ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ: 'ইউরোপ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, বড় রকমের লাভ হবে আমেরিকার'
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ কোন্ পথে। দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। চলছে যুদ্ধ। জ্বলছে ইউক্রেন। পাল্টাপাল্টি অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। রাশিয়া অগ্রসর হচ্ছে কিয়েভের দিকে। যুদ্ধ সাইরেন বাজছে। লাখ লাখ মানুষ ইউক্রেন ছাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে আসবে না বলে জানিয়েছেন বাইডেন। বিশ্বের দৃষ্টি এখন ইউক্রেন যুদ্ধের দিকে। এ বিষয়ে রেডিও তেহরানকে দুই পর্বে বিশেষ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট রাজনৈতিক ভাষ্যকার ও জনপ্রিয় সাময়িকী 'সাপ্তাহিক' এর সম্পাদক জনাব গোলাম মোর্তোজা।
বিশিষ্ট এই সাংবাদিক বলেছেন, ইউক্রেন ধ্বংস হয়ে যাবে। বিভক্ত হয়ে যাবে। লাখ লাখ মানুষ শরণার্থী হবে। এর কোনো সমাধান হবে না। এসব বিষয়কে পুঁজি করে আমেরিকা ইউরোপ রাজনীতি করবে।
গোলাম মোর্তোজা বলেন, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা নেই। তবে ইউক্রেন সংকট সমাধানের জন্য যথাযথ কূটনৈতিক উদ্যোগ নেয় নি আমেরিকা এবং ইউরোপ। আমেরিকার উদ্দেশ্য যুদ্ধপরিস্থিতি তৈরি করে ফায়দা লোটা।
পুরো সাক্ষাৎকারটি উপস্থাপন করা হলো। এটি গ্রহণ, উপস্থাপনা ও প্রযোজনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।
রেডিও তেহরান: রাশিয়া কিয়েভ দখলের জন্য অনকটা কাছাকাছি চলে গেছে। চলছে তুমুল যুদ্ধ। ইউক্রেনের সেনারাও দেশ রক্ষায় যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। তবে আমেরিকা ও ইউরোপের পক্ষ থেকে সেভাবে ইউক্রেনকে রক্ষায় এগিয়ে আসেনি। তারা নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে। তো যদি এভাবে যুদ্ধ চলতে থাকে তাহলে ইউক্রেনের পরিণতি কি হবে?
গোলাম মোর্তোজা: দেখুন, আমি আগেই বলেছি প্রথম পর্বের আলোচনায় ইউক্রেনের সাধারণ মানুষের হাতে ইউক্রেনের সরকার এবং রাশিয়ার পক্ষ থেকে অস্ত্র তুলে দেয়া হয়েছে। আর এই অস্ত্র যাদের কাছে থাকবে তারা ছোটো ছোটো দলে দলে গোত্রে গোত্রে ভাগ হয়ে যাবে। একটা সময় পর্যন্ত তারা যুদ্ধ করবে। অর্থাৎ ইউক্রেন দেশটি প্রায় ধ্বংস হয়ে গেল। এরফলে ইউক্রেন আর কখনও দাঁড়াতে পারবে না। কয়েক লক্ষ ইউক্রেনিয় পোল্যান্ড, রোমানিয়া বা কাছাকাছি অন্যান্য দেশে শরণার্থী হয়ে থাকবে। ইউরোপ বা আমেরিকা এই শরণার্থীদের নিয়ে রাজনীতি করবে। কিন্তু তাঁদেরকে আবার ইউক্রেনে ফিরিয়ে নেয়ার কার্যকর কোনো উদ্যোগ তারা নেবে না। অর্থাৎ আমেরিকা ইউক্রেনকে ন্যাটো জোটে নিতে পারল না অথবা আসলে নিতে চায় নি। আসলে আজকের যে পরিস্থিতি এরকমই একটা অবস্থা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তৈরি করতে চেয়েছে। আর সেটি তৈরি করার জন্য রাশিয়ার পাশে ইউক্রেন নামক দেশটিতে একটি গৃহযুদ্ধ লাগিয়ে রাখতে পারল। আর এটা নিয়ে হয়তো ইউক্রেন কয়েক খণ্ড হয়ে যাবে। আর রাশিয়ার পাশে ইউক্রেন অশান্ত থাকলে রাশিয়াও শান্তিতে থাকতে পারবে না। তার একধরনের মাথাব্যথা থাকবে। হয়তো তার পক্ষে থাকবে পরিস্থিতি তারপরও মাথা ব্যথা থাকবে। কারণ তার পক্ষের গ্রুপের কাছে থাকবে অস্ত্র; তার বিপক্ষের গ্রুপের কাছেও অস্ত্র থাকবে!
রেডিও তেহরান: আপনি বললেন সবপক্ষের কাছে অস্ত্র থাকবে। আর এমন অবস্থা হলে সব মিলিয়ে অবস্থাটা কি হবে!
গোলাম মোর্তোজা: যে-কথা বলছিলাম, সব মিলিয়ে একটা অস্থিতিশীলতা তৈরি করে রাখা হলো। যেভাবে সিরিয়া, লিবিয়া, ইরাকে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে। যেভাবে ফিলিসিন্তসহ এ অঞ্চলকে অশান্ত করে রাখা হয়েছে। যেভাবে ইরানের উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে ইরানের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। একইভাবে ইউক্রেনে সমস্যা তৈরি করে এই যে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হচ্ছে রাশিয়ার ওপর তার কারণ হচ্ছে রাশিয়া যে আবার সুপার পাওয়ার হয়ে উঠছিল সেখানে আঘাত করা। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর আমেরিকার একক আধিপত্যে পৃথিবী চলছিল একরকম। সেখানে রাশিয়া আবার এসে প্রমাণ করছে আমেরিকার একক আধিপত্য চলবে না। আমাকে শেয়ার দিয়ে চলতে হবে। সেই জায়গাটি ধ্বং করার জন্য মার্কিন কৌশল এটি। কারণ যেহেতু যুদ্ধ করে রাশিয়াকে ধ্বংস করা সম্ভব না। রাশিয়া বিশাল পারমাণবিক শক্তির অধিকারী। সে কারণে অর্থনৈতিক অবরোধ দিয়ে পর্যায়ক্রমে রাশিয়াকে দুর্বল করতে চায়। রাশিয়ার ভেতরে এমন একটা অবস্থা তৈরি করতে চায় যাতে পুতিনবিরোধী মনোভাব গড়ে ওঠে। অর্থাৎ অর্থনৈতিক অবরোধ দিলে তার দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হবে। জিনিষপত্রের দাম বাড়বে, মানুষ বেকার হয়ে পড়বে। অর্থাৎ পুতিনের যে একচ্ছত্র অবস্থাটা বিরাজ করছে এখন রাশিয়াতে সেই অবস্থাটা আর থাকবে না।
রেডিও তেহরান: জ্বি জনাব গোলাম মোর্তোজা, এখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল উদ্দেশ্য তাহলে কি বলে আপনি মনে করেন? আসলে লাভবান হবে কে?
গোলাম মোর্তোজা: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমেরিকা থেকে যদি পুতিনকে সরানো যায় এবং সেখানে যদি গর্ভাচভের মতো কাউকে আনা যায় তাহলে পৃথিবীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে একক আধিপত্য সেটা প্রতিষ্ঠা করা সহজ হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেরকম একটা পলিসিতে গেছে। আর তাতে সফল হওয়ার জন্যই আমেরিকা ইউক্রেনের মতো একটি দেশকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। রাশিয়ার উপর থেকে ইউরোপের নির্ভরশীলতা কমানো হচ্ছে। এতে ইউরোপও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিশেষ করে জার্মান ও ফ্রান্স ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বড়রকমের লাভবান হবে আমেরিকা।
রেডিও তেহরান: জনাব মোর্তজা, আচ্ছা আপনি রাশিয়ার পক্ষ থেকে ইউক্রেনে হামলা চালানোর বিষয়টিকে আগ্রাসন বললেন এবং গ্রহণযোগ্য নয় বলেও জানালেন। তো আজ যেমন রাশিয়া তার পক্ষ থেকে ন্যাটো সদস্যভুক্তি প্রসঙ্গে ইউক্রেনের ওপর হামলা চালিয়েছে বলে বলছে ঠিক একইভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও কিন্তু এ ধরনের আগ্রাসন আফগানিস্তান, সিরিয়া ও ইরাকে চালিয়েছিল। তারপর বলা চলে শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়ে ফিরে গেছে এবং মার্কিন জনগণও আর যুদ্ধ চায় না। আর সে কারণে যুক্তরাষ্ট্র এখানে যুদ্ধে সরাসরি জড়াবে না কারণ পুরনো পরাজয়ের একটা ভয় তাদের আছে.. এ প্রশ্নও উঠছে কি বলবেন আপনি?
গোলাম মোর্তোজা: দেখুন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান অর্থনীতিতে এরকম একটি যুদ্ধ করা সম্ভব না। আমেরিকার অর্থনীতি সেটাকে পারমিট করে না। তার যুদ্ধে না আসার এটা একটা কারণ। দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, যেহেতু রাশিয়া পারমাণবিক শক্তিধর একটি দেশ এবং তা আমেরিকার চেয়ে এগিয়ে থাকা ছাড়া পিছিয়ে নেই। ফলে এই পারমাণবিক যুদ্ধ আমেরিকা করতে আসবে না। কোনোভাবেই তারা যুদ্ধ করতে রাজি হবে না। আর ইউরোপ কখনওই যুদ্ধ করতে রাজি হবে না, ফলে আমেরিকার যুদ্ধে না আসার এটাও একটা বড় কারণ। আর পারমাণবিক অস্ত্রের কারণে তো সেই যুদ্ধ হবে না।
রেডিও তেহরান: জনাব গোলাম মোর্তজা এ পর্যন্ত বিশ্বের সুপার পাওয়ারগুলো যেখানে যেখানে আগ্রাসন চালিয়েছে; তারা কি কোথাও বিজয়ী হয়েছে?
গোলাম মোর্তোজা: দেখুন, সুপার পাওয়াররা পৃথিবীর যেসব জায়গায় আগ্রাসন চালিয়েছে সেসব জায়গার কোথাও কিন্তু তারা বিজয়ী হতে পারে নি। সোভিয়েত ইউনিয়েনের সেই শক্তিশালী সাম্রাজ্য থাকা অবস্থায় তারা আফগানিস্তানে হামলা চালিয়ে পরাজিত হয়ে ফিরে জেতে হয়েছিল। আমেরিকা আফিগানিস্তানে হামলা চালিয়ে অবশেষে পরাজিত হয়ে ফিরে গেছে। এর বাইরে সিরিয়া, লিবিয়া কিংবা ইরাক যে দেশের কথাই বলি না কেন কোথাও তারা সফল হয় নি। সব জায়গায় তারা পরাজিত হয়েছে। আর এসব অভিজ্ঞতা থেকে তারা বুঝতে পারছে যে যুদ্ধ করে কোনো সমাধানে পৌঁছানো যায় না। আর সেই জায়গা থেকে আমেরিকার এখনকার পলিসি হচ্ছে-তার যুদ্ধকৌশল প্রয়োগ করে সে অন্যদের যুদ্ধে ব্যস্ত রাখবে কিন্তু নিজে যুদ্ধে জড়াবে না।
রেডিও তেহরান: জনাব গোলাম মোর্তজা, অনেকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বা এমন কিছু মন্তব্য করছেন। আপনার কি মনে হয় তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে যেতে পারে এ ঘটনা থেকে..
গোলাম মোর্তোজা: আমার কাছে সেরকম সম্ভাবনার কথা মনে হয় না। কারণ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে যদি যায় তাহলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। আর পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দেশগুলো একদিকে যেমন পৃথিবীকে ধ্বংস করবে অন্যদিকে তারা নিজেরাও ধ্বংস হবে। আর সে কারণে তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধের দিকে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে বলে আমি অন্তত মনে করি না।
রেডিও তেহরান: সবশেষে জানতে চাইব জনাব গোলাম মোর্তজা, আপনার কি মনে হয় এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে কূটনীতি তার নিজস্ব পথ হারিয়েছে?
গোলাম মোর্তোজা: কূটনীতির পথ হারিয়েছে সেটা বলব না। এখানে সুপার পাওয়ারগুলোর বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে উদ্দেশ্য সেই উদ্দেশ্যের জায়গায় যদি পরিবর্তন আনে তারা তাহলে কূটনীতির পথ ঠিকই খুঁজে পাবে। যেহেতু উদ্দেশ্যের জায়গায় সমস্যা আছে সে কারণে কূটনীতি পথ হারায় নি আসলে কূটনৈতিকভাবে চেষ্টাই করা হয় নি। যদি কূটনৈতিকভাবে ইউক্রেনকে ন্যাটো সদস্য করার চিন্তার সাথে সাথেই কিংবা আগেই রাশিয়ার সঙ্গে বসত। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করত। ইউক্রেন ইউরোপের সঙ্গে আলোচনা করে নিতে ন্যাটো ইস্যুতে কি ধরনের বিপদ আসতে পারে এবং তার মোকাবেলা কিভাবে করা হবে। এইসব কূটনৈতিক পথে তো যাওয়া হয় নি। যেহেতু সেই পথেই যাওয়া হয় নি। আসলে সমস্যা সমাধানের দিকে যাওয়া হয় নি। যাদের হাতে ক্ষমতা তারাই কিন্তু সমস্যাটা তৈরি হয়েছে।
রেডিও তেহরান: তো জনাব গোলাম মোর্তোজা বিশ্বের সর্ব সাম্প্রতিক যে যুদ্ধ রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ। সেই যুদ্ধ নিয়ে নিয়ে দুই পর্বে সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্য আপনাকে আবারও অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
গোলাম মোর্তোজা: আপনাকেও ধন্যবাদ।#
পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/১৪