নভেম্বর ২২, ২০২১ ১৭:৩২ Asia/Dhaka

গত পর্বের আলোচনায় আমরা শিশুদের সামাজিক হওয়ার ক্ষেত্রে স্কুল-পূর্ব শিশু-শিক্ষা কেন্দ্রের ভূমিকার ওপর আলোকপাত করেছিলাম।

স্কুল-পূর্ব আদর্শ শিশু-শিক্ষা কেন্দ্রের জরুরি কয়েকটি বৈশিষ্ট্য সম্পর্কেও আমরা কথা বলেছিলাম। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের সাফল্য অনেকাংশেই নির্ভর করে দক্ষ ও আন্তরিক শিক্ষকদের উপস্থিতির ওপর। এইসব প্রতিষ্ঠানের একজন দক্ষ ও একনিষ্ঠ শিক্ষক শিশুদের সৃষ্টিশীলতা, আবেগ-অনুভূতির পরিশীলন, শারীরিক বিকাশ ও আচার-আচরণের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ফুল বাগানের পরিচর্যা ও বিকাশের জন্য যেমন দক্ষ মালী থাকা জরুরি তেমনি জীবন-বাগানের কচি ফুল বা ফুলের কুড়িগুলোর যত্ন নেয়ার জন্যও দক্ষ ও আন্তরিক শিক্ষকের উপস্থিতি অপরিহার্য। 

শিশুদের নানা প্রতিভা শনাক্ত করা ও তাদের বুদ্ধিমত্তার বিকাশ এবং প্রাইমারি স্কুল-পূর্ব শিশু-শিক্ষা কেন্দ্রের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ শিশুদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর এইসব চাহিদা মেটানোর জন্য সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখেন যিনি তিনি হলেন একজন দক্ষ বা আদর্শ শিক্ষক। এই শিক্ষকদের স্নেহের ছায়ায় বিকাশ ঘটে শিশুদের নানা প্রতিভার এবং সমাজ উপহার পায় সৃষ্টিশীল নতুন কুড়িদের।

শিক্ষকের অনন্য মর্যাদা তুলে ধরার জন্য এটাই যথেষ্ট যে বিশ্বনবী (সা) নিজেকে মানবজাতির জন্য সবচেয়ে বড় শিক্ষক বলে মনে করতেন এবং এ জন্য গৌরব অনুভব করতেন। শিক্ষকদের গুরুত্ব দিতেন বলেই তিনি তাঁর দোয়ায় বলতেন : হে আল্লাহ! আপনি শিক্ষকদের ক্ষমা করুন ! তাঁদেরকে দীর্ঘ জীবন দান করুন! এবং তাঁদের আয়-উপার্জন ও কাজে বরকত দান করুন।

আজ আমরা একজন উপযুক্ত শিক্ষক বা প্রশিক্ষকের নানা বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করব। ইসলামের দৃষ্টিতে একজন ভালো শিক্ষকের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হল তিনি ছাত্রদেরকে ধর্ম ও নৈতিকতার জ্ঞান দান করবেন। ছাত্রদেরকে নানা জ্ঞান দানের পাশাপাশি তাদের মধ্যে আধ্যাত্মিক চেতনা জাগিয়ে তোলাও শিক্ষকের দায়িত্ব। শহীদ-সম্রাট হযরত ইমাম হুসাইন (আ) বলেছেন: যে কেউ কোনো মানুষকে বিচ্যুতি বা গোমরাহি থেকে মুক্ত করে তাকে সত্য ও বাস্তবতাকে চেনায় এবং সেও তাতে সাড়া দিয়ে যখন সত্য ও বাস্তবতাকে গ্রহণ করে তখন সুপথ প্রদর্শনকারী ওই ব্যক্তি একজন দাসকে মুক্ত করার সমান সাওয়াব পাবে।

শিশু-কিশোরদের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক চেতনা বিকাশের অন্যতম কার্যকর পন্থা হল তাদেরকে শিক্ষণীয় ও নৈতিক মূল্যবোধের চেতনায় ভরপুর নানা কাহিনী শোনানো। এইসব কাহিনী থেকে মানুষ সাফল্য ও ব্যর্থতার রহস্যগুলো জানতে পারে। আত্মউন্নয়ন বা উন্নতির নানা কারণ জানা যায় এইসব কাহিনী শোনার মাধ্যমে। একই কারণে পবিত্র কুরআনে তুলে ধরা হয়েছে  অতীতের জাতিগুলোর শিক্ষণীয় ইতিহাস। পবিত্র কুরআন জাতিগুলোর নানা পরিণতির ওইসব কাহিনী নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করতে মানুষকে আহ্বান জানায়। জাতিগুলোর সাফল্য ও ধ্বংস হয়ে যাওয়ার মূল কারণগুলো তুলে ধরা হয়েছে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত ওইসব ঘটনা বর্ণনার শেষাংশে। ফলে ভালো ও মন্দ কাজের পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক হন পবিত্র কুরআনের পাঠক বা শ্রোতারা। তাই একজন আদর্শ শিক্ষককেও পবিত্র কুরআনের এই পদ্ধতি অনুসরণ করে শিশু-কিশোরদেরকে পছন্দনীয় আচরণ ও উন্নত চরিত্রের দিকে আকৃষ্ট করতে হবে। 

প্রাথমিক বিদ্যালয়-পূর্ব শিশু-শিক্ষা কেন্দ্রের শিক্ষিকাদের হতে হবে তার কচি ছাত্রছাত্রীদের প্রতি মায়ের মতই স্নেহশীল ও ধৈর্যশীল। স্নেহশীলতার প্রমাণ দেখাতেই তিনি তাদের সমালোচক হবেন না বা হলেও তা হবেন সর্বনিম্ন মাত্রায়। তিনি ছিদ্রান্বেষী বা বক-ঝকাকারী হবেন না, বিশেষ করে অন্য শিশুদের সামনে তিনি তার কোনো শিশু ছাত্র-ছাত্রীর ভুল-ত্রু টি তুলে ধরবেন না। তারা কখনও ভুল আচরণ করলেও তিনি শান্ত থাকবেন ও তাদেরকে সঠিক আচরণের পন্থাটি শিখিয়ে দিবেন। শিশুর ব্যক্তিত্ব বিকাশের প্রশিক্ষক ও তাদের নানা ত্রুটির সংশোধক হিসেবে তাকে হতে হবে অত্যন্ত ধৈর্যশীল ও ক্ষমাশীল। প্রাথমিক বিদ্যালয়-পূর্ব শিশু-শিক্ষা কেন্দ্রের শিক্ষক বা শিক্ষিকাকে হতে হবে সুস্থ শরীর ও মনের অধিকারী এবং সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধগুলোর প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ। একজন আদর্শ শিক্ষককে বহুমুখী প্রতিভা ও অপেক্ষাকৃত প্রখর মেধার অধিকারী হওয়া উচিত। সাধারণ ও সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তি বিষয়ক জ্ঞানে দক্ষ হওয়ার পাশাপাশি তাকে হতে হবে পেশাদার এবং ব্যক্তিক, সামাজিক ও গণযোগাযোগের ক্ষেত্রে যথেষ্ট দক্ষতার অধিকারী। ছাত্রদের সঙ্গে আচার-আচরণে তাকে হতে হবে ভারসাম্যের অধিকারী। প্রয়োজন না হলে খুব কঠোরও নয় আবার খুব নরম প্রকৃতিরও হওয়া উচিত নয়। শিশু-কিশোরদেরকে নানা বিষয় শেখানোর ক্ষেত্রে ও তাদের আচরণ সংশোধনের ক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষিকার আচরণও হতে হবে আদর্শস্থানীয়।  তাদেরকে সব সময় হাসিমুখ বা প্রসন্নতার অধিকারী  হতে হবে। নিয়ম-পদ্ধতির কাঠামো নয় সৃষ্টিশীলতা ও অনুপ্রেরণাই প্রশিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতার বন্ধনের ভিত্তি গড়ে তোলে।

ইবনে খালদুনের মতে শিক্ষক যদি কঠোর ও রুক্ষ প্রকৃতির হন ও কঠোর আচরণের মাধ্যমে  ছাত্রদের বশে রাখতে চান তাহলে ওই শিক্ষকের ছাত্ররা প্রফুল্লতা ও প্রসন্নতা হারিয়ে ফেলবে। আর শিক্ষক যদি মিথ্যাচার, প্রতারণা ও নীচ  প্রকৃতির আচরণ শেখান তাহলে তা তার শিশু-কিশোর ছাত্রছাত্রীর অভ্যাসে পরিণত হবে।

শিশুদের জন্য শিক্ষক কেবল কেবল বইয়ের বিষয়বস্তু বুঝিয়ে দেয়ার মাধ্যম নন তাদের ব্যক্তিত্বও শিশুদের আকৃষ্ট করে। তাই নৈতিক ও আচরণগত বিষয়েও তারা প্রশিক্ষক হতে পারেন বাস্তব আচার-আচরণের মাধ্যমে। শিশুরা শিক্ষকের জ্ঞান, চিন্তাধারা ও মতামতের বিশাল জগতের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে থাকে ও তারা শিক্ষকের অনুসারীও হতে চায়। শিশুরা একজন দক্ষ শিক্ষক বা শিক্ষিকার প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়। প্রশিক্ষক যাকে ভালো বলেন তা তার কাছে মূল্যবান হয়  আর যা কিছু মন্দ বলে উল্লেখ করেন সেসবই তার কাছেও মন্দ হিসেবে স্বীকৃত হয়। তাই অন্যদের সংশোধনের আগে নিজেকেও শুধরে নেয়ার মত যোগ্যতা ও সৎ সাহস প্রশিক্ষকদের থাকতে হবে।

প্রাথমিক বিদ্যালয়-পূর্ব শিশু-শিক্ষা কেন্দ্রের প্রশিক্ষকদেরকে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেয়ার মত যথেষ্ট ধৈর্যশীল ও অপ্রত্যাশিত সংকট মোকাবেলার মত দৃঢ় চিত্তের অধিকারী হতে হবে। কোনো শিশু শিক্ষার্থীর অপ্রত্যাশিত কোনো আচরণের কারণ কি তার ক্ষিদে লাগা বা অতিরিক্ত ক্লান্ত থাকা কিনা -এসব যাচাই করে তাকে শিক্ষা কার্যক্রম সাজানোর পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। শিক্ষার্থীদের অপ্রত্যাশিত আচরণের মোকাবেলায় হতাশ বা অস্থির হওয়া যাবে না। সব শিশু শিক্ষার্থীর মেধা ও বুদ্ধি একই মানের হয় না- এ কথা তাকে মনে রাখতে হবে। শিশুদের সামাজিক আচরণ শেখানোর মাধ্যম হিসেবে শিক্ষক শিক্ষিকাকে সব সময় মার্জিত আচরণের অধিকারী হতে হবে। অভিভাবকদের প্রত্যাশা ও রুচির ভিন্নতার কারণেও তাদেরকে হতে হবে ধৈর্যশীল।

প্রশিক্ষকদের হতে হবে এমন যেন শিক্ষার্থীরা তাদের বন্ধুর মত মনে করে ও তাদের প্রতি আস্থাশীল থাকে। ফলে তারা বেশি মাত্রায় ও ভালোভাবে শিখতে পারে।#

পার্সটুডে/এমএএইচ/আবুসাঈদ/২২

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ