সুন্নি মনীষীদের দৃষ্টিতেও কেন ইয়াজিদ চরম ঘৃণার পাত্র?
শোকাবহ মহররম মাস এখনও চলছে। কালজয়ী কারবালা বিপ্লবের মহানায়ক ও শহীদদের সর্দার ইমাম হুসাইন (আ.) এবং তাঁর ৭২ জন শহীদ সঙ্গী ও আত্মীয়-স্বজন সম্পর্কে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)সহ ইসলামের মহান মনীষীদের মন্তব্য আমরা তুলে ধরেছি ।
এমনকি আমরা এ বিষয়ে অনেক অমুসলিম মনীষীর প্রশংসাসূচক বক্তব্যও তুলে ধরেছি। অন্যদিকে মহাশয়তান অভিশপ্ত ইয়াজিদ ও তার দলবল সব সময়ই ইমাম হুসাইন (আ.) সম্পর্কে নানা ধৃষ্টতাপূর্ণ, অশালীন ও অযৌক্তিক মন্তব্য করেছে। মহাবেয়াদব ইয়াজিদের কাছে ‘যখন ইমামের কর্তিত শির মুবারক আনা হয় তখন ইয়াজিদ তার হাতে থাকা বেতের ছড়িটি দিয়ে ওই পবিত্র শিরে খোঁচা মারতে থাকে। (হাসান বসরির বর্ণনা, ইবনে কাসিরের বই-বিদায়া ও নিহায়া। (খণ্ড -৭, পৃষ্ঠা-১২২)
ইবনে কাসির অন্য এক সূত্রে উল্লেখ করেছেন: “ইয়াজিদের হাতে একটি বেতের ছড়ি ছিল। সে তা দিয়ে হযরত হুসাইন (আ.)’র দাঁত মুবারকের ওপর প্রহার করে দাগ বসিয়ে দেয়। এরপর (অভিশপ্ত) ইয়াজিদ বলে: এর এবং আমাদের দৃষ্টান্ত হল যেমনটি হুসাইন ইবনুল হারাম মুররি বলেছে: আমাদের কাছে শক্তিমান বহুজনের মস্তক চৌচির করে ফেলা হয় এমতাবস্থায় যে তারা ‘বড় নাফরমান’ ও ‘চরম জালিম’।
[অর্থাৎ ইয়াজিদের দৃষ্টিতে হযরত হুসাইন (আ.) ছিলেন নাকি বড় নাফরমান ও জালিম (নাউজুবিল্লাহ)। তাই তাঁকে ও তাঁর সঙ্গীদের পিপাসার্ত অবস্থায় হত্যার পাশাপাশি তাঁদের লাশের ওপর ঘোড়া দাবড়িয়ে সেসবকে ছিন্ন-ভিন্ন করাসহ তাঁদের সঙ্গে যেসব বর্বর-পৈশাচিক আচরণ করা হয়েছে সেসবই ছিল তার দৃষ্টিতে যৌক্তিক!!! (নাউজুবিল্লাহ)]
অন্য বর্ণনা অনুযায়ী ইয়াজিদ ইমাম হুসাইন (আ.)’র কর্তিত শিরের দু’টি চোখে ও তাঁর নাসিকায় বেত্রাঘাত করেছিল। আর এ দৃশ্য দেখে রাসূল (সা.)’র সাহাবি আবু বারজা (রা.) তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে ইয়াজিদকে বলেন: তুমি কি তোমার ছড়ি দিয়ে হুসাইনের দাঁতের সারিতে আঘাত করে দাগ বসিয়ে দিলে? সাবধান! তোমার ছড়িটি তাঁর দাঁতের সারিতে দাগ বসিয়েছে এমন স্থানে যেখানে মুখ রেখে চুষতে দেখেছি আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে। সাবধান রোজ হাশরে তথা বিচার দিবসে তোমার শাফায়াতকারী (বিদ্রূপাত্মক অর্থে) বা সঙ্গী হবে (অভিশপ্ত) ইবনে জিয়াদ। আর হুসাইনের শাফায়াতকারী হবেন খোদ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)। এ কথা বলে তিনি ইয়াজিদের দরবার থেকে বের হয়ে যান। (তাবারি এবং বিদায়া ও নিহায়া। খণ্ড যথাক্রমে ৭ ও ৫ এবং পৃ-১৯২;২৬৮ ও ৫১৬। )
ইয়াজিদ মদিনায় নিযুক্ত উমাইয়া শাসক ওয়ালিদ ইবনে উতবাকে নির্দেশ দিয়েছিল-“ হুসাইনকে, আবদুল্লাহ ইবনে ওমরকে, আবদুর রহমান ইবনে আবুবকরকে ও আবদুল্লাহ ইবনে যোবাইরকে শক্তভাবে বায়আত করার জন্য পাকড়াও কর। যে-ই বায়আত তথা আমার আনুগত্য প্রকাশ করতে অস্বীকার করবে তার মাথা কেটে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও” (মাকতালই খাওয়ারিজমি, ১ম খণ্ড, ১৭৮-১৮০পৃ.)
অভিশপ্ত ইয়াজিদ ইমাম হুসাইন (আ.)কে শহীদ করার ঘটনার পর বলেছিল: আমার পূর্বপুরুষরা যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে তারা দেখতেন যে, কিভাবে আমি মুহাম্মাদের পরিবার ও (তাঁদের গোত্র) বনি হাশিমের কাছ থেকে প্রতিশোধ নিয়েছি।
অভিশপ্ত ইয়াজিদ এক কবিতা আবৃত্তি করে বলেছিল: আমি আহমদের (রাসূল-সা.) কাছ থেকে প্রতিশোধ নিয়েছি বদর যুদ্ধের বদলা হিসেবে যা সে (তিনি) করেছিল ওই যুদ্ধে আমাদের পূর্ব পুরুষদের বিরুদ্ধে।
লম্পট ও মদ্যপ ইয়াজিদ আরো বলেছিল: মদ যদি দ্বীনে মুহাম্মাদিতে হারাম হয়ে থাকে তবে ঈসা ইবনে মারিয়মের ধর্ম তথা খ্রিস্টান ধর্মের আলোকে হালাল হিসেবে খাও!!! (তাফসিরে ইবনে মাজহারি, খ-৫, পৃ-২১১-১২)
ইয়াজিদের এতসব কুফরি কাজ ও বর্বরতা সত্ত্বেও আজকাল ও অতীতেও নানা যুগে একদল জ্ঞান-পাপী ও অজ্ঞ (এদের অনেকই ইয়াজিদ ও মুয়াবিয়া বা তার সঙ্গীদের বংশধর) এবং একদল সুবিধাবাদী এটা দাবি করেন যে ইয়াজিদ নাকি হুসাইন (আ.)-কে হত্যার নির্দেশ দেয়নি। বরং ইমাম ও তাঁর সঙ্গীরা শহীদ হওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন এবং ইবনে জিয়াদ ইমাম ও নবী-পরিবারকে হত্যা করায় ইয়াজিদ তাকে তিরস্কার করেছিল।
এটা যে আষাঢ়ে গল্প বা সত্য হয়ে থাকলেও তা যে ইয়াজিদের প্রতারণামূলক একটি ‘অভিনয়’ বা সংক্ষিপ্ত নাটক ছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তা-না হলে ইয়াজিদ ইমাম হুসাইন (আ.) ও নবী-পরিবারের হত্যাকারীদের বিচার করে তাদের শাস্তি দিত। এ ছাড়াও ইয়াজিদ এতটা বিবেকবান ও ভাল মানুষ হলে তার বাহিনী মক্কা ও মদীনায়ও হামলা চালিয়ে এ দুই পবিত্র শহরে হাজার হাজার সাহাবিদেরকে হত্যা করত না এবং মদীনার নারীদের ওপর গণ-ধর্ষণ চালাতে তার সেনাদের নির্দেশ দিত না। (ধর্ষিত হয়েছিল এক হাজার কুমারী মেয়ে)।মক্কা ও মদিনায় রক্ত-গঙ্গা বইয়ে দেয়ার পাশাপাশি ইয়াজিদের বাহিনী বিশ্বনবী (সা.)’র পবিত্র রওজা সংলগ্ন মসজিদকে ঘোড়ার আস্তাবল বানিয়ে এমন পবিত্র স্থানকে ঘোড়ার মল-মূত্র দিয়ে অপবিত্র করেছে এবং তারা পবিত্র কাবা ঘরে অগ্নিসংযোগ করেছিল। আর এইসব বর্ণনা নির্ভরযোগ্য সুন্নি ঐতিহাসিক সূত্রেই বর্ণিত হয়েছে। (বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন মাওলানা শাহ আবদুল হক দেহলাভীর লিখিত ‘কারবালার পর পবিত্র মক্কা ও মদীনায় ইয়াজিদি তাণ্ডবলীলা’ শীর্ষক ঐতিহাসিক প্রবন্ধ)
ইমাম হুসাইন (আ.):
ইয়াজিদ ভাল মানুষ হলে ইমাম হুসাইন (আ.) এ কথা বলতেন না যে, ইয়াজিদের মত অসৎ লোক যদি মুসলমানদের (স্বীকৃত) নেতা হয় তাহলে ইসলাম চির-বিদায় নেবে। ইয়াজিদ ভাল মানুষ হলে মক্কা ও মদিনার বিখ্যাত সাহাবিরা তাকে সমর্থন করতেন, কিন্তু তারা তা করেননি বলেই মক্কা ও মদিনায় যুদ্ধ চাপিয়ে দেয় ইয়াজিদ।
সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে যোবাইর:
ইয়াজিদ এটা শুনেছিল যে সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে যোবাইর বলতেন: ইয়াজিদ এক প্রতারক, মাতাল ও সত্য পথ পরিত্যাগকারী এবং এমন এক ব্যক্তি যে গায়িকা নারীদের সঙ্গে থাকে। (বিদায়া ও নিহায়া, খণ্ড-৮ পৃ-২৭৯) তিনি মদীনায় ইয়াজিদ বাহিনীর হত্যা ও অপরাধযজ্ঞকেও বৃহত্তম ও কুৎসিততম অপরাধ বলে উল্লেখ করেছিলেন।
এমনকি ইবনে জিয়াদও ইয়াজিদকে ফাসিক বলেছে:
এমনকি ইয়াজিদের দোসর ইবনে জিয়াদও মক্কায় হামলা চালানোর ব্যাপারে তার রাজা ইয়াজিদের হঠকারী নির্দেশে ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিল: আল্লাহর শপথ! এক ফাসিকের জন্য আমি দু’টি বিষয় সমন্বিত করব না। আমি এরিমধ্যে নবীর কন্যার সন্তানকে হত্যা করেছি। আর এখন সে (ইয়াজিদ) আমাকে বায়তুল হারামে যুদ্ধ বাধাতে বলছে। ইবনে জিয়াদ যখন ইমাম হুসাইন (আ.)-কে শহীদ করে তখন জিয়াদের মা মারজানা তীব্র তিরস্কার করে পুত্রকে বলেছিল: তোমার মৃত্যু হোক! তুমি কি করলে এবং কত বড় অপরাধ করেছ! (বিদায়া ও নিহায়া, খণ্ড-৮ পৃ-২৭৯)
ইয়াজিদের ছেলে মুয়াবিয়া ইবনে ইয়াজিদ:
ইয়াজিদ যে নিকৃষ্টতম ব্যক্তি ছিল তা তার ছেলে মুয়াবিয়া(দ্বিতীয়)ও উল্লেখ করেছিল বলে ইতিহাসে বর্ণনা এসেছে। ইয়াজিদ ইমাম হুসাইন (আ.) ও তাঁর পরিবার এবং সঙ্গীদের হত্যা করায় মুসলমানদের মধ্যে ইয়াজিদ পরিবার কলঙ্কিত হয়েছে বলে উল্লেখ করে মুয়াবিয়া ইবনে ইয়াজিদ এবং এ জন্য সে ইয়াজিদের মৃত্যুর পর কথিত খলিফা হতে রাজি হয়নি।
ইয়াজিদের অভিশপ্ত হওয়া সংক্রান্ত আরো এক অকাট্য যুক্তি:
সুন্নি মনীষী ইবনে কাসিরের বিদায়া ও নিহায়ার অষ্টম খণ্ডের ২৭৪ পৃষ্ঠায় এ হাদিসটি উল্লেখিত হয়েছে ইমাম হাম্বলের মুসনাদ থেকে। এতে বলা হয়েছে: যে অবিচার ছড়িয়ে দেয় ও মদীনার লোকদের ভীত-সন্ত্রস্ত করে তার ওপর আল্লাহর ও তাঁর ফেরেশতাদের এবং সব মানুষের অভিশাপ বর্ষিত হয়।
পবিত্র কুরআনেও (সুরা আহজাবে) বলা হয়েছে: যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে বিরক্ত করে বা কষ্ট দেয় আল্লাহ দুনিয়া ও আখিরাতে তথা পরকালে তাদের ওপর অভিশাপ দেন এবং তাদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছেন অপমানজনক বা লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি। (৩৩:৫৭)
সুন্নি মনীষী ইমাম ইবনে হাজার আসকালানি:
কেবল কোনো বেদাআতির পক্ষেই ইয়াজিদকে ভালবাসা ও তাকে সম্মানিত করা সম্ভব। ইয়াজিদের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য এমনই যে তার ভক্তরাও ঈমানহীন হতে বাধ্য।
দ্বিতীয় ওমর নামে খ্যাত উমাইয়া শাসক:
তার সামনে একদিন এক ব্যক্তি ইয়াজিদকে আমিরুল মুমিনিন (মুমিনদের নেতা) বলে উল্লেখ করায় ওমর ওই লোকটির ওপর চাবুকের বিশটি আঘাত হানার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ( ইমাম হাজার আসকালানির তাহজিব আত্বতাহজিব, খণ্ড-৬, পৃ-৩১৩)
ইমাম সুয়ুতিও অভিশাপ দিয়েছেন ইয়াজিদকে:
তিনি তারিখুল খোলাফা বইয়ে লিখেছেন: আপনাকে (ইমাম হুসাইন-আ.) শহীদ করা হয়েছে এবং আপনার মস্তক প্লেটে করে নেয়া হয়েছে ইবনে জিয়াদের কাছে। আল্লাহর লানত বা অভিশাপ বর্ষিত হোক যে আপনাকে হত্যা করেছে এবং অভিশাপ বর্ষিত হোক ইবনে জিয়াদ ও ইয়াজিদের ওপর। (পৃ-১৬৫)
ইমাম ওয়াকিদি:
তিনি আবদুল্লাহ বিন খাজালাতুল ঘুসাইল (সাহাবী) থেকে জানিয়েছেন, ওই সাহাবি বলেছেন, ‘আমরা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম যে ইয়াজিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করলে আল্লাহর আজাব হিসেবে আকাশ থেকে আমাদের ওপর পাথর বর্ষিত হবে, খোদার কসম, (এই বিশ্বাসে) নিশ্চিত হওয়ার পরই আমরা বিদ্রোহ শুরু করি ইয়াজিদের বিরুদ্ধে।’ ইয়াজিদপন্থীরা তথা ইয়াজিদের অনুসারী ও সাঙ্গপাঙ্গরা নিজ মা, বোন ও কন্যাদের বিয়ে করা শুরু করেছিল (জাহেলি যুগের মত), তারা প্রকাশ্যে মদ পান করত এবং নামাজকে উপেক্ষা করত।
ইমাম জাহাবি:
ইয়াজিদ যখন মদিনাবাসীর সঙ্গে এইসব আচরণ (অপরাধযজ্ঞ) করল এবং এর আগে মদপানসহ নানা পাপে ডুবেছিল তখন মক্কার অধিবাসীরাও ইয়াজিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ও চার দিক থেকে জেগে ওঠে। এরপর আল্লাহ ইয়াজিদের জীবনে বরকত দেননি। এরপর ইয়াজিদ মক্কা আক্রমণ করে এবং আবদুল্লাহ ইবনে যোবাইরকে শহীদ করে বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। (সুয়ুতির তারিখুল খোলাফা। পৃ-১৬৭)
তিনি আরো বলেছেন, ইয়াজিদ ছিল ঘৃণ্য নাসিবি তথা মহানবীর (সা.) পরিবারের পবিত্র সদস্যগণ তথা আহলে বাইত-বিদ্বেষী। সে মদ পান করত ও পাপাচারে লিপ্ত ছিল। ইমাম হুসাইন (আ.)-কে শহীদ করার মাধ্যমে সে তার রাজত্ব শুরু করে এবং মক্কা ও মদীনায় মহাবিপর্যয় ঘটায়। তাই লোকেরা তাকে ঘৃণা করত ও তার জীবনে কোনো বরকত ছিল না। ইমাম হুসাইন (আ.)’র শাহাদতের ঘটনার পর মদীনার অনেকেই আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্যই ইয়াজিদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়।
(আসসিয়ার আল আলাম আন নাবুলা, খণ্ড-৪, পৃ-৩৭-৩৮)
ইমাম জাহাবি আরো লিখেছেন:
জিয়াদ হারিসি বলেছে, ইয়াজিদ আমাকে মদ পান করতে দেয়। সেরকম মদ আমি আর কখনও অতীতে পান করিনি। এই মদের উপাদান সম্পর্কে প্রশ্ন করতে ইয়াজিদ জানায়: এই মদ বানাতে ব্যবহৃত হয়েছে মিষ্টি ডালিম, ইস্পাহানের মধু, হাওয়াজের/ বা আহওয়াজের চিনি, তায়েফের আঙ্গুর এবং বুরাদার পানি।
আহমদ বিন মাসামা জানিয়েছেন:
একদিন ইয়াজিদ মদ পান করে নাচতে শুরু করে। হঠাৎ সে পড়ে যায় এবং তার নাক থেকে রক্ত ঝরতে থাকে। (আসসিয়ার আল আলাম আন নাবুলা, খণ্ড-৪, পৃ-৩৭)
ইয়াজিদ সম্পর্কে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল :
ইমাম হাইথামি ও আল বারাজানি লিখেছেন ইমাম আহমদকে তার ছেলে আবদুল্লাহ ইয়াজিদের ওপর অভিশাপ দেয়ার যুক্তি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান: পবিত্র কুরআনের সুরা মুহাম্মাদের ২২ ও ২৩ নম্বর আয়াতের আলোকে ইয়াজিদকে অভিশাপ দেয়া বৈধ। এই আয়াতে বলা হয়েছে:
‘ক্ষমতা লাভ করলে, সম্ভবত: তোমরা পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তা বন্ধন ছিন্ন করবে। এদের প্রতিই আল্লাহ অভিসম্পাত করেন, অতঃপর তাদেরকে বধির ও দৃষ্টিশক্তিহীন করেন।’
ইয়াজিদের চেয়ে বড় অনর্থ বা নৈরাজ্য পৃথিবীতে আর কে সৃষ্টি করেছিল? (ইমাম আলুসির তাফসির গ্রন্থ রুহুল মায়ানি। খণ্ড-৯, সুরা মুহাম্মাদ-২২-২৩)
কাজি সানাউল্লাহ পানিপথি:
তিনি সুরা ইব্রাহিমের ২৮ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখেছেন, বনি উমাইয়ারা সব সময়ই কুফুরির মধ্যে ডুবে থেকে এ নিয়ে আনন্দ-ফুর্তি করত। ইয়াজিদ ও তার সঙ্গীরা আল্লাহর নেয়ামতের কুফরি করেছে এবং রাসূলের আহলে বাইতের বিরুদ্ধে শত্রুতার পতাকা তুলে শেষ পর্যন্ত পৈশাচিকভাবে ইমাম হুসাইন (আ.)-কে শহীদ করেছে। সে এতটা শত্রুতা করেছে যে মুহাম্মাদ (সা.)’র ধর্মকেই অস্বীকার করেছে।
(তুমি কি তাদের কে দেখনি, যারা আল্লাহর নেয়ামতকে কুফরে পরিণত করেছে এবং স্ব-জাতিকে সম্মুখীন করেছে ধ্বংসের আলয়ে।
দোযখের? তারা তাতে প্রবেশ করবে সেটা কতই না মন্দ আবাস। সুরা ইব্রাহিম-২৮)
মাতাল ইয়াজিদ সম্পর্কে ইবনে জাওজির সাক্ষ্য:
তিনি লিখেছেন, ইয়াজিদ তার চাচাতো ভাই ওসমান বিন মুহাম্মাদ বিন আবু সুফিয়ানকে মদীনার গভর্নর পদে নিয়োগ দেয়। ওসমান মদিনাবাসীর একটি প্রতিনিধিকে ইয়াজিদের কাছে পাঠান। ইয়াজিদ নানা উপহার নিয়ে অপেক্ষা করছিল যাতে ওই প্রতিনিধিদলের আনুগত্য আদায় করা যায়। প্রতিনিধিদল ফিরে এসে মদিনাবাসীকে ও সাহাবিদের জানান: আমরা এমন একজন লোকের কাছে গিয়েছিলাম যার কোনো ধর্ম নেই, সে মদ পান করে, বাদ্যযন্ত্র বাজায়, গায়িকাদের সঙ্গে থাকে ও কুকুরের সঙ্গে (সঙ্গম) থাকে। আমরা তার প্রতি আনুগত্য করার শপথ পরিহার করলাম বলে ঘোষণা করছি। আবদুল্লাহ বিন আবি আমরো বিন হাফস ইয়াজিদের কাছ থেকে উপহার পাওয়া সত্ত্বেও তাকে আল্লাহর শত্রু ও মাতাল বলে উল্লেখ করে এবং তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার শপথ নেয়।
ইয়াজিদ সম্পর্কে ইবনে কাসির: নানা হাদিস থেকে জানা যায়, ইয়াজিদ ছিল নানা পাপে আসক্ত। সে মদপান করত, গান শুনত, বালকদের সঙ্গে সমকামে লিপ্ত হত, ঢোল বাজাত, কুকুরের সঙ্গে সঙ্গম করত। ইয়াজিদ ব্যাঙ, ভালুক ও বানরের মধ্যে যুদ্ধ বাধাত। প্রত্যেক সকালে সে মাতাল হত এবং ঘোড়ার লাগামের মধ্যে বানর বেধে ঘোড়াকে দৌড়াতে বাধ্য করত। (বিদায়া ও নিহায়া, খণ্ড-৮, পৃষ্ঠা-১১৬৯)
সুন্নি ঐতিহাসিক ও মনীষীরা ইয়াজিদ তো দূরের কথা মুয়াবিয়াকেও ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি ও শাসক বলে মনে করতেন না, যেমনটি তা মনে করতেন না আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ.)।
মুয়াবিয়া মুসলিম ইতিহাসের সর্বপ্রথম বাদশাহ বা রাজা
‘তারিখুল খোলাফা’ নামক বইয়ে মুয়াবিয়াকে ‘সর্বপ্রথম বাদশাহ’ বলা হয়েছে। (এ বিষয়ে একমত পোষণ করেছেন ভারতবর্ষের বিখ্যাত সুন্নি আলেম শাহ আবদুল আজিজ দেহলাভি।) একই বইয়ে মুয়াবিয়ার মাধ্যমে প্রচলিত নানা বিদাআত হিসেবে মসজিদে লোকজনের সামনে বসে খুতবা দেয়া, ঈদের জামাতে বিদাআতী পন্থায় খুতবা দেয়া, ঈদের জামাতের জন্য আযান চালুর বিদাআত ও ঈদের নামাজের তাকবিরের সংখ্যা কমিয়ে দেয়াকে মুয়াবিয়ার অপকীর্তি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
মুয়াবিয়া সম্পর্কে শাহ আবদুল আজিজ দেহলাভির উদ্ধৃত তথ্য:
শাহ আবদুল আজিজ দেহলাভি তার বিখ্যাত বই তোহফায়ে ইসনা আশারিয়া বইয়ে লিখেছেন: ইমাম তিরমিজি বলেছেন, বনু উমাইয়াদের খলিফা হওয়ার দাবি মিথ্যা। তারাতো বাদশাহ মাত্র এবং তাও জঘন্য ধরনের বাদশাহ।
মিশকাত শরিফের হাদিসে সাহাবি আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত হয়েছে: রাসূল (সা.) বলেছেন, খিলাফত মদিনায় আর রাজতন্ত্র সিরিয়ায়। (মিশকাতুল মাসাবিহ, ৫৮৩, দিল্লি থেকে প্রকাশিত) অর্থাৎ রাসূল (সা.) সিরিয়া থেকে রাজতন্ত্র শুরু হবে বলে উল্লেখ করে গেছেন। হযরত আলী (আ.) মদিনাতেই খলিফা হয়েছিলেন এবং সেখানেই জনগণ তার প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেছেন। অবশ্য পরে তিনি তার রাজধানী মদীনা থেকে কুফায় স্থানান্তর করেন। অন্যদিকে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মুয়াবিয়ার রাজধানী ছিল সিরিয়ায়।
আল্লামা বুরহানুদ্দিন:
সুন্নি হানাফি ফিকাহর প্রসিদ্ধ গ্রন্থ হিদায়ায় আল্লামা বুরহানুদ্দিন মুয়াবিয়াকে ‘জালিম বাদশাহদের সারিতে’ স্থান দিয়েছেন এবং আলী (আ.) ন্যায় বা হকের পক্ষে ছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন। (হিদায়া, খণ্ড-৩, পৃ-১৩৩, বিচারকার্য অধ্যায়)
সুন্নি মাজহাবের ফাতহুল কাদির গ্রন্থে এসেছে: “সত্য সেযুগে আলীর সঙ্গেই ছিল। কারণ, তাঁর (নেতৃত্বের প্রতি জনগণের) বায়আত (আনুগত্যের শপথ) বিশুদ্ধ ছিল ও তা গৃহীত হয়। তাই তিনি জামাল যুদ্ধে ন্যায়ের পথে ছিলেন ও মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে সিফফিনের যুদ্ধের সময়ও ন্যায়ের পথে ছিলেন। এ ছাড়াও আলী (আ.)’র ন্যায় পথে থাকার প্রমাণ পাওয়া যায় আম্মারের প্রতি রাসূলের (সা.) উক্তির আলোকে। রাসূল (সা.) আম্মারকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, তোমাকে বিদ্রোহী গোষ্ঠী হত্যা করবে। আর তাঁকে হত্যা করেছিল মুয়াবিয়ার সঙ্গীরা। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে মুয়াবিয়ার ও তার সঙ্গীরা (আমর ইবনে আসসহ) বিদ্রোহী ছিল। ”
উল্লেখ্য আম্মার (রা.)-কে হত্যার ঘটনার পরও মুয়াবিয়া ও তার দল অন্যায্য পথে থাকার ব্যাপারে তাদের ভুল স্বীকার করেনি। ইমাম বুখারির বিখ্যাত হাদিস গ্রন্থ বুখারিতে (বুখারি, খণ্ড-১, পৃ-৩৯৪)এসেছে: .... হায়রে আম্মার! বিদ্রোহী গোষ্ঠী তোমাকে হত্যা করবে। আম্মার তাদেরকে আল্লাহর দিকে ডাকবে আর তারা (বিদ্রোহীরা) তাকে দোযখের আগুনের দিকে ডাকবে।(অর্থাৎ মুয়াবিয়ার দল জাহান্নামের দিকে আহ্বান জানাত। আর আম্মার ডাকতেন আলীর-আ. পথের দিকে তথা বেহেশতের দিকে।)
এমন স্পষ্ট হাদিসের পরও মুয়াবিয়া ইজতিহাদি (বা ইসলামী মূল নীতির ভিত্তিতে নতুন বা স্বতন্ত্র ব্যাখ্যা আবিষ্কার) ভুল করেছেন বলে সাফাই দেয়ার কোনো উপায় নেই। অন্যদিকে বুখারির হাদিসে (আম্মারের মানাকিব বা মর্যাদা অধ্যায়ে, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠ-৫৩০) এসেছে, (রাসুল-সা. বলেছেন,) ‘শয়তান কখনও আম্মারের ওপর প্রভাব ফেলতে পারবে না।’ আম্মার আগাগোড়াই ছিলেন আলীর (আ. পক্ষে। মুয়াবিয়া ও আমর ইবনে আস তা জানা সত্ত্বেও আলী (আ.)’র বিরুদ্ধে বিদ্রোহ অব্যাহত রেখেছিল এবং তারা আম্মারকে হত্যা করার পরও সঠিক পথ ধরেননি।
মুয়াবিয়ার নানা অপকীর্তির মধ্যে হযরত আলী (আ.)’র সঙ্গে নানা অন্যায় যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া, ইমাম হাসান (আ.)-কে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা এবং এই মহান ইমামের সঙ্গে করা চুক্তিগুলো লঙ্ঘনের কথা (যেমন, ইয়াজিদকে যুবরাজ নিয়োগ করা) বলা যায়। মুয়াবিয়া তৃতীয় খলিফা ওসমান হত্যার বদলা নেয়ার নাম করে ও সব কিছুর আগে ওই হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবি তুলে আলী (আ.)'র বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করেছিল। তার এইসব দাবি যে প্রতারণা ছিল তা স্পষ্ট হয়ে যায় যখন সে আলী (আ.)'র শাহাদতের পর থেকে নিজের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বহু বছরের মধ্যেও কখনও আর তৃতীয় খলিফাকে হত্যার বিচার প্রসঙ্গে কোনো পদক্ষেপই নেয়নি।
এবারে অভিশপ্ত ইয়াজিদ ও তার অভিশপ্ত নানা আচরণ সম্পর্কে আরো কয়েকজন প্রখ্যাত সুন্নি মনীষীর মন্তব্য বা মতামত এ নিবন্ধে তুলে ধরছি:
সুন্নি আকিদা বা বিশ্বাসের বিখ্যাত ও নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ ‘আকায়েদে নাসাফী’-তে এসেছে:
“কোনো কোনো আলেম ইয়াজিদের প্রতি লানত বা অভিশাপ দিয়েছেন। কারণ, ইয়াজিদ হুসাইনকে হত্যা করে কাফেরের কাজ করেছে। এই হত্যা ও হত্যার নির্দেশের জন্য এবং হুসাইনকে হত্যা করা বৈধ বা হালাল মনে করা ও এইসব কাণ্ডে সন্তোষ প্রকাশের জন্য এমন লোকদের প্রতি লানত বা অভিশাপ দেয়াকে সবাই বৈধ মনে করেন।... ইয়াজিদ ইমাম হুসাইনের শাহাদতে উল্লাস প্রকাশ করে এবং নবী-পরিবারকে অপমান করে আনন্দিত হয়। এইসব তথ্য নির্ভুল ও ব্যাপকভাবে সমর্থিত। তাই আমরা আহলে সুন্নাত আল জামায়াত ইয়াজিদের ব্যাপারে এতটুকু দ্বিধা বোধ করব না ও এমনকি তার ঈমানের প্রশ্নেও না- ইয়াজিদের ওপর অভিশাপ ও তার সাহায্যকারীদের ওপরও অভিশাপ। ইয়াজিদের পক্ষ সমর্থনকারীদের প্রতিও অভিশাপ।” (পৃ-১৬২)
আল্লামা সুয়ুতি:
ইয়াজিদের পিতা (মুয়াবিয়া) ইয়াজিদকে যুবরাজ নিযুক্ত করেন, আর তা মেনে নেয়ার জন্য জনগণের ওপর বলপ্রয়োগ করেন।
আল্লামা আলুসি: ইয়াজিদ কাফির ছিল
তিনি লিখেছেন খবিসটি (ইয়াজিদ) নবী (সা.)-কে রাসূল বা নবী বলেই বিশ্বাস করতো না, অর্থাৎ সে কাফির ছিল। মক্কা ও মদিনার জনগণের সঙ্গে এবং নবীর (সা.) পরিবারের সঙ্গে সে যা করেছে তাতে প্রমাণিত হয় যে সে কাফির ছিল। (তাফসিরে রুহুল মাআনি)
প্রখ্যাত এই সুন্নি তাফসিরকারক পবিত্র কুরআনের ‘রুহুল মাআনি’ নামক তাফসির গ্রন্থে লিখেছেন: “আমি আমার এ বিশ্বাসকেই বেশি গুরুত্ব দেই যে, খবিসটি (ইয়াজিদ) নবী (সা.)-কে রাসূল বা নবী বলেই বিশ্বাস করতো না, অর্থাৎ সে কাফির ছিল। সে কখনও অনুতপ্ত হয়নি দৃশ্যত। তার অনুতপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা ইমানদার হওয়ার সম্ভাবনার চেয়েও দুর্বল। আমি মনে করি বেশিরভাগ মুসলমানের কাছেই ইয়াজিদের কার্যকলাপ অজানা ছিল না। কিন্তু মুসলমানরা তখন অসহায়ভাবে বশীভূত ছিল।
আর যদি ধরে নেই খবিসটি (অপবিত্র) মুসলমান ছিল, তাহলেও বলতে হবে সে যাবতীয় বড় পাপ একত্রে করেছে যা বর্ণনা করার ভাষা নেই। আমি মনে করি তার মত ব্যক্তির প্রতি অভিশাপ দেয়া বৈধ। তার মত বড় পাপী কেউ আছে বলেও ধারণা করা যায় না।
ইয়াজিদ ছাড়াও (তার গভর্নর) ইবনে জিয়াদ, ওমর সাদ ও তাদের দলবলও অভিশাপ পাওয়ার উপযুক্ত। তাদের সবার ওপর আল্লাহর অভিশাপ। তাদের সাহায্যকারী, শুভাকাঙ্ক্ষী ও সাঙ্গপাঙ্গদের ওপরও লানত তথা অভিশাপ। আর যারা তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখাবে তাদের ওপরও অভিশাপ কিয়ামতের দিন পর্যন্ত এবং ততদিন যতদিন ইমাম হুসাইন (আ.)’র জন্য একটি মাত্র চোখ থেকেও অশ্রু ঝরবে। আর শিয়াদেরকে হেয় করার জন্য ইয়াজিদের পক্ষ নেয়াও মূর্খতার নিদর্শন।” (রুহুল মায়ানি, খণ্ড-২৫, পৃ-৭৩)
মাওলানা আশরাফ আলী থানবী:
ইয়াজিদ ছিল জালিম, ফাসিক ও নালায়েক (অযোগ্য)। আর ইমাম হুসাইন (আ.) ছিলেন মজলুম ও শহীদ। ইয়াজিদ বল প্রয়োগের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলকারী। আর এ ধরনের কাজ অবৈধ বা নাজায়েজ।
ইয়াজিদকে বড় করে তুলে ধরার জন্য যুদ্ধ সংক্রান্ত কোনো কোনো হাদিস বিকৃত করা হয়েছে বা বানানো হয়েছে। এইসব বিকৃত হাদিসের সঙ্গে আসলে ইয়াজিদের কোনো সম্পর্ক নেই। যেমন: মুসলমানদের মধ্যে যারা প্রথম নৌ অভিযান চালাবে তাদের বেহেশত দেয়া হবে এবং মুসলমানদের মধ্যে যারা রোমান সম্রাট সিজারের শহরে প্রথম হামলা চালাবে তাদের সব গোনাহ মাফ করা হবে বলে রাসূল (সা.)’র একটি হাদিসের কথা বলা হয়।
এইসব হাদিস যদি সত্য হয়েও থাকে তাহলেও বাস্তবতা হল সিজারের শহরে হামলাকারী প্রথম সেনাদলের মধ্যে ইয়াজিদ ছিল না বলে হাদিস থেকে প্রমাণিত হয়েছে। মুয়াবিয়ার শাসনামলে সেখানে মুসলমানদের প্রথম হামলা হয়েছিল ৪২ হিজরিতে। ৪২ থেকে ৪৯ হিজরিতে সেখানে ছয়টি অভিযান চালায় মুসলিম যোদ্ধারা। আর ইয়াজিদকে কথিত অভিযানে পাঠানো হয় ৫০ হিজরিতে এবং তা ছিল সপ্তম অভিযান। তাকে পরবর্তীতে শাস্তি হিসেবে এক যুদ্ধে পাঠানো হয়েছিল মাত্র। ইয়াজিদ মুসলিম বাহিনীকে ব্যাঙ্গ-বিদ্রূপ করেছিল বলে শাস্তি হিসেবে মুয়াবিয়া তাকে যুদ্ধে পাঠায়। অর্থাৎ যুদ্ধ করার জন্য তাকে পাঠানো হয়নি বরং শাস্তি হিসেবে সাময়িক নির্বাসনের মধ্যে সময় কাটানোর জন্য।
ইমাম বদরুদ্দিন আইনি বলেছেন:
মুয়াবিয়া ইয়াজিদকে কোনো এক অভিযানের সেনাপতি করতে চাইলে বেশিরভাগ সাহাবিরা বেঁকে বসেন এবং একজন সাহাবির (সুফিয়ান বিন আওফ) নেতৃত্বে যুদ্ধে যোগ দেন তারা। অর্থাৎ তারা এমন অযোগ্য ও অথর্ব এবং চরিত্রহীন লোকের অধীনে যুদ্ধে যেতে প্রস্তুত ছিলেন না।
বলা হয় ইতিহাসে মাত্র একবারই ইয়াজিদের যুদ্ধ যাত্রার কথা এসেছে। মুয়াবিয়া তাকে নাকি নৌ-সেনাপতিও করেছিলেন। হয়তো ইয়াজিদকে বীর হিসেবে তুলে ধরার অপকৌশলের অংশ হিসেবেই সেই উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। বিষয়টা সত্য হলে বা ইয়াজিদ যদি সত্যিই বীর হত তাকে নানা স্থল যুদ্ধেও সেনাপতি করা হত। কিন্তু ইতিহাস বা হাদিস তা বলে না। ওই ঘটনা সত্য হলে ইয়াজিদ ও তার সঙ্গীরা নানা সময়ে গর্বভরে তা অবশ্যই উল্লেখ করত এবং এই ঘটনাকে তার যোগ্যতার প্রমাণ হিসেবে অবশ্যই তুলে ধরত। তথ্য-প্রমাণে দেখা গেছে মুয়াবিয়ার যুগ থেকেই হাজার হাজার নানা মিথ্যা ও বানোয়াট হাদিস প্রচার করা হয়েছে উমাইয়াদের স্বার্থে। এ ছাড়াও এটা মনে রাখা দরকার মানুষের অতীত অবস্থার চেয়ে শেষ অবস্থাই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ সারা জীবন ভালো থাকলেও শেষ মুহূর্তে যদি ঈমান হারায় বা আল্লাহর নাফরমানি করে তাহলে তার অতীতের সব ভালো কাজও মূল্যহীন হয়ে পড়ে। ইবলিস বা শয়তান ছিল একজন ভালো জিন। সে ৬ হাজার বছর আল্লাহর ইবাদত করে ফেরেশতার সম্মান অর্জন করেছিল। বলা হয় পৃথিবীর এমন স্থান খুব কমই ছিল যেখানে শয়তান আল্লাহর উদ্দেশ্যে সিজদা করেনি। কিন্তু আদমকে সিজদা করার নির্দেশ অমান্য করে সে অভিশপ্ত শয়তানে পরিণত হয়। আল্লাহর এই নির্দেশ অমান্য করার যুক্তি হিসেবে সে বলেছিল, আদম হল মাটির তৈরি কিন্তু সে হল আগুনের তৈরি। এই অহংকার তাকে অভিশপ্ত করে দেয়। সে বুঝতে পারেনি যে আদম বা মানুষের মধ্যে রয়েছে আল্লাহর নিজ থেকে ফুকে দেয়া রুহ বা খোদায়ী আধ্যাত্মিক সত্তা।
ইয়াজিদ যদি অতীতে কোনো একটি ভালো কাজ করেও থাকে তবুও তা মূল্যহীন হয়ে গেছে তার পরবর্তী মহাপাপগুলোর কারণে। সে মুসলিম সমাজের সবচেয়ে অযোগ্য ও নিকৃষ্টতম পাপী হওয়া সত্ত্বেও জোর করে ওই সমাজের শাসক হয়েছে এবং মুসলমানদের প্রকৃত ইমাম বা নেতা ও বেহেশতি যুবকদের নেতা ইমাম হুসাইন (আ.)-কে শহীদ করে অভিশপ্ত হয়ে গেছে। সে কখনও তওবা বা অনুশোচনা করেছে বলেও প্রমাণ নেই। বরং সে ইমাম ও নবী পরিবারের অবমাননার ঘটনায় উল্লাস প্রকাশ করেছে।
ইসলামী বর্ণনায় এসেছে, কোনো এক সময় মহানবী (সা.) স্বপ্নে দেখেন যে, বনী উমাইয়্যা তাঁর মিম্বরে বানরের মত নাচানাচি করছে। এ স্বপ্ন দেখে তিনি এমনই শোকাহত হলেন যে, এরপর যতদিন বেঁচে ছিলেন তিনি আর হাসেননি। তাঁর এই স্বপ্ন দেখার পর পবিত্র কুরআনের সুরা বনি ইসরাইলের ৬০ নম্বর আয়াত নাজেল হয়েছিল। ওই আয়াতে বলা হয়েছে:
“এবং (স্মরণ কর) যখন আমরা তোমাকে বলেছিলাম যে, নিশ্চয় তোমার প্রতিপালক মানুষকে পরিবেষ্টন করে আছেন এবং আমরা তোমাকে যে স্বপ্ন দেখিয়েছিলাম তা কেবল মানুষের জন্য পরীক্ষার মাধ্যম ছিল এবং কুরআনে বর্ণিত অভিশপ্ত বৃক্ষটিও। আমরা মানুষকে ভীতি প্রদর্শন করতে থাকি, কিন্তু তা তাদের চরম ঔদ্ধত্যকেই কেবল বৃদ্ধি করে।”
তাফসিরে তাবারিসহ কয়েকটি সুন্নি সূত্রমতে, কুরআনে উল্লিখিত ওই “অভিশপ্ত বৃক্ষ” বলতে আবু সুফিয়ানের বংশধর তথা উমাইয়াদের বোঝানো হয়েছে এবং রাসূল (সা.) স্বপ্নে তাঁর মিম্বরে বানরদের নাচানাচির যে ঘটনাটি দেখেছিলেন তার অর্থ উমাইয়াদের মাধ্যমে খেলাফত দখল করা হবে। #
পার্সটুডে/এমএএইচ/এআর/১৬