মে ০৭, ২০২২ ১৯:৫৮ Asia/Dhaka

বাংলাদেশ মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে ভয়াবহ রকমের প্রতিবন্ধকতা আছে বলে জানালেন সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার গোলাম মোর্তোজা। তিনি এ বিষয়ে রেডিও তেহরানকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বাস্তবতা হচ্ছে ১৫০ তম কিংবা ১৭০ তম বা ১৬২ তম যাই হোক না কেন কথা সেই একই সেটা হচ্ছে যে প্রতিবন্ধকতার কথা বললাম তা সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। আর এই পাল্লা দিয়ে বাড়ার ক্ষেত্রে অনেকগুলো দৃশ্যমান ব্যাপার আছে।

তিনি আরও বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন মারাত্মকভাবে গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে খর্ব করছে। এটি একটি কালো আইন। এই কালো আইন বাতিল করতে হবে। সম্পাদক পরিষদ যে সংশোধনের কথা বলছে তার সাথে আমি একমত নই। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করতে হবে একইসাথে সরকারকে গণমাধ্যমে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জায়গায় আন্তরিক হতে হবে।

পুরো সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো। এটি গ্রহণ, উপস্থাপনা ও প্রযোজনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।

শ্রোতা/পাঠকবন্ধুরা! স্বাগত জানাচ্ছি রেডিও তেহরানের সাপ্তাহিক সাক্ষাৎকারভিত্তিক অনুষ্ঠান আলাপনে আমি গাজী আবদুর রশীদ। আশা করছি আপনারা সবাই ভালো আছেন। আমাদের আজকের সাক্ষাৎকারের বিষয় মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে রিপোটার্স উইদাউট বর্ডারস এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদন এবং এর গ্রহণযোগ্যতা ও বাস্তবতা নিয়ে। আর আমাদের সাথে এ বিষয়ে কথা বলার জন্য অতিথি হিসেবে আছেন ডেইলি স্টারের সিনিয়র সাংবাদিক, রাজনৈতিক ভাষ্যকার, বিশিষ্ট টিভি উপস্থাপক ও সাপ্তাহিক এর সম্পাদক গোলাম মোর্তোজা। জনাব গোলম মোর্তজা রেডিও তেহরানে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি।

গোলাম মোর্তোজা: ধন্যবাদ আপনাদেরকেও।

রিপোটার্স উইদাউট বর্ডারস

রেডিও তেহরান: জনাব, গোলাম মোর্তোজা, বিশ্বজুড়ে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা ফ্রান্সভিত্তিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস সম্প্রতি তাদের ওয়েবসাইটে ২০২২ সালের গণমাধ্যম সূচক প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ ১০ ধাপ পিছিয়েছে। কতটা গ্রহণযোগ্য এই রিপোর্ট?

গোলাম মোর্তোজা: দেখুন, এরকম একটি রিপোর্ট প্রকাশের পর বাংলাদেশে অনেকের প্রতিক্রিয়া দেখছি। তারা খুব অবাক হচ্ছেন এই জন্য যে বাংলাদেশ ১৮০ টি দেশের মধ্যে গণমাধ্যাম সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬২! গত বছর এবং তার আগের রিপোর্টের চেয়ে ১০ ভাগ অবনতি হয়েছে। এতে অনেকেকে অবাক হতে দেখছি। সরকারের অনেক লোকজন বলার চেষ্টা করছেন- এই রিপোর্ট গ্রহণযোগ্য না, বিদ্বেষপ্রসূতসহ নানা কথা। কিন্তু আমি এ বিষয়ে বলব- এতে অবাক হওয়ার কোনো কিছু নেই। সেরকম বিষয়ও না। রিপোটার্স উইদাউট বর্ডার বিদ্বেষপ্রসূত হয়ে কিংবা বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে রিপোর্ট দেবে সেরকম ভাবার কোনো সুযোগ বা অবকাশ আছে বলে একজন সংবাদকর্মী হিসেবে আমার কাছে মনে হয় না।

এ সম্পর্কে দ্বিতীয় যে বিষয়টি বলব সেটি হচ্ছে, এই ধরণের রিপোর্ট কিছু নির্দিষ্ট সূচকের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়। আর সেই সূচকগুলো নিয়ে রিপোর্টটি প্রকাশিত হওয়ার পর কারও কারও কাছে মত দ্বিমত বা ভিন্নমত থাকতে পারে। আর সেই মতের বিষয়টি এরকম- ধরুন ১৬২ তম না হয়ে ১৫০ তম বা তারচেয়ে কম বা তারচেয়ে বেশি এরকম একটা কিছু। এই জায়গাগুলোতে কিছুটা মতপার্থক্যের মতো  বিষয় থাকতে পারে। এটা খুব একটা অস্বাভাবিক বিষয় নয়। এ ধরণের সূচকে এমনটি হতে পারে।

রেডিও তেহরান: গোলাম মোর্তোজা-সূচকের কিছু বিষয় নিয়ে মতপার্থক্য তৈরি হতে পারে কিন্তু বাস্তবতা আসলে কি?

বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা (প্রতীকী ছবি)

গোলাম মোর্তোজা: কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ১৫০ তম কিংবা ১৭০ তম বা ১৬২ তম যাই হোক না কেন কথা সেই একই সেটা হচ্ছে যে বাংলাদেশ মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে ভয়াবহ রকমের প্রতিবন্ধকতা আছে। আর সেই প্রতিবন্ধকতা সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। আর এই পাল্লা দিয়ে বাড়ার ক্ষেত্রে অনেকগুলো দৃশ্যমান ব্যাপার আছে।

এখন বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে বিদেশি কোনো সংস্থা যখন একটি সূচক প্রকাশ করে তখন আমরা সরকারের পক্ষ থেকে একধরনের প্রতিক্রিয়া দেখছি যে এই সূচক প্রকাশ বিদ্বেষমূলক, এটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে করা হয়েছে কিন্তু এই যে গণমাধ্যমের যে সূচকটির কথা বলা হচ্ছে এবং যেসব কারণের কথা বলা হচ্ছে এইসব কারণের কথা আমরা দেশের ভেতরে থেকে গত কয়েক বছর ধরে এক নাগাড়ে বলছি। আমরা বারবার একথা বলেছি যে এইসব ঘটনা যদি ঘটতে থাকে সেক্ষেত্রে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশে মত প্রকাশের ক্ষেত্রে যে নারারকমের প্রতিবন্ধকতা আছে এবং নতুন নতুন প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হচ্ছে। একথা আমরা সবসময় বলে আসছি।

রেডিও তেহরান: জ্বি গোলাম মোর্তোজা, আপনি বললেন বাংলাদেশ মত প্রকাশের ক্ষেত্রে নানা রকম প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হচ্ছে।  আমরা দেখেছি, যেদিন এই রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে সেদিনই বাংলাদেশ সম্পাদক পরিষদ এক বিবৃতিতে বলেছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য বাধা। তো আপনার পর্যবেক্ষণ কি?

গোলাম মোর্তোজা: দেখুন, যখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করা হয় এবং যে প্রক্রিয়ায় তাতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে খর্ব করা হয়েছে তা বিস্ময়কর। এই আইনে মামলা করে হয়রানি করা হয়েছে, তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে-এসবই দৃশ্যমান। এর আগে অবশ্য ৫৭ ধারা এবং তথ্য-প্রযুক্তি আইনও করা হয়। তবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে একেবারে খর্ব করা হয়। রিপোটার্স উইদাউট বর্ডার যেসব সূচকের মাধ্যমে এই প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে সেখানে এই বিষয়গুলো খুব গুরুত্বসহ তুলে ধরা হয়েছে। এটির বিরুদ্ধে আমরা শুরু থেকেই প্রতিবাদ করে এসেছি কিন্তু তাতে কোনো গুরুত্ব দেয়া হয়নি। এখন বিদেশি কোনো সংগঠন থেকে যখন বলা হচ্ছে তখন তা সরকারের বিরুদ্ধে বলা হচ্ছে বলে অভিযোগ করা হচ্ছে তাদের পক্ষ থেকে। বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমের  মত প্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সরকারের যে বর্তমান এবং গত কয়েক বছর ধরে যা বাস্তবতা তার নিরীখে এমন চিত্রই তো আসার কথা।

শ্রোতাবন্ধুরা! আপনারা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ও পরিস্থিতি নিয়ে সিনিয়র সাংবাদিক গোলাম মোর্তোজার সাক্ষাৎকার শুনছেন। ফিরছি শিগগিরি আমাদের সাথেই থাকুন।

রেডিও তেহরান: জনাব গোলাম মোর্তোজা, রিপোটার্স উইদাউট বর্ডার –মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশকে নিয়ে যে কথা বলেছে তাতে অবাক হওয়ার মতো কিছু নেই এবং সেটাই বাস্তবতা। তো সাক্ষাৎকারের আজকের পর্বের সবশেষ যে প্রশ্নটি করব সেটি হচ্ছে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ব্যাপারে সরকার কিন্তু বরাবরই বলে আসছে দেশের গণমাধ্যম খুবই স্বাধীন এবং স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে কোন বাধা নেই। আপনিও কি তাই মনে করেন?

মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের সূচক নিয়ে আরএসএফ ইনডেক্স

গোলাম মোর্তোজা: দেখুন, বাংলাদেশ মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে কি নেই এই প্রশ্নটি যখন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোচিত হয় তখনই বুঝতে হয় যে এখানে কিছু একটা সমস্যা আছে। তার কারণ যে দেশের গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারে সেই দেশের গণমাধ্যম কিংবা সেই দেশকে নিয়ে এই প্রশ্নটি ওঠে না যে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে কি নেই! আর কোনো একটি রিপোর্ট প্রকাশ পেলে সেটিকে অস্বীকার করার প্রবণতা আমাদের সরকারের পক্ষ দেখা যায়। তারা ভাবেন অস্বীকার করলেই সম্ভবত আর সেই সমস্যাটি থাকে না বা থাকবে না। কিন্তু যেসব সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আসে আমাদের সরকারগুলো সেগুলোকে সামনে এনে সেই সুনির্দিষ্ট অভিযোগের সত্য-মিথ্যা যাচাই করে না। যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে সে বিষয়ে যে ব্যবস্থা নেয়া দরকার সেই ব্যবস্থা নেয় না। সরকার সরকারের মতো চলে এবং দেশের গণমাধ্যম সে সম্পর্কে কিছু বললে সেটাকেও বিবেচনায় নেয়া হয় না। আর আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে যখন কথা আসে তখন সরকার কোথাও কোথাও আংশিকভাবে স্বীকার করে নেয় আবার কোথাও কোথাও অস্বীকার করে। বলে যে না এসব সত্যি না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলে সেখানে যখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রসঙ্গ আসে তখন আমাদের সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রী বলার চেষ্টা করেন যে হ্যাঁ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অনেক অপব্যবহার হয়েছে; এটা আমরা সংশোধন করব-ইত্যাদি। একথাটি আমাদের মন্ত্রীরা কয়েকশবার করে একেক জন বলেছেন যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যদি কোনো আপত্তিকর কিছু থাকে, খারাপ কিছু থাকে তবে তা পরিবর্তন করা হবে সংশোধন করা হবে। কিন্তু তারা কখনই কোনো কিছু করেন না।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন

এখানে আমার বক্তব্য হচ্ছে বাংলাদেশে মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের যে অবস্থান তাতে  ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন একটি কালো আইন এবং সরকার এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করতে হবে। সম্পাদক পরিষদ যে সংশোধন করার কথা বলে আমি তার সাথে একমত নই। এই আইনে সংশোধন করে কোনো সমাধান হবে না। এই কালো আইনটি পুরোপুরিভাবে বাতিল করতে হবে। আর যদি সরকার এই আইনটি বাতিল না করে তাহলে এই ১৬২ তম নাকি ১৫০ তম বা অন্য যে পরিসংখ্যানই উঠে আসুক না  কেন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এরকম অবস্থাই প্রকাশ পাবে যে বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নেই। পাশাপাশি আরেকটি কথা বলে রাখা দরকার যে, শুধু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করলেই হবে না একইসাথে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জায়গাটিতে সরকারকে আন্তরিক হতে হবে। সরকারকে আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করতে হবে যে তাকে সমালোচনা করা যাবে। বিশ্বাস করতে হবে যে মত প্রকাশের স্বাধীনতার জায়গা দিতে হবে। শুধু আইন বাতিল করলেও আবার সব সমস্যার সমাধান হবে না।

তো জনাব গোলাম মোর্তোজা, বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে সম্প্রতি যে সূচক প্রকাশিত হয়েছে সে সম্পর্কে রেডিও তেহরানকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে আবারও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

গোলাম মোর্তোজা: ধন্যবাদ আপনাকে এবং রেডিও তেহরানের দর্শক-শ্রোতাদের।#

পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/৭

 

ট্যাগ