্ডুরাসের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করে ট্রাম্প আসলে কী চান?
-
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প (ডানে) হন্ডুরাসের প্রেসিডেন্ট জুয়ান অরল্যান্ডো হার্নান্দেজ (বামে)
আগামীকাল (৩০ নভেম্বর) অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের ঠিক আগে হন্ডুরাসে রাজনৈতিক উত্তেজনা চরমে। ভোটে কারচুপির অভিযোগ, রাস্তায় বিক্ষোভ, সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশ্য হস্তক্ষেপে পুরো দেশ উত্তাল। এই নির্বাচন শুধু দেশের অর্থনীতি ও নিরাপত্তার ভবিষ্যৎই নয়, কেন্দ্রীয় আমেরিকায় বৈদেশিক প্রভাবের ভারসাম্যও বদলে দিতে পারে।
প্রায় ১ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত মধ্য আমেরিকার ছোট দেশ হন্ডুরাসে ৩০ নভেম্বর ২০২৫ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, যা দেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক–অর্থনৈতিক দিকনির্দেশনা নির্ধারণ করবে। এই নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট, জাতীয় কংগ্রেসের ১২৮ সদস্য, ২৯৮ জন মেয়র ও দুই হাজারেরও বেশি পৌরসভা কাউন্সিলর নির্বাচিত হবেন।
অঞ্চলের বহু দেশের বিপরীতে হন্ডুরাসে 'ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট' পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়—অর্থাৎ যে প্রার্থী সর্বোচ্চ ভোট পাবেন, তিনি-ই জয়ী, সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া বাধ্যতামূলক নয়। দেশে ভোটার সংখ্যা ৬.৫ মিলিয়ন, আর আগের নির্বাচনে (২০২১) অংশগ্রহণের হার ছিল প্রায় ৬৯ শতাংশ।
তবে এই নির্বাচন কেবল দেশের অভ্যন্তরীণ লড়াই নয়; কারচুপির অভিযোগ, রাস্তায় বিক্ষোভ, সেনাবাহিনীর সম্পৃক্ততা এবং বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ—পরিস্থিতিকে আরও অস্থির করে তুলেছে।
হন্ডুরাসের ভোটারদের মূল উদ্বেগ দীর্ঘদিনের সমস্যা—দারিদ্র্য, অপরাধী চক্রের সহিংসতা, সরকারি দুর্নীতি ও ব্যাপক অভিবাসন।
বামপন্থী দল LIBRE-এর নেতা ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট শিওমারা কাস্ট্রো, ২০২১ সাল থেকে ক্ষমতায় আছেন। দারিদ্র্য হ্রাস ও নিরাপত্তা উন্নয়নে কিছু অগ্রগতি হলেও সংবিধান অনুযায়ী তিনি পুনর্নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবেন না।
তিন প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী
নির্বাচনের মূল লড়াই তিনজন শক্তিশালী প্রার্থীর মধ্যে:
রিক্সি মোনকাদা (৬০) : কাস্ট্রো সরকারের সাবেক অর্থ ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং LIBRE–এর প্রার্থী। কর্মসংস্থান, দুর্নীতিবিরোধী লড়াই ও সামাজিক সেবার উন্নয়নে তিনি জোর দিচ্ছেন। TResearch–এর সাম্প্রতিক জরিপে তিনি ৪৪% সমর্থন নিয়ে এগিয়ে আছেন, যদিও প্রতিদ্বন্দ্বীরা এই জরিপকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
সালভাদোর নাসরালা: টিভি উপস্থাপক ও অভিজ্ঞ রাজনীতিক। ২০২২ সালে কাস্ট্রোর সহ-সভাপতি ছিলেন, পরে পদত্যাগ করেন। অর্থনৈতিক সংস্কার ও দুর্নীতি দমনের পক্ষে অবস্থান নিয়ে তিনি কিছু জরিপে প্রায় ১৯.৬% সমর্থন পাচ্ছেন।
নাসরি টিটো আসফুরা (৬৭) : লেবানিজ বংশোদ্ভূত ব্যবসায়ী ও তেগুসিগালপা'র সাবেক মেয়র। তিনি অবকাঠামো উন্নয়ন, নিরাপত্তা এবং বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন।
সেনাবাহিনী ও নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে অভিযোগ পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করেছে। এর মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প–এর সরাসরি হস্তক্ষেপ বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক মাত্রায় নিয়ে গেছে।
ট্রাম্পের প্রকাশ্য হস্তক্ষেপ
২৬ নভেম্বর ট্রাম্প তার সোস্যাল ট্রুথ–এ প্রকাশ্যে আসফুরাকে সমর্থন জানিয়ে তাঁকে “হন্ডুরাসের স্বাধীনতার একমাত্র প্রকৃত বন্ধু” বলে উল্লেখ করেন।
তিনি আরও বলেন, "আসফুরা জিতলে যুক্তরাষ্ট্র বিপুল আর্থিক সাহায্য ও নিরাপত্তা সহযোগিতা দেবে। তবে তিনি জিততে না পারলে আমেরিকা আর অর্থ নষ্ট করবে না। ভুল নেতা ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে।”
একই পোস্টে ট্রাম্প সাবেক প্রেসিডেন্ট হুয়ান অরলান্দো এরনান্দেসকে (ন্যাশনাল পার্টি) পুরোপুরি ক্ষমা ঘোষণা করেন। এরনান্দেস বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে কোকেন পাচারের অভিযোগে ৪৫ বছরের কারাদণ্ড ভোগ করছেন। ট্রাম্প বলেন, তাঁকে 'অন্যায্যভাবে কঠোর” শাস্তি দেওয়া হয়েছে।
ট্রাম্পের লক্ষ্য কী?
ট্রাম্পের সমর্থন তাঁর ঐতিহ্যগত বামবিরোধী বৈদেশিক নীতিরই অংশ। তিনি আসফুরাকে মাদকচক্রবিরোধী লড়াইয়ের সঙ্গী হিসেবে দেখছেন। যদিও একই দলের সাবেক প্রেসিডেন্ট হার্নান্দেজ যুক্তরাষ্ট্রেই মাদক পাচারের মামলায় দণ্ডিত।
ট্রাম্প মনকাদাকে 'কমিউনিস্ট' এবং নাসরালাকে 'কমিউনিস্ট হওয়ার পথে' বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি সতর্ক করে বলেছেন, হন্ডুরাস' আরেকটি ভেনেজুয়েলা' হয়ে যেতে পারে।
ট্রাম্পের হস্তক্ষেপ দুই ধরনের ফল বয়ে আনতে পারে:
১. আসফুরার জন্য সহায়ক হতে পারে
কিছু ভোটার মনে করেন, ট্রাম্পকে বিরক্ত করলে ভবিষ্যৎ মার্কিন সাহায্য ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এতে আসফুরা অতিরিক্ত সহানুভূতি ভোট পেতে পারেন।
২. জাতীয়তাবাদী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে
যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি হস্তক্ষেপ অনেক হন্ডুরাসবাসীর জাতীয় মর্যাদাবোধে আঘাত করতে পারে এবং তাঁদের আসফুরা থেকে দূরে সরিয়ে দিতে পারে।
এ ছাড়া, ট্রাম্পের হার্নান্দেজকে ক্ষমা করা দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনকারীদের ক্ষুব্ধ করেছে—যা শেষ পর্যন্ত আসফুরার জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে।
সুতরাং, ৩০ নভেম্বর ২০২৫-এর নির্বাচন শুধু হন্ডুরাসের গণতন্ত্রের পরীক্ষা নয়, বরং এটি দেখাবে—বিদেশি শক্তি, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, এখনো কতটা নির্লজ্জভাবে প্রতিবেশী দেশের নির্বাচনে হাত দিতে পারে।#
পার্সটুডে/এমএআর/২৯