এপ্রিল ২৪, ২০২২ ১৬:০৬ Asia/Dhaka

এসেছে যখন মম প্রান্তরে পবিত্র মাহে রমজান, /শুনব না আমি আর পাপ পথের আহবান। টুটে যাক মোর পাপরাশি পেয়ে সংযমের হাওয়া, /একটি মাসের সাধনায় হতেম যদি অলি আওলিয়া!/ শবে ক্বদরের রাতে সেটাই হোক মোর পাওয়া! (ফাতেমা জাহান)

গত কয়েক পর্বে আমরা শবে ক্বদর তথা লাইলাতুল ক্বদর বা ক্বদরের রাতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য নিয়ে কথা বলেছি। আজও এ প্রসঙ্গে আরও কিছু তথ্য তুলে ধরব। একটি বর্ণনায় এসেছে যে, মহানবীকে (সা.) যখন সংবাদ দেয়া হলো, বনি ইসরাইলের জনৈক ব্যক্তি আল্লাহর পথে জিহাদ করতে এক হাজার মাস নিজের কাঁধে অস্ত্র বহন করেছেন এবং তিনি কাঁধ থেকে অস্ত্র নিচে নামিয়ে আনেননি! তখন মহানবী(সা.) অবাক হয়ে এই  আকাঙ্ক্ষা করলেন যে,  এমন ব্যক্তি যদি আমার  উম্মতের মধ্যে থাকতো ! তারপর তিনি বললেন: হে আমার রব! আপনি আমার উম্মাহকে সবচেয়ে অল্প আয়ু দান করেছেন,  যার ফলে অন্য নবীগণের উম্মাহর তুলনায় তাদের নেক আমল হ্রাস পাবে। আর এ সময়ে মহান প্রতিপালক মহানবীকে (সাঃ) এই সম্মানজনক লাইলাতুল ক্বদর উপহার দিয়ে বললেন, "লাইলাতুল ক্বদর হাজার মাস থেকে উত্তম" আল্লাহর পথে বনি ইসরাইলের জনৈক ব্যক্তির এক হাজার মাস অস্ত্র বহন থেকেও তা শ্রেয়। তাই এই রাতটি কিয়ামত পর্যন্ত আপনার উম্মতের জন্য প্রতিটি মাহে রমজানের মধ্যে  অবস্থান করবে।  লাইলাতুল ক্বদর” মহানবীর (সা.) উম্মতের জন্যেই বিশেষ একটি উপহার অতীতের উম্মতগণ এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিলেন। 

শবে ক্বদরের রাতে আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত নিজের মনের মধ্যে, সিদ্ধান্তে ও সত্তায়  মৌলিক পরিবর্তন আনা তাই নিজের নাফসকে  নিজের বুদ্ধি ও বিবেকের বিচারের সম্মুখীন করে অতীতের সকল বিচ্যুতি, নৈতিক পদস্খলন ও মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়সমূহের কথা স্মরণ করে অনুতপ্ত হওয়া উচিত আর এই অনুশোচনার সাথে সাথে সমস্ত ভুলভ্রান্তির চিত্রগুলো কল্পনায় নিয়ে একান্ত নিষ্ঠার সাথে প্রভুর দরবারে হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়ে আশ্রয় প্রার্থনা করতে হবে মহান প্রতিপালক যাতে এই মহিমান্বিত রজনীতে আমাদের সমস্ত অপকর্ম ও অপরাধ ক্ষমা করে দেন, সেজন্য অত্যন্ত মিনতির সাথে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে ক্ষমা চাইতে হবে আর ক্ষমা প্রার্থনার পাশাপাশি নিশ্চিত ভাবে মনে বিশ্বাস রাখতে হবে যে, করুণাময় প্রভু তার সমস্ত অপরাধ ক্ষমা করে দিয়েছেন এভাবে ক্ষমা প্রাপ্ত হয়ে মহান প্রতিপালকের দরবারে শপথ করতে হবে যে, আর কখনো পূর্বের অপরাধে লিপ্ত হবো না এভাবে একজন নিষ্ঠাবান বান্দা আত্মিক অনুশোচনা ও ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমে,  বিশুদ্ধ  হয়ে  নতুন আরেকটি কলুষমুক্ত ও আলোকিত জীবন শুরু করে ।

প্রশ্ন হল লাইলাতুল ক্বদর কি প্রতিবছর সংঘটিত হয় ? সুরা ক্বদরের বক্তব্যে উল্লেখিত ফেরেশতাগণ ক্বদরের রাতে কোথায় বা কার কাছে অবতরণ করেন?

শবে ক্বদরে হযরত জিবরাইল (আঃ)-সহ আরো অনেক ফেরেশতা আল্লাহর নির্দেশে পৃথিবীতে আগমন করেন ফেরেশতারা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে সৃষ্টি জগতের প্রত্যেক অস্তিত্বের জন্য  রহমত, বরকত, ও মাগফিরাতের বিশেষ  বরাদ্দ নিয়ে আসমান থেকে  অবতরণ করেন ফেরেশতাদের  অবতরণ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে যে আরবি শব্দটি বা ক্রিয়াপদ " تنزّل" ব্যবহার করা হয়েছে তার অর্থই নির্দেশ করে যে, তাঁদের অবতরণ ভবিষ্যতেও  অব্যাহত থাকবে। তাঁরা কেবল একবারই ঊর্ধ্বগগন থেকে নেমে আসবেন আর একবারই আসমানে ফিরে যাবেন এমনটি উক্ত আয়াতে বোঝানো হয়নি। বরং শবে ক্বদরের রাতের শুরু  থেকে ফজরের সময় পর্যন্ত তাঁরা দলে দলে অবিরাম উঠানামা করতে থাকেন। তাই এ রাতের পরিবেশটি একটি স্বর্গীয় পরিবেশ  যা চরম  আধ্যাত্মিকতায় পরিপূর্ণ। আর এই মুহূর্তগুলোতে বিশ্বজগত পালনকর্তার বিশেষ অনুগ্রহ, দয়া ও মহিমার সুবাসে বিমোহিত হয়ে  ওঠে ।  

হযরত ইবনে আব্বাস (রহঃ) বর্ণনা করেছেন যে, মহানবী (সাঃ) বলেছেন: যখন শবে ক্বদরের মহিমান্বিত রাত উপস্থিত হয়, তখন ফেরেশতারা- যাঁদের মধ্যে হযরত জিব্রাইলও (আ.)আছেন- তাঁরা স ডানা মেলে "সিদরাতুল মুন্তাহা"র কাছে উপস্থিত হন অতঃপর হযরত জিব্রাইল (আ.) বেশকিছু পতাকা সাথে নিয়ে আসেন যার মধ্য থেকে একটি আমার (মহানবীর সাঃ) গৃহের উপরে, আরেকটি পতাকা বাইতুল মুকাদ্দাসে, আরেকটি ক্বাবা শরীফে, আরেকটি পতাকা সীনা পাহাড়ের উপর  লাগিয়ে দেন এরপর হযরত জিব্রাইল (আ.) পৃথিবীর এমন কোন মুমিন ও মুমেনা অবশিষ্ট থাকে না যাদেরকে তিনি সালাম করেন না কেবল মদ্যপায়ীদের মতো অপরাধীরা  ছাড়া ..   [তাফসিরুল মিযান, আল্লামা তাবাতাবাঈ, ২০তম খণ্ড ৪৭৫ নম্বর পৃষ্ঠা] আরো একটি রেওয়ায়েতে হযরত আবুজার গিফারি (রহঃ) বর্ণনা করেছেন যে,  যখন  তিনি মহানবীকে (স.) জিজ্ঞাসা করেন: হে রাসুলুল্লাহ যতদিন নবীগণ থাকবেন ততদিন শবে ক্বদর থাকবে আর যখন পরলোক গমন করবেন তখন কি শাবে ক্বদর উঠিয়ে নেয়া  হবে ? না-কি  কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে? মহানবী (সা)  বললেন: না- শবে ক্বদর কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।

অতএব প্রতিবছর শবে ক্বদরের রাতে ফেরেশতারা দলে দলে পৃথিবীতে অবতরণ করেন। মহান আল্লাহর রব্বুল আলামীন , নবী, রাসুল ও ইমামগণকে নিজের খলিফা বা প্রতিনিধি স্বরূপ পবিত্র কুরআনে পরিচয় দিয়েছেন:

(إنّی جَاعِلٌ فِی الأرضِ خَلِیفَةً)

নিশ্চয়ই আমি ভূপৃষ্ঠে আমার খলিফা প্রেরণ করবো। [সুরা বাকারা ৩০ নম্বর আয়াত]

অথবা সুরা বাকারা ১২৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:

قَالَ إِنِّي جَاعِلُكَ لِلنَّاسِ إِمَامًا

তিনি বললেন নিশ্চয় আমি তোমাকে সমগ্র মানবজাতির জন্য ইমাম মনোনীত করলাম।

অতএব মহান স্রষ্টা সৃষ্টিজগত সংশ্লিষ্ট ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে সমসাময়িক যুগের যিনি ইমাম তাঁরই কাজে খোদায়ি প্রো‌টোকলে ফেরেশতাদের  মাধ্যমে নির্দেশনামা পাঠিয়ে থাকেন। এ প্রসঙ্গে অনেক সাহি হাদিস রয়েছে। যেমন,

ইমাম জাওয়াদ (আ.) তাঁর পিতামহ ইমাম আলী (আ.) থেকে এবং তিনি রাসুলুল্লাহ (স.) থেকে এই হাদিসটি বর্ণনা করেছেন: তিনি তাঁর জনৈক সাহাবীকে বললেন, শবে ক্বদরের প্রতি ঈমান ও বিশ্বাস রাখো কেননা এরাতে একবছরের বরাদ্দ নাযিল হয়ে থাকে আর একাজের জন্য আমার পর আরো কয়েকজন অভিভাবক থাকবেন, তাঁরা হলো আলী ও তাঁর এগারোজন সন্তান।

অতএব ফেরেশতাদের অবতরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান হলো যিনি যুগের ঐশী প্রতিনিধি যিনি মানব সমাজের হেদায়াতের দায়িত্ব পালন করছেন তাঁরই নুরানি অন্তর মহল্লা আর  এজন্যে মহান প্রতিপালক বলেছেন:

يَوْمَ نَدْعُوا كُلَّ أُناسٍ بِإِمامِهِمْ

সেদিন আমি প্রত্যেক মানুষকে তাঁর ইমামের সাথে আহ্বান করবো [সুরা বনি ইসরাইল ৭১ নম্বর আয়াত]  ইমাম কেবল পথপ্রদর্শক নন বরং সৃষ্টি জগতে মহান প্রতিপালকের সকল কর্মের প্রতিনিধি। তাই তাঁর কাছে  কৈফিয়ত তলবের জন্য সেদিন উভয়কেই ডাকা হবে। অতএব যুগের ইমাম বা ঐশী প্রতিনিধির এই গুরুত্বের কারণে মহানবী বলেছেন:

مَنْ مَاتَ وَ لَمْ يَعْرِفْ إمامَ زَمَانِهِ مَاتَ مِيتَةً جَاهِلِيَّةً ‘ 

যে ব্যক্তি তার যুগের ইমামকে না চিনে মৃত্যুবরণ করলো, সে জাহেলিয়াতের ওপর মৃত্যুবরণ করলো।’  [শারহুল মাকাসিদ, ৫ম খণ্ড, পৃ. ২৩৯ ।] অতএব উপরে উল্লেখিত হাদিসে ইমাম বা ঐশী প্রতিনিধি পরিচিতি ও আনুগত্যের প্রতি গুরুত্বের যে কথা বলা হয়েছে  “ইমামকে না মানলে বা না চিনলে অবশ্যই তার মৃত্যু হবে জাহেলিয়াত যুগের মৃত্যু বা বে-দ্বীন অবস্থায় মৃত্যু” । কেননা সে রহমত,  বরকত ও মাগফিরাত থেকে বঞ্চিত ।

পার্সটুডে/এমএএইচ/মো.আবুসাঈদ/২২

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ