জানুয়ারি ১০, ২০২২ ২১:৫৫ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা বিজ্ঞাপন নিয়ে আলোচনা করেছি। আমরা বলেছি গণমাধ্যমে পণ্যের বিজ্ঞাপনে পণ্যকে প্রয়োজনের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে তুলে ধরা হয়। জাগিয়ে তোলা হয় আকাঙ্ক্ষা।

আর আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তুলতে পণ্যকে অনেক বেশি আকর্ষণীয় হিসেবে দেখানো হয়। এর ফলে বিলাসদ্রব্যও হয়ে ওঠে অতিপ্রয়োজনীয়। বিজ্ঞাপনে যারা প্রভাবিত হোন তাদের কাছে তখন পুষ্টিকর খাবারের চেয়ে বিলাসদ্রব্যকে বেশি প্রয়োজনীয় বলে মনে হতে থাকে। মৌলিক চাহিদা পূরণের চেয়ে তখন তার কাছে রং ফর্সা করা ক্রিমের মতো প্রসাধন সামগ্রী কেনাটা বেশি গুরুত্ব পায়। তবে আজকের আসরে আমরা প্রযুক্তির প্রভাবে খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন নিয়ে আলোচনার চেষ্টা করব।

প্রযুক্তির প্রভাবে বদলে গেছে মানুষের নানা অভ্যাস। দৈনন্দিন জীবনাচারে যুক্ত হয়েছে নতুন অনেক কিছু। যেমন ফ্রিজ আসার পর প্রতিদিনের দরকারি মাছ-গোশত, শাক-সবজি ঐ দিনই কিনে আনার প্রয়োজনবোধ কেউ করছে না। কয়েক দিনের প্রয়োজনীয় জিনিস একসঙ্গে কিনে ফ্রিজে রেখে দিচ্ছে। অন্যদিকে যানজটের কারণে অনেকেরই আর পরিবারের সঙ্গে সকালের নাশতা করে গাড়িতে ওঠার সৌভাগ্য হয় না। তাই নাশতা সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হয়, গাড়িতে বসে অথবা অফিসে বসে খেতে হয়। অনেকে আবার অফিসের ক্যাফেটেরিয়ায় ফাস্ট ফুড খেয়ে নেন। প্রযুক্তির কল্যাণে খাদ্য সংরক্ষণ এখন অনেক সহজ হয়েছে। এক স্থান থেকে অন্য স্থানেও দ্রুত পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছে খাদ্যসামগ্রী। অন্য দেশ ও শহরের খাদ্যপণ্যও সহজেই পাওয়া যাচ্ছে মার্কেটগুলোতে। এর পাশাপাশি মানুষের ব্যস্ততা বেড়েছে। স্বামী-স্ত্রী দু'জনেরই চাকরি করেন এমন পরিবারের সংখ্যাও অনেক বেড়েছে। এ ধরণের পরিবারে খাবার রান্না করে খাওয়াটা বেশ কষ্টকর, রান্না করার যথেষ্ট সময়ই তাদের হাতে থাকে না। এর ফলে বাইরের খাবার বিশেষকরে ফাস্ট ফুডের ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে।

একই কারণে বিশ্বে টিনজাত খাবারের ব্যবহার ক্রমেই এত বেশি বাড়ছে যে, ২০২১ সালের শেষে এই বাজার সম্প্রসারিত হয়ে সেখানে বার্ষিক বিক্রির পরিমাণ ১০৫ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিভিন্ন গবেষণা ও বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার বেশিরভাগ মানুষ তাজা খাবারের চেয়ে প্যাকেট ও টিনজাত খাবারই বেশি ব্যবহার করেন। দৈনিক গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্রিটেনের বেশিরভাগ মানুষ যে পরিমাণ প্যাকেটজাত খাবার খান তা তাজা খাবারের চার গুণ। কিন্তু এই প্যাকেটজাত খাবার মানুষের স্থূলতার একটা বড় কারণ। কেক ও বিস্কুটের মতো শুকনো খাবারও প্যাকেটজাত খাবারের অন্তর্ভুক্ত। আমেরিকার নাগরিকদের মধ্যে স্থূলতার প্রবণতা ইউরোপের চেয়েও বেশি। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ইউরোপের চেয়ে আমেরিকায় স্থূল মানুষের গড় সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ। এ কারণে হার্ট বা হৃদরোগে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক মানুষ মারা যান। দেশটিতে যেসব রোগে মানুষের সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় সেগুলোর তালিকার  শীর্ষে রয়েছে হৃদরোগ। একইভাবে ২০৫০ সালের মধ্যে আমেরিকার এক তৃতীয়াংশ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করেন, রোগ এবং জীবনযাপন পদ্ধতির মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে বিশেষকরে খাদ্য ও রোগের মধ্যে সম্পর্ক অনস্বীকার্য। মানুষের দেহ ও মনে খাবারের সরাসরি প্রভাব পড়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, অ্যাজমা, অ্যালার্জি, অতিস্থূলতা ও ক্যান্সারের মতো অসুখ-বিসুখের সঙ্গে ব্যক্তির জীবনযাপন পদ্ধতি বিশেষকরে খাদ্যতালিকার সম্পর্ক খোঁজে পাওয়া গেছে। পাশ্চাত্যের উন্নত দেশগুলোতে তুলনামূলকভাবে এসব রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা বেশি ঘটছে। আর যেসব দেশের মানুষ খাবার গ্রহণের ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যকে কম অনুসরণ করে সেসব দেশে এ ধরণের মারাত্মক রোগে আক্রান্তের সংখ্যা কম। গবেষণা সংস্থা মিলকেন ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের ১০টি উন্নত দেশে অতিস্থূলতার বড় কারণ হচ্ছে প্রযুক্তির কারণে মানুষের শারীরিক তৎপরতা হ্রাস এবং খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন। বর্তমানে শহরাঞ্চলে এমন মানুষ খুব কমই পাওয়া যাবে যারা পিৎজা বা হটডগের সঙ্গে পরিচিত নন। গণমাধ্যমে ব্যাপক বিজ্ঞাপনের প্রভাবে এসব খাবার এখন সবার কাছে পরিচিতি পেয়েছে।

পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এসব ফাস্ট ফুড আধুনিক ও যান্ত্রিক জীবনের প্রতীকে পরিণত হয়েছে। উন্নত দেশগুলোতে সাধারণ মানুষের ব্যস্ততা এতটাই বেড়েছে যে, তারা বাইরের খাবারের খারাপ দিকগুলো নিয়ে ভাবারই আর সুযোগ পাচ্ছেন না। ফাস্ট ফুডের সঙ্গে আমেরিকার নামটি জড়িয়ে রয়েছে। ১৯৪৮ সালে ম্যাক ডোনাল্ড প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি হচ্ছে বিশ্বে ফাস্ট ফুডের সবচেয়ে বড় চেইন রেস্টুরেন্ট। ১২০টি দেশে তাদের শাখা রয়েছে এবং প্রতিদিন ছয় কোটি ৮০ লাখ মানুষ তাদের খাবার খায়। ম্যাক ডোনাল্ডের পর আরও অনেক চেইন রেস্টুরেন্ট প্রতিষ্ঠিত হয়েছ, তবে এগুলোর বেশির ভাগেরই যাত্রা শুরু হয়েছে আমেরিকা থেকে। এরপর তারা বিভিন্ন দেশে শাখা খুলেছে। ফাস্ট ফুড এখন অনেকেরই অতিপ্রিয় খাবার। তারা বাসায় রান্না না করে প্রতিদিন রেস্টুরেন্ট থেকে ফাস্ট ফুড কিনে খান। কারণ এসব খাবার সংগ্রহ এতটাই সহজ হয়ে গেছে যে, অর্ডার করার পর অতি স্বল্প সময়ের মধ্যে বাসায় পৌঁছে দেওয়া হয়। কারো কারো মতে, পুলিশ ও পিৎজার জন্য ফোন করলে পিৎজাই পুলিশের আগে মানুষের বাড়িতে আগে পৌঁছে যায়।

ফাস্ট ফুড এমনভাবে প্রস্তুত করা হয় যাতে ক্রেতা এর প্রতি ক্রমেই ঝুঁকে পড়ে। নানা উপাদান দিয়ে মজাদার করে প্রস্তুত করা হয় এসব খাবার। কিন্তু খাদ্যমানের  দিকে নজর দেওয়া হয় না মোটেই। এতে অস্বাস্থ্যকর ক্যালরি ব্যবহার করা হয়, বেশি মাত্রায় চর্বি ও লবণ দেওয়া হয়। এছাড়া মেশানো হয় নানা ধরণের সস। এক বেলা ফাস্ট ফুড খেলে যে পরিমাণ ক্যালরি দেহে প্রবেশ করে, তা ঘরে তৈরি এক বেলা খাবারের দেড় থেকে দ্বিগুণ। এছাড়া একবার ফাস্ট ফুড খেলে যে পরিমাণ লবণ দেহে প্রবেশ করে তা একজন মানুষের সারাদিনের চাহিদার প্রায় দ্বিগুণ। সাধারণত খাওয়ার সময় ফাস্ট ফুডকে লবণাক্ত বলে মনে হয় না কারণ এতে মেশানো হয় স্বাদ বর্ধক নানা উপাদান। এ কারণে ফাস্ট ফুড মানুষকে দ্রুত মোটা করে এবং নানা রোগে আক্রান্ত করে তোলে। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা সপ্তাহে দুই বার ফাস্ট ফুড খায় তাদের ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা থাকে দ্বিগুণ। একই সঙ্গে তাদের অতি মোটা হওয়ার আশঙ্কা অন্যদের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেশি।

ফুড ইংক নামের ডকুমেন্টারি ফিল্মে নির্মাতা 'রবার্ট কেনার' আমেরিকার খাদ্য ব্যবস্থাপনা পর্যালোচনা করেছেন। তিনি তার ফিল্মে তুলে ধরেছেন আমেরিকার খাদ্য ব্যবসাও মাফিয়াদের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। মাত্র কয়েকটি বৃহৎ কোম্পানি এই খাত নিয়ন্ত্রণ করছে। বলা হয়েছে, এসব কোম্পানি তাদের খাবারে যেসব মুরগি ও গরুর গোশত ব্যবহার করে সেগুলো অস্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় লালন-পালন করা হয়, বড় করা হয়।#

পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ১০

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ