মুসলমানেরা কেন ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিতে পারে না?
ফিলিস্তিনিরা যে সর্বব্যাপী জুলুম-নির্যাতনের শিকার তা জানতে ইতিহাস ঘাটতে হয় না। প্রতিদিন গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন খবরের দিকে একটু নজর দিলেই এর প্রমাণ পাওয়া যায়। ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরাইলি বর্বরতা অতীতে যেমন ছিল এখনও আছে।
এই চিত্র অন্তত ৭২ বছরের। এমন অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার শক্তি, সাহস ও সুযোগ হয়তো সবার নেই কিন্তু মানবিক বোধসম্পন্ন যেকোনো মানুষের কাছে অন্তত এটুকু প্রত্যাশা করা যায় যে, এই অপরাধে সে সমর্থন যোগাবে না। সম্প্রতি দখলদার ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন নিজেদেরকে অপরাধীদের সহযোগী হিসেবে প্রমাণ করেছে। ফিলিস্তিনিরা অন্তত তাদের আরব মুসলিম ভাইদের কাছ থেকে এমন আচরণ প্রত্যাশা করে না। ফিলিস্তিনিদের জন্য আরও দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে। সৌদি আরবও যেকোনো সময় ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়ে পূর্ণাঙ্গ সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন।
আমিরাত ও বাহরাইন হচ্ছে সৌদি আরবের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ দুই মিত্র। সৌদি সামরিক সমর্থন না থাকলে অনেক আগেই বাহরাইনে রাজতন্ত্রের পতন হতো। আরব আমিরাতের রাজপরিবারেও রয়েছে সৌদি প্রভাব। দরিদ্র মুসলিম প্রতিবেশী দেশ ইয়েমেনে চলমান আগ্রাসনে সৌদি নেতৃত্বে অংশ নিচ্ছে এই দুই দেশ। মূলত সৌদি আরবের নির্দেশেই তারা ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক করেছে। ইসরাইলি বিমান চলাচলের জন্য সৌদি আকাশসীমা ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার পর বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়েছে। বিশ্বের মুসলমানদের আবেগ-অনুভূতির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সৌদি আরব এ ক্ষেত্রে কিছুটা ধীরে এগোচ্ছে। সৌদি রাজপরিবার নিজেদেরকে পবিত্র মক্কা ও মদিনার সেবক হিসেবে দাবি করার কারণে বিশ্বের অনেক সরলমনা মুসলমান তাদের শ্রদ্ধা করেন। এ অবস্থায় মিত্র দেশগুলোর সহযোগিতায় ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের অপরাধকে ক্রমেই সহনীয় করে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে রিয়াদ।
আশঙ্কা হচ্ছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগেই সৌদি আরবের পক্ষ থেকে সম্পর্ক স্থাপনের প্রকাশ্য ঘোষণা আসতে পারে। মার্কিন রাজনীতিতে প্রবল শক্তির অধিকারী ইহুদিবাদী (জায়নিস্ট) লবিকে হাতে রাখতে সৌদি ঘোষণাকে 'ট্রাম্প কার্ড' হিসেবে ব্যবহার করতে চান ডোনাল্ড ট্রাম্প। এ কারণে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সৌদি আরব দ্রুতই ইসরাইলকে স্বীকৃতির ঘোষণা দিয়ে বসতে পারে। ট্রাম্পের চাপ খুব বেশি দিন সহ্য করার শক্তি ও সাহস সৌদি আরবের নেই। এই তিক্ত বাস্তবতা সৌদি রাজপরিবারকে বারবারই গোপনে ও প্রকাশ্যে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন ট্রাম্প। ২০১৮ সালের অক্টোবরে ট্রাম্প প্রকাশ্যেই জানান, মার্কিন সেনাবাহিনীর সমর্থন ছাড়া সৌদি রাজপরিবার দুই সপ্তাহও টিকতে পারবে না। ট্রাম্পের ঘোষণার পর প্রায় দুই বছর পার হলেও সৌদি রাজপরিবারের ক্ষমতার প্রাণভোমরা এখনও মার্কিন মুল্লুকেই রয়ে গেছে।
রাজা-বাদশারা যাই করুক, কোনো ঈমানদার মুসলমান ইসরাইলকে মেনে নিতে পারে না। যারা নিরপরাধ ও নিরস্ত্র মানুষকে নিজের ঘরবাড়ি থেকে বের করে সেখানে বসতি স্থাপন করে এবং নারী ও শিশুসহ অসহায়দের হত্যা করে, তাদেরকে স্বীকৃতি দেওয়ার অনুমতি ইসলাম ধর্মে নেই। যারা ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিচ্ছে তারা আসলে ইসলাম ধর্মের ধার ধারেন না। ঈমানদার মুসলমান কখনোই আমেরিকা বা ইউরোপকে নিজের ক্ষমতায় টিকে থাকার অবলম্বন মনে করতে পারে না। ১৯৪৮ সালে ইউরোপ ও আমেরিকা মিলে ফিলিস্তিনি মুসলমানদেরকে তাদের ভিটেমাটি থেকে তাড়িয়ে অবৈধ ও কৃত্রিম রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠা করেছে। অবৈধ অনুপ্রবেশকারী ইহুদিবাদীরা ফিলিস্তিনের আদি অধিবাসীদের সব কিছু কেড়ে নিয়েছে। পাশ্চাত্য এটা করতেই পারে, এটা তাদের চিরায়ত বৈশিষ্ট্য। তারা উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় আদি অধিবাসীদের হত্যা করে সেখানে বসতি স্থাপন করেছে। তারা রেড ইন্ডিয়ান, মায়া ও ইনকা সভ্যতা পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। আফ্রিকা মহাদেশের অনেককে দাস বানিয়েছে সাদা চামড়ার ইউরোপীয়রা। আজকের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও আফ্রিকান বংশোদ্ভূত কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে একই ধরণের আচরণ করা হচ্ছে। মুসলমানেরা এ ধরণের কাজ করতে পারে না, এ ধরনের কাজকে স্বীকৃতিও দিতে পারে না।
১৯৪৮ সালে দখলে নেওয়া ভূখণ্ডেই সীমাবদ্ধ থাকেনি ইহুদিবাদীরা। পুরো ফিলিস্তিনকেই প্রায় গ্রাস করে ফেলেছে তারা। ফিলিস্তিনের ১৯৪৭ সালের আগের মানচিত্রের সঙ্গে বর্তমান মানচিত্র মিলিয়ে দেখলেই ইসরাইলি দখলদারির চিত্র যে কেউ অনুধাবন করতে পারে। প্রতিরোধ সংগ্রামের কারণে ইসরাইলের দখলদারি এখন পর্যন্ত একটা সীমানার মধ্যে আটকে আছে, কিন্তু ফিলিস্তিনিদের এই প্রতিরোধ ব্যূহ ভেঙে গেলে এর ব্যাপ্তি বাড়তেই থাকবে। কোনো আরব রাষ্ট্র দখলদারদের হাত থেকে রেহাই পাবে না। নীল থেকে ফোরাত পর্যন্ত সাম্রাজ্য গড়ে তোলার ইহুদিবাদী পরিকল্পনার কথা হয়তো কোনো কোনো আরব দেশ ভুলে গেছে।
মুসলমানদের তৃতীয় পবিত্রতম স্থান ও প্রথম কিবলা মসজিদুল আকসা দখল করে রেখেছে ইসরাইল। এই পবিত্র মসজিদুল আকসা হয়েই মেরাজে গিয়েছিলেন মহানবী হজরত মুহাম্মাদ (স.)। ফিলিস্তিনিদের একটা অংশ ইউরোপ, আমেরিকা ও দখলদারদের নানা প্রতিশ্রুতি বিশ্বাস করে চুক্তির মাধ্যমে তাদের সঙ্গে সহাবস্থানের চেষ্টা করেছে কিন্তু কোনো প্রতিশ্রুতিই রক্ষা করা হয় নি। এখনও ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে দেওয়া হয়নি। শরণার্থীদের স্বদেশে ফেরার অধিকার মেনে নেওয়া হয়নি। গত ৭২ বছরে ফিলিস্তিনিরা জবরদখল, হত্যা-নির্যাতন ও নিপীড়ন ছাড়া আর কিছুই পায় নি। গাজার ফিলিস্তিনিদের অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। আক্ষরিক অর্থে গাজা এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় কারাগার।
তবু ফিলিস্তিনিরা থেমে নেই। জুলুম ও অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করার ইসলামি শিক্ষাকে হৃদয়ে ধারণ করে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে তারা। কয়েক দশক আগেও অস্ত্র হিসেবে পাথরই তাদের একমাত্র অবলম্বন ছিল আজ তারা ক্ষেপণাস্ত্র বানাতে জানে। এই অর্জন ফিলিস্তিনে ইসরাইলের বড় ধ্বংসযজ্ঞ ঠেকিয়ে রেখেছে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে। ইসরাইলের সঙ্গে আঁতাত, আপোষ বা সম্পর্ক গত ৭২ বছরে ফিলিস্তিনিদের কিছুই দিতে পারেনি, যতটুকু অর্জন তা সংগ্রামের মাধ্যমেই। এরপরও কেউ যদি বলে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক ফিলিস্তিনিদের স্বার্থে তাহলে তা ধাপ্পাবাজি ছাড়া আর কিছু নয়। ফিলিস্তিনিরাও কয়েকটি আরব দেশের এই ধাপ্পা বুঝতে পেরেছে। তারা আঁতাত বা সম্পর্ককারী দেশগুলোকে সমস্বরে ধিক্কার জানাচ্ছে। এ কারণে এখন তারা আগের চেয়ে অনেক বেশি ঐক্যবদ্ধ। হয়তো এই ঐক্যই ফিলিস্তিনিদের মুক্তির পথকে প্রশস্ত করে তুলবে।
দখলবাজি, হত্যা-নির্যাতন ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের এক উজ্জ্বল উপমা আজকের ফিলিস্তিনি সংগ্রামীরা। তারা এ যুগের ইমাম হোসেন। তারা নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও জালিমের বিরুদ্ধে বুক ফুলিয়ে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার সাহস রাখে। বুক পেতে দিতে পারে ঘাতকের গুলির সামনে। দুই পা হারানোর পর অন্য অঙ্গগুলোও সমর্পণ করতে পারে অবলীলায়। ঘাতক প্রাণ কেড়ে নেওয়ার পরও মুখে লেগে থাকে অকৃত্রিম হাসি। বিশাল অংকের অর্থসহ নানা লোভনীয় প্রস্তাব ছুড়ে ফেলে জালিমের চেহারা উন্মোচনে এক মুহূর্তের জন্যও পিছপা হয় না তারা। বর্তমান যুগের জালিমের চেহারা উন্মোচনে সদাসোচ্চার ফিলিস্তিনিরা। তারা হাতের কাছে যা পাচ্ছে তা দিয়েই আঘাত করে বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিচ্ছে, 'ওরা দখলদার, ওরা জালিম, ওরা রক্তপিপাসু, ওরা অমানুষ। ওদেরকে মেনে নেয়ার চেয়ে মৃত্যু শ্রেয়'। #
পার্সটুডে
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।