রমজান: আত্মশুদ্ধির মহোৎসব (পর্ব-২৮)
রঙিন ভবের রঙিন আশা চোখে লাগায় ঘোর,/উন্মাদ এই মত্তশালায় আমিও দিয়েছি দৌড়। /করেছি পাপ জেনে না জেনে এ ভবের রঙ্গশালায়,/হয়তো রয়েছে পাপরাশি মোর শীর্ষ পর্বতমালায়। (ফাতেমা জাহান)
তবুও দয়াময় মহাপ্রভুর অশেষ রহমতের ধারার পরশ হতে এ মহাপাপী নিরাশ নই কভু /তওবার অশ্রুজলে এ রমজানেই তোমার অশেষ করুণায় আমায় পবিত্র করে তোলো হে বিভু!
কান্না হচ্ছে দোয়া কবুলের এক বড় অস্ত্র। মহান আল্লাহ সেই ভগ্ন হৃদয়ের দোয়া কবুল করেন যে হৃদয় অন্য সব কিছু হতে আশা হারিয়ে একমাত্র আল্লাহরই দয়ার সাগরে ভাসিয়ে দেয় আশার ভেলা। মহান আল্লাহর নবী-রাসুলরাও নিষ্পাপ হওয়া সত্ত্বেও মহান আল্লাহর দরবারে এমনভাবে কেঁদে কেঁদে মুনাজাত করতেন যেন তাদের চেয়ে বড় পাপী আর কেউ নেই! আর তাই আমরা নিষ্পাপ নই বলে আমাদের মুনাজাতগুলো হওয়া উচিত অনেক বেশি অশ্রু-সিক্ত।
ইবাদাতের জায়নামাজে ও নামাজের মধ্যে আমাদের মনে করা উচিত যে এটাই হয়তো আমাদের জীবনের শেষ নামাজ এবং আজকের রোজাই হয়তো জীবনের শেষ রোজা। আর এই মুনাজাতই হয়তো পার্থিব জীবনের শেষ মুনাজাত। কালই যদি আমরা মারা যাই আমরা তো জানি না আমাদের জন্য বেহেশত না দোযখ অপেক্ষা করছে! তাই সব সময়ই মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থেকে সৎকর্ম করে যাওয়া উচিত এবং পরকালের পাথেয় সঞ্চয়ে সচেষ্ট হওয়া উচিত। আমরা যদি কোনো ব্যক্তির সম্পদ ও সম্মানের ক্ষতি করে থাকি অন্যায়ভাবে তাহলে মৃত্যুর আগেই তার কাছ থেকে ক্ষমা চাইতে হবে ও ক্ষতিপূরণ দিয়ে তাকে সন্তুষ্ট করতে হবে।
মানুষ যদি নিজেকে শুদ্ধ করতে চায় তাহলে মৃত্যুর চিন্তাই তার জন্য সবচেয়ে বড় সংস্কারক ও সবচেয়ে বড় পরামর্শদাতা। মৃত্যু এমন এক অনিবার্য বিষয় যা এড়ানোর সাধ্য কারো নেই। বড় বড় পরাক্রান্ত জালিমও মৃত্যুর কথা মনে রেখে সৎ ও খোদাভীরু বান্দায় পরিণত হতে পারে। আমরা কেউই জানি না আমাদের কখন আয়ু ফুরিয়ে যাবে। তাই বিচার দিবসের ব্যাপক ভোগান্তি ও ঝামেলার কথা মনে রেখে আমাদের উচিত সব ধরনের অসৎ ও মন্দ স্বভাব এখনই ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেয়া। পুলসিরাত পার হওয়ার আগে অনেক স্টেশনে আমাদেরকে ছাড়পত্র আদায় করতে হবে আমাদের সৎকর্ম ও পাপ-বর্জনের রেকর্ড দেখিয়ে। বিচার দিবসের কঠোর পিপাসা ও উত্তাপ সহ্য করার ক্ষমতা আমাদের কারোরই নেই। পরকালের শাস্তি যে কত কঠোর তা কল্পনাও করা এই ইহজগতে সম্ভব নয়। পরকালের শাস্তির মেয়াদের দীর্ঘতা ও শাস্তির তীব্রতা কোনোটাই সহ্য করার ক্ষমতা মানুষের নেই। কিন্তু তবুও মানুষ এমনভাবে আচরণ করে থাকে যেন সে কোনোদিন মরবে না এবং পরকালীন মুক্তির গ্যারান্টি বা সনদ পেয়ে গেছে!
বলা হয় পরকালের একটি দিন দুনিয়ার এক হাজার বছরের সমান দীর্ঘ! দোযখের আগুনের উত্তাপ এত বেশি যে সেই উত্তাপের বিন্দুমাত্র আঁচ যদি এই পার্থিব বিশ্বে এসে পড়ত বিশ্ব জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যেত! পরকালে আমাদের বিদ্যা-বুদ্ধি ও ধন সম্পদ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে। আমরা নিরন্ন ও দরিদ্রদের সহায়তা না করে থাকলে সে বিষয়ে জবাবদিহি করতে হবে। অযৌক্তিক কোনো অজুহাত সেদিন কাজে আসবে না। আমরা যৌবনকালকে কিভাবে ব্যয় করেছি তার হিসাব সেদিন দিতে হবে। আমরা বয়স্ক ও এমনকি বৃদ্ধ হওয়ার পরও কেনো মন্দ কাজ বা পাপের আকর্ষণ ছাড়তে পারিনি সে বিষয়ে জবাবদিহি করতে হবে। আমরা খোদার দেয়া জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়ে কি অন্যদের সুপথ দেখানোর চেষ্টা করেছি কি? আমরা নিজ স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যদের এবং সন্তানদের যথাযথভাবে ধর্ম এবং অধর্ম সম্পর্কে সচেতন করেছি কী? এইসব প্রশ্নের উত্তর যদি নেতিবাচক হয় তবে পরকালে আমাদেরকেও কাফির মুশরিকদের সঙ্গী হিসেবে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
রমজান মাস হল দান খয়রাতের মাস। এই মাস জাকাত ও খুমস পরিশোধের জন্যও সবচেয়ে ভালো সময়। জাকাত ফিতরা এসব পরিশোধ না করা হলে আমাদের কোনো ইবাদত কবুল হবে না।
রমজানের রাতগুলোতে দোয়া পাঠ যেন মহান আল্লাহর সঙ্গে প্রেমালাপ ও প্রেমাস্পদের জন্য নিজেকে সবচেয়ে বিনীত করার আকুল মহড়া। এমনসব রাতে বহু পাপ ও অত্যন্ত কম বা নগণ্য ভালো কাজের কথা স্মরণ করে বলা উচিত:
'হে আল্লাহ! আমরা একদল রহমত-প্রত্যাশী ভিক্ষুক তোমার সম্মান ও মহামর্যাদার উসিলায় তোমার রহমতের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। পুণ্য বলতে কিছুই নেই আমাদের। তাই নতজানু ও দরিদ্রদের সঙ্গে চড়েছি এমন এক জাহাজে যা অপেক্ষা করছে তোমার দয়া ও করুণার মহাসাগর-তীরে। অনুমতি চাচ্ছি তোমার যাতে পাড়ি দিতে পারি তোমার দয়া ও রহমতের এই মহাসাগর। তুমি যদি এই সম্মানিত মাসে কেবল তাদেরকেই ক্ষমা কর যারা একনিষ্ঠ ইবাদত তথা রোজা ও নামাজের মাধ্যমে নিজেদের পবিত্র করেছে তাহলে উদাসীন পাপীদের কে রক্ষা করবে যারা ডুবে আছে তাদের পাপের সাগরে? যদি তুমি তোমার অনুগত বান্দাহ ছাড়া অন্যদের করুণা না কর তাহলে হতভাগা অবাধ্যদের কে রক্ষা করবে? যারা সৎকর্ম করেছে কেবল তাদের কাজকেই যদি তুমি কবুল কর তাহলে তাদের কি উপায় হবে যারা পুণ্যহীন বা যাদের সৎকর্ম খুবই নগণ্য?'
'হে আল্লাহ! আমরা অনুতপ্ত পাপী বলেই তুমি আমাদের ক্ষমা কর ও রক্ষা কর দোযখের আগুন থেকে তোমার অপার করুণায়। হে সর্বোচ্চ দাতা ও দয়ালু! তোমার প্রিয় নবী ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের প্রতি অশেষ দরুদ পাঠানোর উসিলায় ক্ষমা কর আমাদের।' হে আল্লাহ আমরা যেন শয়তানের অবিরাম হামলা ও কুমন্ত্রণার বিষয়টিকে হাল্কাভাবে না নেই। এ ব্যাপারে তোমারই সাহায্য চাইছি হে মহাকৌশলী ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ!
এবারে শোনা যাক অর্থসহ ২৮তম রমজানের দোয়া
পার্সটুডে/এমএএইচ/মো.আবুসাঈদ/২৮
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।