রমজান: আত্মশুদ্ধির মহোৎসব (পর্ব-২৪)
রমজানে আত্মশুদ্ধির ডাকে সাড়া দেয় সব মুমিন বুদ্ধ!/মাসব্যাপী চলমান ঈমানী যুদ্ধ।/মুমিনের আমলে পুণ্যের শ্যামলে/শয়তান হয়ে যায় ভয়াবহ ক্রুদ্ধ।। (ইসলাম তরিক)
মহানবী (সা) বলেছেন রমজানে সবচেয়ে ভালো কাজ হল গোনাহ্ বর্জন। অজ্ঞতা ও অসচেতনতা পাপের কিছু উৎস। শয়তান মহান আল্লাহকে চ্যালেঞ্জ দিয়েছিল যে সে মানুষকে বিভ্রান্ত করবেই। কিন্তু মহান আল্লাহ বলেছেন, আমার বান্দা বা দাসদের ওপর তোর কোনো কর্তৃত্ব থাকবে না। অর্থাৎ কেউ যদি প্রকৃত ঈমানদার হয় তাহলে শয়তান তাকে পাপের জড়াতে পারবে না। তাই পাপ এড়াতে কেবল জ্ঞানই যথেষ্ট নয়। এ জন্য দরকার জ্ঞানকে নিশ্চিত বিশ্বাসে বা দৃঢ় ঈমানে পরিণত করা। কবরের আজাব, জাহান্নামের কঠিন শাস্তি তথা সেখানে পাপের মাত্রার আলোকে পাপীদের কোটি কোটি বা লাখ লাখ কিংবা শত-সহস্র বছর ধরে আগুনে জ্বলার কথা জানা সত্ত্বেও অনেকেই পাপে জড়িয়ে পড়ে! এর কারণ পরকালের বাস্তবতাগুলো সম্পর্কে তাদের জ্ঞান সুদৃঢ় ঈমানে রূপ নেয়নি। অনেকেই মানুষের লাশের পাশে থাকতে ভয় পায়। লোকটি মারা গেছে এটা জানার পরও এ বিষয়ে সুনিশ্চিত বিশ্বাস না থাকায় তারা ভয় পায়।
মাসুম বা নিষ্পাপ মহামানবরা কেন পাপ করেন না? আসলে তারা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ কথাটির তাৎপর্যের ওপর পরিপূর্ণ আস্থাশীল। তাঁরা বিশ্বাস করেন আল্লাহ ছাড়া আর সবকিছুই নশ্বর,আল্লাহ ছাড়া আর কারোরই ক্ষমতা নেই মানুষের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের: আল্লাহর সত্তা ছাড়া আর সবই ধ্বংসশীল।” (সূরা আল কাসাস, ২৮:৮৮) তাই মাসুমদের মাথায় কখনও পাপের চিন্তাও আসে না।
মানুষ কখনোই উদ্ধত হতনা, যদি সম্ভাবনা হিসেবেও মনে করত যে, কুরআনের ওয়াদাগুলো ও শাস্তির ভয়গুলো সত্য। কোনো রাস্তায় হিংস্র প্রাণী বা সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা আছে বলে খবর এলে সবাই ওই রাস্তা এড়িয়ে চলে এবং তথ্যটার সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের চেষ্টা করে। “জাহান্নাম বলে একটা কিছু হয়ত আছে যেখানে পাপকর্মের শাস্তি হিসেবে অনন্তকাল আগুনের মধ্যে থাকতে হবে”– কেউ এটা মনে করবে, অথচ একইসাথে পাপকাজও করে যেতে থাকবে– এটা কী করে সম্ভব?
যে মনে করে,সর্বশক্তিমান আল্লাহ সদা বিরাজমান ও সবকিছু দেখছেন এবং সে তার রবের সামনে উপস্থিত, তার কথা ও কর্মের প্রতিফল দেয়া হবে, বিচার হবে, শাস্তি হবে। আর এই দুনিয়ায় নেয়া তার প্রতিটা পদক্ষেপ,প্রতিটি কথা, কাজ– সবকিছুই আল্লাহর ফেরেশতা নিখুঁতভাবে রেকর্ড করছেন – এমতাবস্থায় কি সে নিজের ভুল ও পাপকর্মের ব্যাপারে উদাসীন থাকবে? বহু মানুষ এই সত্যগুলোকে ‘সম্ভব’ বলেও মনে করে না! কারো কারো আচার আচরণ দেখে বোঝা যায়, অপার্থিব জগতের অস্তিত্বকেই তারা সম্ভব বলে মনে করে না; কারণ পরকালকে কেবল ‘সম্ভব’ বলে মনে করাটাই মানুষকে অসংখ্য ভুল ও পাপ থেকে দূরে রাখে।
পবিত্র রমজান আত্মশুদ্ধি তথা আত্মগঠন ও আত্ম-সংশোধনের শ্রেষ্ঠ মাস। কারণ রমজানে রোজাদার অনেক বৈধ তৃপ্তি বা হালাল বিষয় ভোগ করা থেকে নিজেকে বঞ্চিত রেখে নাফস্ বা নিজের সঙ্গে জিহাদ তথা শ্রেষ্ঠ জিহাদে মশগুল থাকেন।
আমরা অনেকেই শারীরিক মৃত্যুকে কত বেশি ভয় পাই। কবর-আজাব বা কবরের অন্ধকার ঘরের কথা ভাবতেই শিউরে উঠি আমরা অনেকেই। কিন্তু আত্মার মৃত্যু অনেক বেশি ভয়ানক। আত্মাকে অসুস্থ রাখার জন্য পরকালে কোটি কোটি বছর কিংবা কেউ কেউ চিরকাল দোযখের আগুনে জ্বলবে এবং চিরকাল অন্যদের কাছে লজ্জিত হয়ে থাকবে। আত্মার কিছু রোগ হল স্বার্থপরতা বা আত্মকেন্দ্রিকতা, হিংসা, কার্পণ্য, অলসতা ও দায়িত্ব পালনে অবহেলা ইত্যাদি।
কেউ আমাদের হিংসুক বললে তা সহ্য করতে পারি না। বরং জোরেশোরে অস্বীকার করি। কিন্তু রমজানে নিজেই ভেবে দেখুন: আমার ভেতরে কি কি সমস্যা আছে? আমি কতটা আত্মপ্রেমিক ও পরশ্রীকাতর? নিজের জন্য যা পছন্দ করি অন্যের জন্যও তা পছন্দ করছি কি? নিজের বেলায় ভালো পদ, ভালো সুযোগ-সুবিধা ও সম্মান আশা করলেও অন্যের ক্ষেত্রেও তা করছি কি? গিবত ও চোগলখোরির মত মারাত্মক পাপের অভ্যাস আমার রয়েছে কি? অন্যরা আমার বিশেষ কিছু ত্রুটি বা দোষ গোপন রাখুক-এই আশা করলেও আমি কি অন্যদের ক্ষেত্রেও সেই একই প্রত্যাশা পূরণ করছি? কোনো কিছু কেনা বা বেচার সময় যে মূল্য আশা করি নিজের বেলায় অন্যের বেলায়ও কি তা আশা করছি? কোনো কোনো বিষয়ে খুব ধার্মিক হয়ে অন্যদের অনেক অধার্মিকতার তীব্র নিন্দা জানালেও ধর্মের সব বিষয়েই কি আমি নিজেকে এভাবে উন্নত করতে পেরেছি? নিজের ভালো কাজের কথা প্রচার করে বা উপকারের জন্য খোঁচা দিয়ে সেসবের সাওয়াবকে কি ধ্বংস করছি?
ভালো কাজের জন্য অন্যদের বাহবা বা প্রশংসা আশা করছি কি? অন্যদের বাহবা বা নিন্দার ভয় না করে সব কাজ কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই করছি কি? বার বার এ জাতীয় প্রশ্ন নিজেকেই নিজে করতে থাকুন। এরপর নিজেই নিজের চিকিৎসা করুন। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে আত্মিক রোগ-বালাই থেকে মুক্ত হওয়ার তৌফিক দিন।#
পার্সটুডে/এমএএইচ/মো.আবুসাঈদ/২৪
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।