পাশ্চাত্যে জীবন ব্যবস্থা (পর্ব-৫০)
গত আসরে আমরা পাশ্চাত্যের ওষুধ শিল্প নিয়ে আলোচনা করেছি। আজ আমরা ওষুধ শিল্পের পাশাপাশি ওষুধের অপব্যবহার নিয়ে আলোচনার চেষ্টা করব।
জার্মান গণমাধ্যম ডয়েচ ভেলে জানিয়েছে, ২০০৮ সালে কোচরেন কোলাবরেশন গবেষণা টিম ভিটামিনের ব্যবহার সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এই গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, যারা বেটাকেরোটিন ও ভিটামিন ই গ্রহণ করেছেন তাদের মধ্যে মৃত্যুর হার তুলনামূলক বেশি। তারা আরও প্রমাণ পেয়েছেন যে, ভিটামিন সি ও সেলেনিউম খেলে তা শারীরিক সুস্থতার ওপর কোনো প্রভাবই ফেলে না। এই প্রতিবেদন তৈরির সঙ্গে জড়িত একজন হলেন ক্রিস্টিয়ান ক্লাউড। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন, পরিপূরক হিসেবে যেসব ভিটামিন গ্রহণ করা হয় তা আসলে দেহে কোনো প্রভাব রাখে না। আমি শুধু এই সতর্কবার্তা দিতে পারি যে, মানুষ যাতে এ এসবের পেছনে না দৌড়ায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে ভিটামিনের ব্যবহার এতটাই বেড়ে গেছে যে, নানা গবেষণার উদ্বেগজনক ফলাফলের পরও সেখানকার নাগরিকদেরকে তা থেকে বিরত রাখা যাচ্ছে না। আর এই প্রবণতার ফলে লাভবান হচ্ছে ওষুধ কোম্পানিগুলো। ওষুধ কোম্পানিগুলো আরও বেশি মুনাফার জন্য বিজ্ঞাপনের পেছনেও ব্যাপক অর্থ ঢালছে।
এসব কোম্পানি বাড়তি ভিটামিন খাওয়ার পক্ষে নানা উপায়ে নিবন্ধ তৈরি করছে এবং নিজেদের স্বার্থে ফলাফল প্রকাশের জন্য নানা গবেষণার ব্যবস্থাও করছে। গবেষণার ফলাফলে ভিটামিনের সামান্য উপকারিতাকেও বড় করে তুলে ধরা হচ্ছে। ওষুধ কোম্পানিগুলোর অর্থায়নে পরিচালিত গবেষণাগুলোর ফলাফল অনেকটা একই ধরণের। সেখানে বলা হয়, সারা বিশ্বেই এখন যেসব খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয় তাতে অতীতের তুলনায় ভিটামিনের মাত্রা কম থাকে। কাজেই বাড়তি ভিটামিন গ্রহণ করে ঐ ঘাটতি পূরণ করতে হবে। পরিস্থিতি এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, কেউ চাইলেও কৃত্রিম ভিটামিন গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে পারে না, নানাভাবে তার ওপর ভিটামিন চেপে বসে। যেমন এখন খাদ্য প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলোও তাদের খাদ্যপণ্যের সঙ্গে কৃত্রিম ভিটামিন মেশাচ্ছে। কৃত্রিম ভিটামিন যোগ করা হচ্ছে কোমল পানীয়তেও। শিশু খাদ্যে ভিটামিন মেশানোর প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। জার্মান গণমাধ্যম ডয়েচ ভেলের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খাদ্যপণ্যে কৃত্রিম ভিটামিন যোগ করার ফলে একদিকে খাদ্য প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলো লাভবান হচ্ছে, আর অন্যদিকে ভিটামিন উৎপাদনকারী কোম্পানির পকেটেও যাচ্ছে বিপুল অর্থ।
খাদ্যপণ্যে ভিটামিন মিশিয়ে নেসলে, কোকাকোলা ও ক্রাফটের মতো কোম্পানিগুলো বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। নেসলে কোম্পানি এই পন্থায় বছরে দুইশ' কোটি সুইস ফ্রাঙ্ক আয় করছে। হল্যান্ডের খাদ্য ও ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানি 'ডিএসএম' বছরে এই উপায়ে লাভ করে থাকে ৭০ কোটি ইউরো। এর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয় ও বাল্টিমোরের জন হপকিনস স্কুল অব মেডিসিনের পক্ষ থেকে প্রায় ৫ লাখ লোকের ওপর একটি সমীক্ষা চালানো হয়েছে। এই সমীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে, বয়স্কদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় খাদ্যের সঙ্গে পরিপূরক হিসেবে ভিটামিন খাওয়ার জন্য এতদিন ধরে যে পরামর্শ দেয়া হচ্ছিল তা সঠিক নয়। ভিটামিন শরীরের জন্য উপকার করে তার কোন পরিষ্কার প্রমাণ তারা পাননি বরং অনেক ক্ষেত্রেই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে ভিটামিন। কিন্তু ব্রিটেনের প্রতি তিনজন নাগরিকের অন্তত একজন নিয়মিত ভিটামিন ট্যাবলেট সেবন করে থাকেন।
এই গবেষণা প্রতিবেদনের উপসংহারে বলা হয়েছে, যেসব কোম্পানি ভিটামিন উৎপাদন ও বিক্রি করে তারা ভুয়া স্বাস্থ্য সমস্যার কথা উল্লেখ করে অপ্রয়োজনীয় নানা পরিপূরক ওষুধ ও ভিটামিন কেনার ব্যাপারে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে। গবেষকরা প্রায় ৫ লাখ লোকের ওপর গবেষণা চালিয়ে তিনটি পৃথক গবেষণা পত্র প্রকাশ করেন। তারা ভিটামিন ও খনিজ ট্যাবলেটের অধ্যায় শেষ বলে উপসংহার টানেন। গবেষণাপত্রে বলা হয়, গবেষণায় এমন তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে, বয়স্কদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় খাদ্যের সঙ্গে পরিপূরক হিসাবে ভিটামিন বা খনিজ ট্যাবলেট সেবনের কোন সুস্পষ্ট উপকারিতা নেই। বরং তা ক্ষতিরও কারণ হতে পারে। অতীতে পরিচালিত ২৪টি গবেষণার ফলাফল পর্যালোচনা করে আরেকটি গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, ভিটামিন গ্রহণের কোন উপকারিতা নেই এবং রোগ-প্রতিরোধ ও মৃত্যু রোধে ভিটামিন কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না। এই ২৪টি সমীক্ষায় সাড়ে ৪ লাখ লোকের উপর পরীক্ষা চালানো হয়। অপর একটি গবেষণাপত্রে বলা হয়, প্রায় ৬ হাজার বয়স্ক লোকের ওপর সমীক্ষা চালিয়ে দেখা যায়, ক্রমাগত ১২ বছর ধরে ভিটামিন সেবন করার পরও তাদের স্বাস্থ্যের ক্রমশ অবনতিই ঘটেছে।
বিজ্ঞানীরা যুক্তি দিয়ে বলছেন, পশ্চিমা বিশ্বে গড়পড়তা যে খাবার গ্রহণ করা হয় তা থেকেই শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন পাওয়া যায়। জন হপকিনস স্কুল অব মেডিসিনের এডগার মিলার বলেছেন, কেউ কেউ যুক্তি দিয়ে থাকেন বর্তমানে খাদ্যে প্রয়োজনীয় পুষ্টির ঘাটতি রয়েছে। আসলে পুষ্টির জন্য আমাদের খাদ্য গ্রহণই যথেষ্ট। আলাদা ভিটামিনের কোন প্রয়োজন নেই। যেসব কোম্পানি ভিটামিন ট্যাবলেট উৎপাদন করে তারা আমাদের চিন্তায় এই বিষয়টি ঢুকিয়ে দেয় যে, আমাদের খাদ্যে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি পাওয়া যায় না। এজন্য আমাদের পুষ্টির পরিপূরক হিসাবে এসব ভিটামিন গ্রহণ করা প্রয়োজন। এ কারণে ওষুধের বিজ্ঞাপনে প্রভাবিত না হয়ে ভালো ডাক্তারের পরামর্শে ওষুধ সেবন করতে হবে। নিজের ইচ্ছামতো ওষুধ কিনে খাওয়া উচিৎ নয়। অনেক সময় কোনো একটা ওষুধ একটানা কেউ সেবন করলে সেই ওষুধের প্রতি তার মারাত্মক আসক্তির জন্ম হয়। যেমন কেউ যদি কয়েকদিন ঘুমের ওষুধ সেবন করে তাহলে সেই ওষুধ তার মধ্যে অন্যরকম আসক্তি তৈরি করবে। আবার দীর্ঘ দিন ধরে কেউ যদি ব্যথার জন্য ওপিয়ড ওষুধ নিয়ে থাকে তার মধ্যেও আসক্তি দেখা দেবে। এতে ওষুধের মাধ্যমে উপকার নয় বরং ক্ষতি হবে।#
পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ০৫
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।