ভেঙে গেছে ন্যাটো-রাশিয়া কাউন্সিল: নতুন শীতলযুদ্ধের শঙ্কা কতটা বাস্তব?
-
ভেঙে গেছে ন্যাটো-রাশিয়া কাউন্সিল
পার্সটুডে- পোল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাদোস্লাভ সিকোরস্কি ঘোষণা করেছেন, ন্যাটো-রাশিয়া কাউন্সিল ভেঙে দেওয়া হয়েছে।
পার্সটুডের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পোল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বুধবার জানিয়েছেন, উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা (ন্যাটো) এই কাউন্সিলকে বাতিল করেছে। ব্রাসেলসে ন্যাটো পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকের পর তিনি বলেন, ন্যাটোর মহাসচিব মার্ক রুটে ঘোষণা করেছেন “ন্যাটো–রাশিয়া কাউন্সিলের আর অস্তিত্ব নেই এবং এই কাউন্সিল প্রতিষ্ঠার আইন আর কার্যকর নয়।”
১৯৯০-এর দশকের শুরুর দিকে রাশিয়া ও ন্যাটোর মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ১৯৯৭ সালে উভয় পক্ষ ন্যাটো–রাশিয়া কাউন্সিল প্রতিষ্ঠার বিষয়ে একটি সনদে স্বাক্ষর করে, যার ভিত্তিতে মস্কো ও ন্যাটো পরস্পরকে শত্রু হিসেবে বিবেচনা না করার এবং একটি পরামর্শমূলক কাঠামো গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। শেষ পর্যন্ত ২০০২ সালে এই কাউন্সিল প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১৪ সাল পর্যন্ত রাশিয়া ও ন্যাটো সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা, মাদক চোরাচালান এবং সমুদ্র দস্যুতা দমনসহ বিভিন্ন বিষয়ে সহযোগিতা করে এসেছে, তবে ইউক্রেন যুদ্ধের পর ন্যাটো রাশিয়ার সঙ্গে সহযোগিতা স্থগিত করে।
এর আগে, ন্যাটো–রাশিয়া কাউন্সিলের আওতায় আলোচনাও ২০১৯ সালে বন্ধ হয়ে যায় এবং ২০২১ সালে রাশিয়া ব্রাসেলসে ন্যাটোতে তার স্থায়ী প্রতিনিধি দপ্তরের কার্যক্রম স্থগিত করে ও মস্কোতে ন্যাটোর দপ্তরগুলো বন্ধ করে দেয়।
রাশিয়া ও ন্যাটোর মধ্যকার ক্রমবর্ধমান মুখোমুখি অবস্থানকে পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর রাশিয়াবিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রেক্ষাপটে উপলব্ধি করা যায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও ওয়ারশ চুক্তির বিলুপ্তির পর ন্যাটো তার নতুন মিশন ও ভৌগোলিক পরিধির ওপর ভিত্তি করে পূর্বদিকে সম্প্রসারণের নীতি গ্রহণ করে। ন্যাটোর পূর্বমুখী সম্প্রসারণ ১৯৯৫ সালে শুরু হয়। ১৯৯৯ ও ২০০৪ সালে পূর্ব ইউরোপ এবং বাল্টিক অঞ্চলের অধিকাংশ দেশকে অন্তর্ভুক্ত করে তা সম্পন্ন হয়। উত্তর মেসিডোনিয়া ছিল ন্যাটোর সদস্যপদপ্রাপ্ত সর্বশেষ দেশ। ন্যাটো এরপর প্রাক্তন সোভিয়েত অঞ্চলের দেশগুলোকে বিশেষ করে জর্জিয়া ও ইউক্রেনকে সদস্য করার ব্যাপারে ব্যাপক চেষ্টা চালায়। রাশিয়ার দৃষ্টিতে এটি তাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য সরাসরি হুমকি হিসেবে বিবেচিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৮ সালে রাশিয়া–জর্জিয়া যুদ্ধ এবং ২০২২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত চলমান রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন মনে করেন, পাশ্চাত্য সবসময় মস্কোর নিরাপত্তা উদ্বেগ উপেক্ষা করে ইউক্রেনকে ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করেছে—যা যুদ্ধের মূল কারণ।
ইউক্রেন পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে ন্যাটো দাবি করেছে, মস্কোর কারণে ইউরোপীয় দেশগুলো অস্তিত্বগত হুমকির মুখে রয়েছে। ২০১৪ সাল থেকে ন্যাটো রাশিয়ার সীমান্তের কাছাকাছি সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি করেছে এবং সামরিক মহড়ার পরিমাণও বাড়িয়েছে। একই সঙ্গে তারা পূর্ব ইউরোপ অঞ্চলে তাদের সামরিক অবস্থান শক্তিশালী করেছে এবং ইউক্রেনকে ব্যাপক সামরিক সহায়তা দিয়েছে।
রাশিয়া ও ন্যাটোর সাম্প্রতিকতম বাকযুদ্ধে, রুশ নিরাপত্তা কাউন্সিলের উপপ্রধান দিমিত্রি মেদভেদেভ বলেছেন, ন্যাটো মস্কোর শত্রু। তিনি সতর্ক করে বলেছেন, “শত্রু যদি আত্মসমর্পণ না করে, তাহলে তাকে ধ্বংস করা হবে।” প্রেসিডেন্ট পুতিনও মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বলেছেন, রাশিয়া ইউরোপের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চায় না। তিনি বলেন, “আমরা ইউরোপের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাই না—আমি এটা শতবার বলেছি। তবে যদি ইউরোপ হঠাৎ যুদ্ধ শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে আমরা এখনই সেই পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত।”
রাশিয়ার শীর্ষ কর্মকর্তাদের এই কঠোর সতর্কবার্তার তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে ন্যাটো। ন্যাটো জোটের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা দাবি করেছেন, রুশ সেনাবাহিনী ইউরোপীয় দেশগুলোকে সামরিকভাবে মোকাবিলা করার সক্ষমতা রাখে না। তিনি বলেন, “পুতিন জানেন যে ন্যাটো তার মিত্রদের সুরক্ষার বিষয়ে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি ঐক্যবদ্ধ।” তিনি আরও দাবি করেন, “জোটের সদস্য কোনো দেশের ওপর হামলা হলে ন্যাটো নির্লিপ্ত থাকবে না এবং রাশিয়ার পুরো ন্যাটোর মোকাবিলা করার সামর্থ্য নেই।”
রাশিয়া ও ন্যাটোর যুদ্ধংদেহী বক্তব্যের একই সময়ে ন্যাটো–রাশিয়া কাউন্সিল ভেঙে দেওয়াকে এখন দুই পক্ষের উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় হিসেবে দেখা হচ্ছে। ২০০২ সালে নিরাপত্তা সংলাপ, আস্থা বৃদ্ধি এবং সহযোগিতার উদ্দেশ্যে গঠিত এই কাউন্সিল বর্তমানে তার মূল লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। ন্যাটোর পূর্বমুখী সম্প্রসারণ, ইউক্রেন ও জর্জিয়া সংকটসহ মৌলিক মতপার্থক্যগুলো ক্রমেই এই কাঠামোকে অকার্যকর করে তুলেছে। এখন এর আনুষ্ঠানিক বিলুপ্তির পর প্রশ্ন উঠছে—বিশ্ব কি রাশিয়া ও পশ্চিমাদের মধ্যে এক নতুন কাঠামোগত দ্বন্দ্ব দেখতে যাচ্ছে?
একদিকে এটি দুই পক্ষের মধ্যে আনুষ্ঠানিক সংলাপ চ্যানেলের চূড়ান্ত পতন নির্দেশ করে। যদিও বাস্তবতা হচ্ছে, প্রতিষ্ঠানগত সংলাপের অনুপস্থিতি সামরিক ভুল হিসাবের ঝুঁকি বাড়ায় এবং সরাসরি সংঘর্ষের সম্ভাবনা উঁচু করে।
অন্যদিকে, রাশিয়া তার কৌশলগত স্বাধীনতার ওপর জোর দিচ্ছে এবং চীনসহ অ-পশ্চিমা শক্তিগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াচ্ছে—যা ইঙ্গিত করে যে, ন্যাটোর সঙ্গে যৌথ কাঠামো বজায় রাখার প্রতি তাদের আগ্রহ কমে গেছে।
তবে মনে রাখতে হবে, ন্যাটো–রাশিয়া কাউন্সিলের বিলুপ্তি একেবারে নতুন কোনো পরিস্থিতির সূচনা নয়—বরং বহু বছর ধরে চলমান একটি প্রক্রিয়ার আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি। ২০১৪ সালের ইউক্রেন সংকটের পর থেকেই রাশিয়া–পাশ্চাত্য সম্পর্ক প্রকাশ্য বিরোধের পর্যায়ে প্রবেশ করেছে এবং নিরাপত্তা সহযোগিতা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই কাউন্সিলের কার্যকারিতা ছিল প্রতীকী—বাস্তব নয়। তাই এর বিলুপ্তিকে পূর্ববর্তী বিভেদের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি হিসেবে দেখা যেতে পারে। অর্থাৎ নতুন পর্যায় শুরু হয়নি, বরং বিদ্যমান উত্তেজনাপূর্ণ বাস্তবতা আরও গভীর হয়েছে।
সব মিলিয়ে এটা বলা যায়, রাশিয়া ও পাশ্চাত্যের মধ্যে নিকট ভবিষ্যতে সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা কম বরং তারা দীর্ঘমেয়াদি ও জটিল উত্তেজনার পথে এগোচ্ছে।#
পার্সটুডে/এসএ/৪
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।