মার্চ ১০, ২০২২ ১৯:১০ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা সেমনান প্রদেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বিখ্যাত একটি শহর দমগন গিয়েছিলাম। ইউক্রেনের নভোচারীরা এই এলাকাকে মঙ্গলগ্রহের সঙ্গে ব্যাপক মিল আছে বলে অভিমত দিয়েছে। নি:সন্দেহে সভ্যতার সবচেয়ে প্রাচীন স্তরগুলো থেকে শুরু করে হেসর টিলাগুলোর অভিনতুন স্তরগুলোর মধ্যেও ইরানের কয়েক শতাব্দীর স্থাপত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং মানবজীবনাচারগুলো নিহিত রয়েছে। ভবিষ্যতে এখানকার সভ্যতা ও সংস্কৃতি যে আরও বেশি সমৃদ্ধ ও আলোকিত হবে নি:সন্দেহে।

তরিখনে জামে মসজিদ এবং দমগন জামে মসজিদও এই শহরের অপর দু'টি ঐতিহাসিক স্থাপনা। মসজিদটি এখন দমগন শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত। এর বিভিন্ন অংশ কালের বিবর্তনে ধ্বংস হয়ে গেছে। তবে কিছু কিছু অংশ পুনরায় মেরামত করা হয়েছে। জামে মসজিদের সবচেয়ে প্রাচীন অংশটি হলো ঝুলবারান্দা এবং শাবেস্তান। মসজিদের মিনারটিও দেখার মতো। যাই হোক আমরা আজ দমগন শহর ছেড়ে এই প্রদেশেরই আরেকটি ঐতিহাসিক শহর শাহরুদের দিকে যাবো। শাহরুদ শহরের কেন্দ্রিয় শহরের নামও শাহরুদ।

শাহরুদ শহরটি পুরো সেমনান প্রদেশের মধ্যে সবচেয়ে জমজমাট একটি শহর। জনসংখ্যার দিক থেকেও সবার শীর্ষে এই শাহরুদের অবস্থান। শহরটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে তের শ আশি মিটার উঁচুতে অবস্থিত। বলা হয়ে থাকে শাহরুদ শহরের প্রাথমিক কাঠামো গড়ে উঠেছিল 'শাহরুদ' নামের বৃহৎ নদীর তীরে। এই নদীর নামেই অঞ্চলটির নামকরণ করা হয়েছে "শাহরুদ"। ভৌগোলিক দিক থেকে বিশেষত্বের কারণে এবং আলবোর্জ পর্বতমালা ও বিস্তৃত মরু অঞ্চলের মাঝে অবস্থানের কারণে শাহরুদের আবহাওয়ায় রয়েছে ব্যাপক বৈচিত্র্য। স্বাভাবিকভাবেই এখানে উৎপন্ন হয় বিচিত্র কৃষিপণ্য। তাছাড়া বহু রকমের খনিজ দ্রব্যও এ অঞ্চলে পাওয়া যায়। বিশেষ করে শাহরুদ ইরানের পাথুরে কয়লার জন্য বিখ্যাত। কয়লার পাশাপাশি চক, সিসা, দস্তা এবং ডেকোরেশনের উপযোগী পাথরও প্রচুর পরিমাণে মেলে। সর্বোপরি শাহরুদকে বিরল প্রজাতির বুনো পশুর অভয়ারণ্য বলা চলে। সুন্দর আবহাওয়াময় এই এলাকার বৃহৎ অংশ সংরক্ষিত আছে।

এই শহরে প্রচুর পার্ক রয়েছে, রয়েছে সুন্দর সুন্দর অনেক উদ্যানও। শাহরুদ ব্যবসায়ীদের জন্য বা বাণিজ্য কাফেলার জন্য নিরাপদ একটি শহর হিসেবে সুপরিচিত। অন্য কথায় শাহরুদ শহরটি প্রাচীন খোরাসান, তেহরান, মাজানদারান এবং ইরানের কেন্দ্রীয় প্রদেশগুলির প্রধান সংযোগস্থল বা চৌরাস্তা বলা যেতে পারে। কাজার শাসনামলে এই শহরটি ছিল প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র। বারো শ আটত্রিশ হিজরিতে ব্রিটিশ পর্যটক ও বণিক জেমস বেলি ফ্রিজার শাহরুদকে সুবিন্যস্ত একটি শহর বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন: শাহরুদ বাজার মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সকল প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিশ্চিত করে। তার মানে এখানে সর্বপ্রকার পণ্য সামগ্রীই পাওয়া যায়। শাহরুদে ফলের বাগ-বাগিচা প্রচুর দেখতে পাওয়া যায়। কৃষিজ পণ্যের দিক থেকেও বেশ সমৃদ্ধ এই শহর। শাহরুদের আশেপাশের গ্রামগুলো বেশ জনবহুল।

বিখ্যাত পর্যটক অ্যালবার্ট হোতাম সিন্দলারও 'খারাসান" বিষয়ক তাঁর ভ্রমণ কাহিনীতে শাহরুদকে সুবিন্যস্ত একটি শহর হিসেবে উল্লেখ করেছেন। একইভাবে তিনি এই শহরের বাজার এবং বাণিজ্যিক পরিস্থিতির ক্রম উন্নতি সম্পর্কেও লিখেছেন। তাঁর ভাষায়: "এই শহরে বহু ব্যবসায়ী রয়েছে। তারা খোরাসান থেকে ফসফরাস, তামা, সিল্ক, তুলা, কোকন ইত্যাদি কিনে এনে এরোস এলাকায় বিক্রি করে। আবার খোরাসানের ব্যবসায়ীরাও এই বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত। এইসব ব্যবসায়ী লোহা, সুগার, চা, কাপড় ইত্যাদির ব্যবসাও করে। এখানকার বাগিচাগুলো সবুজ বেল্টের মতো পুরো শহরকে বৃত্তাবদ্ধ করে রেখেছে। যেদিকেই তাকিয়েছি সেদিকেই সুন্দর, পরিচ্ছন্ন ও সবুজ বাগিচা নজরে পড়তো।"

ঐতিহাসিকভাবে মূল্যবান বেশ কিছু নিদর্শন শাহরুদ শহরে রয়েছে। যেমন এখানে আছে চাখমখ নামের পাথুরে টিলা। খ্রিষ্টপূর্ব সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগেকার এই টিলাটি। খোরিয়ন আরেকটি টিলা। এই টিলার বয়সও সাত হাজার বছরের মতো। বুলভর টিলাটিও তিন হাজার বছর আগেকার। এইসব টিলা প্রমাণ করে শাহরুদ বেশ প্রাচীন একটি শহর। সুতরাং এখানকার সভ্যতা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিও বেশ প্রাচীন এবং সমৃদ্ধ। তো এখানকার টিলাগুলো এবং শাহরুদ শহরের উচ্চতায় গবেষণা চালিয়ে যেসব নিদর্শন পাওয়া গেছে সেসব থেকে প্রমাণিত হয় প্রাচীন ইতিহাস সৃষ্টিতে এইসব টিলার ব্যাপক অবদান ছিল। এখানকার ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো একন শাহরুদ শহরের যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। যাদুঘরটি একবার ঘুরে ফিরে দেখলে কেমন হয়।

শাহরুদ শহরের যাদুঘরের কথা। শাহরুদ যাদুঘর নামেই পরিচিত এটি। শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত। প্রাথমিক পর্যায়ে এই ভবনটিকে মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের জন্য দোতলা বিশিষ্ট একটি ভবন হিসেবে নির্মাণ করা হয়েছিল। সে সময় এর ফাউন্ডেশন ছিল চার শ আটষট্টি বর্গমিটার জায়গার ওপর। কাজার শাসনামলের শেষ দিককার স্থাপত্যশৈলীর আদলে তৈরি করা হয়েছিল ভবনটি। উনিশ শ আটাশি খ্রিষ্টাব্দে ওই ভবনটি মেরামত করা হয় এবং সেমনান প্রদেশের প্রথম যাদুঘর হিসেবে কার্যক্রমের সূচনা করা হয়। প্রধানত দুটি বিভাগ রয়েছে এই যাদুঘরে। একটি পুরাতত্ত্ব বিভাগ অপরটি নৃতত্ত্ব বিভাগ। পুরাতত্ত্ব বিভাগটি রয়েছে প্রথম তলায়। এই বিভাগে  শাহরুদের ঐতিহাসিক টিলাগুলোর হাজার হাজার বছর আগেকার নিদর্শনাবলি স্থান পেয়েছে। সেইসাথে ইসলামি যুগের নিদর্শনগুলোও রাখা হয়েছে এই বিভাগে।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/ ১০

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।