অল্প একদল মানুষের গোনাহর জন্য গোটা সমাজকেও বিপর্যস্ত হতে হয়
রমজান: আত্মশুদ্ধির মহোৎসব (পর্ব-৭)
রমজান এলে যায় গো চলে /সব ভেদাভেদ দ্বন্দ্ব পুণ্য আর ত্যাগের অপার মহিমায় /পাপের দুয়ার হয় বন্ধ। (আবদুল হাকিম)
পাপ বর্জন রমজানের সবচেয়ে বড় উপহার। আর এ জন্য দরকার আত্মসংশোধন। আর আত্মসংশোধনের ভিত্তি হল পাপ ও পুণ্যের উৎস আর পথ-ঘাটগুলো সম্পর্কে ব্যাপক ধারণা রাখা। অন্যকে বা সমাজকে সংশোধনের আগে প্রত্যেক মানুষকে আত্মসংস্কারে সফল হতে হবে। আমরা জানি যে মহান নবী রাসুলগণ ও মহানবীর পবিত্র আহলে বাইতের সদস্যরা নিষ্পাপ ছিলেন। যদি তাঁরাও পাপী হতেন তাহলে তাঁদের কথায় কেউই কান দিত না। রমজানের রোজা বৈধ বিষয়েও সংযম চর্চার মাধ্যমে আমাদেরকে পাপ থেকে দূরে থাকার শিক্ষা দেয়। অন্যদিকে আমরা যদি সংযমের বাস্তব চর্চা না করে অন্যদের সংযমী হতে বলি তাতেও কোনো সুফল আসবে না।
মহান আল্লাহর অশেষ রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের মাস পবিত্র রমজান। মহান আল্লাহর নানা অনুগ্রহ, পথ-নির্দেশনা, নানা কাজে সাহায্য, নৈকট্য ও বিশেষ জ্ঞান, জীবনের নানা ক্ষেত্রে বিজয়-এসবের পথে বাধা হয়ে দাড়ায় আমাদের নানা গোনাহ।
এই বাধার পর্দাগুলো কেবল তওবার মাধ্যমেই দূর করা সম্ভব। ব্যক্তি ও সমাজের জন্য ইহকালীন ও পরকালীন নানা কল্যাণের বন্ধ-হয়ে-যাওয়া দরজাগুলো আবারও খুলতে হলে আন্তরিক চিত্তে তওবা করা জরুরি। পাপ মানুষকে পশুর পর্যায়ে ও এমনকি পশুর চেয়েও নিচু পর্যায়ে নামিয়ে দেয়। গোনাহর উৎসগুলো হল: দুনিয়া-পূজা বা লোভ-লালসা, উদাসীনতা, কৃপণতা, অলসতা, অজ্ঞতা ইত্যাদি।
অল্প একদল মানুষের গোনাহর জন্য গোটা সমাজকেও বিপর্যস্ত হতে হয়। যেমন, আমরা দেখি যে ওহোদ যুদ্ধের সময় মহানবীর (সা) নেতৃত্বাধীন সে সময়কার ইসলামী সমাজও একদল সাহাবির গোনাহর কারণে সামষ্টিকভাবে মারাত্মক ক্ষতি ও বিপর্যয়ের শিকার হয়েছিল। তিরন্দাজ ওই সাহাবিরা রাসুলে পাকের নির্দেশ অমান্য করে একটি বিশেষ গিরি-খাদের প্রহরা দেয়া থেকে সরে এসেছিলেন। গনিমতের লোভেই তারা এটা করেছিলেন। অথচ তাদেরকে বলা হয়েছিল যে যুদ্ধে জিতে গেলেও যেন তারা কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ ওই স্থানের প্রহরা ত্যাগ না করেন। তিরন্দাজ ওই সাহাবিরা মহানবীর পক্ষ থেকে বিশেষভাবে তাগিদ দেয়া নির্দেশ পালনে অবহেলা করায় পেছন থেকে একদল শত্রু মুসলমানদের ওপর হামলা চালিয়ে তাদের নিশ্চিত বিজয়কে ভয়াবহ বিপর্যয় ও পরাজয়ে পরিণত করে। অনেক মুসলমান হামলার তীব্রতার মুখে মহানবীকে ত্যাগ করে পালিয়ে যান এবং অনেকেই বীরর মত লড়াই করে শহীদ হন। বিষয়টি বস্তুগত ও মানসিক দিক থেকে মুসলমানদের তীব্র বিপর্যস্ত ও তাদের একদলকে হতাশ করেছিল যে মহান আল্লাহ এ বিষয়ে সুরা আলে ইমরানে অন্তত দশটি আয়াত নাজিল করেন যাতে মুসলমানরা এ বিষয়ের সঠিক ব্যাখ্যা, দিক-নির্দেশনা ও সান্ত্বনা পেতে পারেন।

কুরআনের আয়াতে আল্লাহ বলেন যে, তোমাদের যে দুটি দল লড়াইয়ের দিনে শত্রুদের পিঠ দেখিয়ে পালিয়েছিল শয়তান তাদেরকে বিভ্রান্ত করেছিল, তাদেরই পাপের দরুন। -অর্থাৎ তাদের কেউ কেউ আগেই পাপের কারণে দুর্বল হয়ে পড়েছিল, আর সেইসব পাপের প্রভাবই তাদেরকে জিহাদের সময় চূড়ান্তভাবে বিভ্রান্ত করে। একইভাবে মানুষের পাপ তাদেরকে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও বিভ্রান্ত করে। যুগে যুগে অন্য নবী-রাসুলদের সময়েও এ ধরনের সংকট সৃষ্টি হয়েছিল। মহান আল্লাহ তাদের সম্পর্কে বলছেন: 'আর বহু নবী ছিলেন, যাঁদের সঙ্গী-সাথীরা তাঁদের অনুবর্তী হয়ে জেহাদ করেছে; আল্লাহর পথে-তাদের কিছু কষ্ট হয়েছে বটে, কিন্তু আল্লাহর রাহে তারা হেরেও যায়নি, ক্লান্তও হয়নি এবং দমেও যায়নি। আর যারা ধৈর্য ধরে, আল্লাহ তাদেরকে ভালবাসেন।
তারা আর কিছুই বলেনি-শুধু বলেছে, হে আমাদের পালনকর্তা! মোচন করে দাও আমাদের পাপ এবং যা কিছু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে আমাদের কাজে। আর আমাদেরকে দৃঢ় রাখ এবং কাফেরদের উপর আমাদেরকে সাহায্য কর।' মোটকথা মুসলমানদের নানা সংকট তাদের পাপেরই ফসল। আর পাপের আধ্যাত্মিক বা আত্মিক, বৈষয়িক ও পারলৌকিক ক্ষতি-পুষিয়ে নেয়ার উপায় হল আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা তথা তওবা।
পাপ করা হচ্ছে নিজের শরীরে অবাধে রোগের জীবাণু ঢোকার সুযোগ করে দেয়ার সমতুল্য। ফলে পাপী রোগীর মতই অনিবার্য ক্ষতির শিকার হয়। ক্ষতির মাত্রা বা প্রভাব কমানোর জন্য আল্লাহর দরবারে তীব্র অনুশোচনা করতে হবে। যখন বান্দাহ ক্ষমা চেয়ে আল্লাহর দিকে ফিরে আসে তখন তার ক্ষতি কমে আসে ও অনেকটাই ক্ষতি-পূরণ করা হয়। তাই তওবা ক্ষতি-পূরণের এক বড় সুযোগ। মহানবীর এক হাদিসে বলা হয়েছে: আল্লাহ সব পাপীকেই ক্ষমা করেন কেবল তাকে ছাড়া যে নিজেই ক্ষমা চায় না।
মানুষ যত গোনাহই করুন না কেন- আল্লাহ'র ক্ষমার ব্যাপারে নিরাশ হওয়া একটি মস্ত বড় পাপ। বলা হয় মহান আল্লাহ সব গোনাহ ক্ষমা করলেও শির্কের গোনাহ সহজেই ক্ষমা করেন না, কিন্তু তওবা করলে শির্কের পাপও ক্ষমা করেন।
অর্থসহ সপ্তম রমজানের দোয়া

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/৯
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।