পাশ্চাত্যে জীবন ব্যবস্থা (পর্ব-৪৫)
গত আসরে খাদ্যাভ্যাস নিয়ে খানিকটা আলোচনা করেছি। আমরা বলেছি গবেষণায় দেখা গেছে যারা সপ্তাহে দুই বার ফাস্ট ফুড় খায় তাদের ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা থাকে দ্বিগুণ। একই সঙ্গে তাদের অতি মোটা হওয়ার আশঙ্কা অন্যদের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেশি।
ফাস্টফুডের প্রতি অতি-আকর্ষণের কারণ হলো এটি তৈরিতে প্রচুর পরিমাণ ফ্যাট, চিনি, লবণ ও আজিনোমোটো নামের এক ধরণের উপাদান ব্যবহার করা হয়। এ কারণে ফাস্ট ফুড় খাওয়ার পর মাদকাসক্তির মতোই মানুষের মস্তিষ্ক এই খাবারে আসক্ত হয়ে পড়ে। অতি মাত্রায় ফাস্ট ফুড় খেলে শরীরে তৃপ্তি সৃষ্টিকারী হরমোন ডোপাইন নির্গত হয়। এর ফলে বারবার ফাস্ট ফুড় খাওয়ার প্রবণতা তৈরি হয় মানুষের মাঝে। কিন্তু নানা গবেষণায় এটা প্রমাণিত যে, ফাস্ট ফুডের মতো খাদ্য মানুষের শরীর ও মনের জন্য অনেক ক্ষতিকর। অনেক ফাস্ট ফুড় প্রস্তুতকারী রেস্টুরেন্ট টিবিএইচকিউ নামের একটি কেমিক্যাল প্রিজারভেটিভ ব্যবহার করে। আমেরিকার দ্য ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন জানিয়েছে টিবিএইচকিউ মানুষের দৃষ্টিশক্তির ব্যাঘাত ঘটায়। এছাড়া গবেষণাগারে প্রাণীদের উপর পরীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে এই উপাদান সেসব প্রাণীর লিভারের ক্ষতি করে, নিউরোটক্সিক ইফেক্ট তৈরি করে। অনেক ক্ষেত্রে মানুষের প্যারালাইসিসের জন্যও দায়ী উপাদানটি।
গবেষকরা বলছেন, টিবিএইচকিউ নামের যে কেমিক্যাল প্রিজারভেটিভ ফাস্ট ফুড়ে ব্যবহার করা হয় তা মানব দেহে প্রবেশের পর বমি ও মাথা ঘোরানো এমনকি মানুষের মৃত্যুও ঘটাতে পারে। এছাড়া ফাস্টফুডের ড্রেসিং ও সসে ডাইমিথাইলপলিসিলোক্সেন নামের একটি উপাদান ব্যবহার করে অনেক রেস্টুরেন্ট, যাতে প্রতিবার সার্ভের সময় কয়েকশ ক্যালোরি, অতিমাত্রায় অস্বাস্থ্যকর ফ্যাট ও সোডিয়াম শরীরে প্রবেশ করে। এছাড়া ফাস্টফুডের কৃত্রিম ও ক্ষতিকর উপাদান শরীরে অক্সিডাইড রেডিক্যাল ছড়িয়ে দেয়, এতে করে শরীর মোটা হয়ে যায়। এই অবস্থা ধীরে ধীরে খারাপ হয়ে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়া জাংক ফুড় খাওয়ার কারণে কোলেস্টেরল বাড়ে, যা ডায়াবেটিস ও হাইপারটেনশনে ভোগা রোগীদের জন্য ক্ষতিকর। এর ফলে রক্তনালীতে ব্লকও তৈরি হতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডকুমেন্টারি ফিল্ম নির্মাতা রবার্ট কেনারের নির্মিত ফুড় ইংক ফিল্মে সেদেশের খাদ্য উৎপাদন কারখানাগুলোর প্রসঙ্গে কথা বলার সময় ম্যাক ডোনাল্ডের প্রথম শাখাটি উদ্বোধনের সময়ে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন।
ম্যাক ডোনাল্ড চেইন রেস্টুরেন্টের পক্ষ থেকেই প্রথম দাবি করা হয় যে, কারখানায় যেভাবে ব্যাপক সংখ্যক গাড়ি একসঙ্গে ও স্বল্প সময়ে প্রস্তুত করা হয় ঠিক সেভাবে খাবারও তৈরি করা সম্ভব। এই রেস্টুরেন্টের পরিকল্পনাকারীরা এই লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য প্রথম থেকেই খাদ্য তালিকাকে হামবার্গারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেন। এরপর তারা ব্যাপক সংখ্যক হামবার্গার একই সময়ে প্রস্তুত করার কারিগরি পদ্ধতি নির্ধারণ করেন। এর ফলে তারা স্বল্প খরচে এবং স্বল্প সময়ে বেশি সংখ্যক হামবার্গার তৈরি করতে সক্ষম হন। এই প্রক্রিয়ায় তাদের মুনাফা হয় অনেক বেশি। ফুড় ইংক ডকুমেন্টারি ফিল্মে আরেকটি বিষয় তুলে ধরা হয়েছে আর তাহলো খাদ্য শিল্পে ভুট্টার গুরুত্ব। প্লাস্টিক পণ্য তৈরিতে খনিজ তেলের যে গুরুত্ব আমেরিকায় খাদ্য শিল্পে ভুট্টার গুরুত্ব প্রায় সেরকম। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৯০ শতাংশের বেশি খাদ্য পণ্যে ভুট্টা বা সয়া থেকে প্রাপ্ত উপাদান ব্যবহার করা হয়। এই দুটি শস্যের একচেটিয়া ব্যবহারের কারণ হলো খাদ্য উৎপাদনের খরচ কমিয়ে বেশি বেশি মুনাফা অর্জন।
ভুট্টা হচ্ছে উচ্চ ক্যালরিযুক্ত দানা শস্য যা দীর্ঘ দিন ধরে সংরক্ষণ করা যায়। খনিজ তেল দীর্ঘ মেয়াদে সংরক্ষণ করা গেলেও তা খাওয়া যায় না কিন্তু ভুট্টা খাওয়া যায়। বর্তমানে ভুট্টার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা মানেই যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য শিল্পের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। ভুট্টা শুধু যে মানুষের নানা খাদ্য সামগ্রী তৈরিতেই ব্যবহৃত হয় তা নয়, এটি পশুখাদ্য হিসেবেও ব্যবহার হয়। আমেরিকার খাদ্য শিল্পে ভুট্টা এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ যে, এই শস্যের বিষয়ে বিশেষ আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। ভুট্টা উৎপাদন বাড়াতে ব্যাপক ভর্তুকিও দেওয়া হয়। সাধারণ দৃষ্টিতে এ ধরণের নীতি ও প্রবণতা যৌক্তিক মনে হলেও রবার্ট কেনারের মতে এ ক্ষেত্রে বড় ধরণের সমস্যা রয়েছে। তার মতে, এ ধরণের প্রবণতা প্রকৃতিতে ভারসাম্যহীনতা তৈরি করে। গত ৫০ বছর ধরেই আমেরিকায় গরুকে ঘাসের পরিবর্তে ভুট্টা খাওয়ানো হচ্ছে যাতে এগুলো দ্রুত মোটাতাজা হয়। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, এ ধরণের গরুর গোশত বেশি স্বাস্থ্যকর।
ভুট্টা গবাদিপশু বা গরুর পরিপাকতন্ত্রের স্বাভাবিক ক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটায়। পরিপাকতন্ত্রের এমন অবস্থা এশেরিকিয়া কোলাই বা ই কোলাই ব্যাকটেরিয়ার জন্য খুবই উপযুক্ত। যেসব গবাদি গবাদিপশু কেবল ভুট্টাই খায় সেগুলোর সহজেই ই কোলাই ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আর এই ব্যাকটেরিয়া ফাস্ট ফুড়ের মাধ্যমে সহজেই মানুষের খাবারেও ছড়িয়ে পড়ে। রবার্ট কেনারের মতে, খাদ্য প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলো আমেরিকায় এতটাই প্রভাবশালী যে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে না সরকার। কয়েক বছর আগে আমেরিকায় বার্গার খেয়ে এক শিশুর মৃত্যু হয়। এই বার্গারে ই কোলাই ব্যাকটেরিয়া পাওয়া যায়। কিন্তু আমেরিকার কৃষি মন্ত্রণালয় দোষী কোম্পানির বিরুদ্ধে বড় কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি, কারখানা বন্ধ করতে পারেনি। উল্টো ঐ কোম্পানি অভিযোগকারীদের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেছিল। রবার্ট কেনারের মতে, বাক স্বাধীনতার লালনভূমি হিসেবে দাবিদার আমেরিকায় এ ধরণের ঘটনা সত্যিই বিস্ময়কর।
রবার্ট কেনারের মতে, পাশ্চাত্যের মানুষের জীবন প্রণালীতেই পরিবর্তন আনতে হবে। মানুষ এখন যান্ত্রিক হয়ে উঠেছে। সব ক্ষেত্রেই চলছে প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতে খাবার তৈরির পেছনে সময় দিতে চান না অনেকেই। এ কারণে তারা প্রক্রিয়াজাত খাবার বিশেষকরে ফাস্ট ফুড়কেই বেছে নেন। অনেকে এই খাবারেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এমনকি ক্যানে থাকা খাবার বা প্রক্রিয়াজাত খাবার ব্যস্ত মানুষের কাছে অতি প্রিয়, কারণ এগুলো অনেকটা প্রস্তুত অবস্থায় থাকে এবং সহজেই খাওয়া যায়। কিন্তু এ ধরণের খাবার মানসম্পন্ন না হলে বা তৈরি প্রক্রিয়ায় ত্রুটি থাকলে তা ডায়রিয়া, ক্যানসার ইত্যাদির মতো সমস্যা তৈরি করতে পারে। এছাড়া এখন অনেকেই খাবার খান বিলাসিতা ও বিনোদনের অংশ হিসেবে। শরীরের চাহিদা পূরণ তাদের আসল উদ্দেশ্য নয়।#
পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ১৫
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।