আমেরিকা কি বিশ্ব শান্তির রক্ষক?
আমেরিকার কথিত শান্তির যুগের অবসান কি উদ্বেগজনক? নাকি সুযোগ?
-
• জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মেয়ার্জ
পার্সটুডে- জার্মান চ্যান্সেলর মিউনিখে সিএসইউ পার্টি কংগ্রেসে তার বক্তৃতায় ঘোষণা করেছেন যে "প্যাক্স আমেরিকানার দশকগুলো মূলত শেষ হয়ে গেছে" এবং আমেরিকানরা এখন তাদের নিজস্ব স্বার্থ নিয়ে ভাবছে।
জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মেয়ার্জ ২০২৫ সালের ১৩ ডিসেম্বর মিউনিখে খ্রিস্টান সোশ্যাল ইউনিয়ন (সিএসইউ) পার্টি কংগ্রেসে তার বক্তৃতায় ঘোষণা করেন: "প্যাক্স আমেরিকানার দশকগুলো অর্থাৎ তথাকথিত আমেরিকান শান্তির যুগ জার্মানিসহ ইউরোপে আমাদের জন্য মূলত শেষ হয়ে গেছে। আমরা যেভাবে জানতাম সেভাবে এটি আর বিদ্যমান নেই। আমেরিকানরা এখন খুব দৃঢ়তার সাথে তাদের স্বার্থ রক্ষা নিয়ে ভাবছে এবং তাই আমাদেরও আমাদের নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে হবে।"
ট্রাম্প প্রশাসনের "আমেরিকা ফার্স্ট" নীতি এবং ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে মেয়ার্জ এই বিবৃতি দিয়েছেন এবং ইউরোপকে তার স্বাধীন প্রতিরক্ষা নীতি শক্তিশালী করার আহ্বান জানিয়েছেন?
কিন্তু সত্যিই কি আমেরিকান কথিত শান্তির যুগের অবসান উদ্বেগজনক?
প্রকৃতপক্ষে, প্যাক্স আমেরিকানা ধারণা- যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়কালকে নির্দেশ করে এবং কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বব্যাপী নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার গ্যারান্টার হিসেবে চিত্রিত করে – তাই এটি কখনও বিশ্বব্যাপী শান্তির জন্য ছিল না। এ বিষয়টি আমেরিকান আধিপত্যের জন্য ক্ষেত্র তৈরি করে।
যদিও কিছু পশ্চিমা অঞ্চলে, বিশেষ করে ন্যাটো মিত্রদের জন্য আপেক্ষিক শান্তি ছিল, এই শান্তি কয়েকটি দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল কিন্তু বিশ্বজুড়ে অনেক জাতির জন্য যুদ্ধ, সামরিক হস্তক্ষেপ এবং অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করেছিল। ১৯৫০-এর দশকে কোরিয়ান যুদ্ধ থেকে শুরু করে, লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু, ভিয়েতনাম যুদ্ধে দশ লক্ষেরও বেশি হতাহতের ঘটনা এবং লাতিন আমেরিকায় হ্স্তক্ষেপ বিশেষ করে ১৯৭৩ সালে চিলিতে অভ্যুত্থান কিংবা গুয়াতেমালা এবং এল সালভাদরের স্বৈরশাসকদের সমর্থন দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রায়শই সংঘাত বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে।
পশ্চিম এশিয়ায়ও পারস্য উপসাগরীয় যুদ্ধ, আফগানিস্তান এবং ইরাক যুদ্ধ লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা এবং বাস্তুচ্যুত করেছে। এমনকি ইউরোপেও, মেয়ার্জ আমেরিকান শান্তির অবসান নিয়ে চিন্তিত, কারণ প্যাক্স আমেরিকানা কখনও টেকসই হয়নি।
১৯৯০-এর দশকে সাবেক ইউগোস্লাভিয়ার যুদ্ধ, যার মধ্যে বসনিয়ার যুদ্ধ (১৯৯২-১৯৯৫), যেখানে ১,০০,০০০-এরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছিল এবং কসোভো যুদ্ধ (১৯৯৮-১৯৯৯) যা নিজেই একটি ন্যাটো বোমা হামলা অভিযান ছিল যার ফলে বেসামরিক নাগরিকরাও নিহত হয়েছিল, এসব ঘটনা থেকে আমেরিকার কথিত শান্তির শ্লোগানের মিথ্যাচার ফুটে উঠে।
এই সংঘাতগুলো স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী ব্যবস্থার পতনের মধ্যেই এর মূল নিহিত ছিল। আজ, ইউক্রেনের যুদ্ধ ২০২২ সাল থেকে ইউরোপকে সংকটে নিমজ্জিত করেছে, যা প্রমাণ করে যে আমেরিকান নেতৃত্ব বড় যুদ্ধ প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
এখন মৌলিক প্রশ্ন হল: আমেরিকা কি সত্যিই বিশ্ব শান্তির কর্তৃত্ব এবং অভিভাবক ছিল? ঐতিহাসিক প্রমাণের ভিত্তিতে উত্তর হল, না।
১৯৪৫ সাল থেকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০০ টিরও বেশি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সামরিক অভিযানে অংশগ্রহণ করেছে, ইরানে সিআইএ অভ্যুত্থান (১৯৫৩) এবং নিকারাগুয়ায় কন্ট্রাদের সমর্থন থেকে শুরু করে ইরাক ও আফগানিস্তানে দীর্ঘ যুদ্ধ পর্যন্ত যেখানে ৯০০,০০০ এরও বেশি সরাসরি জীবনহানি ঘটেছে। এই হস্তক্ষেপগুলি প্রায়শই স্থায়ী শান্তির পরিবর্তে আমেরিকান অর্থনৈতিক বা ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থকে রক্ষার চেষ্টা করেছে। জন ডোভারের মতো ইতিহাসবিদরা এই সময়কালকে "আমেরিকান সহিংসতার শতাব্দী" বলে অভিহিত করেছেন। অন্য কথায়, প্যাক্স আমেরিকানা ছিল একটি চাপিয়ে দেওয়া আধিপত্য: মিত্রদের জন্য শান্তি, কিন্তু অন্যদের জন্য যুদ্ধ।
পরিশেষে, এটা বলা যেতে পারে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে শান্তির কর্তৃত্ব এবং অভিভাবক ছিল না। এর প্রধান কারণগুলি হল:
প্রথমত, ব্যাপক সামরিক হস্তক্ষেপ যা যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত এবং তীব্র করেছে;
দ্বিতীয়ত, কমিউনিজম বা ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য দমনমূলক শাসনব্যবস্থার প্রতি সমর্থন, যার ফলে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে;
তৃতীয়ত, বিশ্বব্যাপী ন্যায়বিচারের চেয়ে আমেরিকান জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া, যা বিশ্বব্যাপী দক্ষিণের দেশগুলিকে দূরে ঠেলে দিয়েছে; এবং
চতুর্থত, এমনকি ইউরোপে, যেমন বলকান এবং ইউক্রেনে, বড় ধরনের সংঘাত প্রতিরোধে অক্ষমতা দেখিয়েছে।
অতএব, যদি জার্মান চ্যান্সেলরের দাবি অনুসারে, প্যাক্স আমেরিকানা, বা তথাকথিত আমেরিকান শান্তির যুগ শেষ হয়ে আসছে, তবে এটি কোনও বিপর্যয় নয়, বরং বিশ্বে আরও ন্যায়সঙ্গত এবং বহুমেরু ব্যবস্থার জন্য একটি সুযোগ।#
পার্সটুডে/এমআরএইচ/১৫
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।