জুলাই ২৩, ২০২২ ১৫:৫৫ Asia/Dhaka

আমরা ইরানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় উত্তর খোরাসান প্রদেশে বেড়াচ্ছি। আজ আমরা যাবো উত্তর খোরাাসন প্রদেশের এসপারায়েন শহরের দিকে।

শহরটি বেশ প্রাচীন এবং বচুখে কুস্তি বা রেসলিংয়ের জন্য বিখ্যাত। তাছাড়া এই শহরে রয়েছে আঙুর বাগান, তুলা উৎপাদনের খামার, জিরা, মিষ্টি পণির, আখরোট, পেস্তা বাদামসহ আরও বহু রকমের ফলফলাদি এবং স্থানীয়ভাবে উৎপন্ন উপহার সামগ্রী।

এসপারায়েন শহরের কেন্দ্রিয় শহরটিও এই নামেই পরিচিত। অন্তত দুই শ ত্রিশটি ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে এই শহরে। বিশেষ করে এখানে রয়েছে কাঁচা ইট মানে রোদে পোড়া ইটের তৈরি দ্বিতীয় বৃহত্তম দূর্গ। বাম দূর্গের পরই এই দূর্গটির অবস্থান। রয়েছে বৃহৎদুটি পার্ক। একটি সরিগুল ন্যাশনাল পার্ক অপরটি সলুক পার্ক। বিচিত্র জীভ-জন্তু আর সবুজ প্রকৃতির জন্যও অনন্য একটি শহর এসপারায়েন। বিস্ময়কর প্রাকৃতিক নিদর্শনের জন্য শহরটির খ্যাতি রয়েছে। এসপারায়েন শহরের প্রাচীন ইতিহাস বেশ সমৃদ্ধ। খ্রিষ্টপূর্বকাল থেকেই এখানে মানব বসতি ছিল। তাদের ব্যবহৃত বহু সরঞ্জাম থেকে সেটাই প্রমাণিত হয়েছে। এইসব প্রমাণ থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে ইরানের ইতিহাসে এ অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য যথেষ্ট সমৃদ্ধ ছিল।

শহরের বিভিন্ন অংশে প্রাগৈতিহাসিক স্থান এবং পাহাড়-পর্বত ও টিলা দেখতে পাওয়া যাবে।  প্রাগৈতিহাসিক এলাকা-অ্যাক এবং প্রাগৈতিহাসিক এলাকা-দুইয়ের কথা প্রথমেই উল্লেখ্য করার মতো। এর বাইরেও রয়েছে আঞ্জিরলি, চেহেল দোখতারনসহ এরদেগনি ক্যাম্পের মতো জনবসতিপূর্ণ একটি এলাকাও। এগুলোর সবকটিই প্রাগৈতিহাসিক যুগের নিদর্শন। এইসব নিদর্শন থেকে প্রমাণিত হয় প্রাগৈতিহাসিক কালের ইরানেও এ অঞ্চলের মানুষের সক্রিয় উপস্থিতি ছিল এবং এখনও আছে। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে বিশেষ করে আশকানি এবং সাসানি যুগে এসফারায়েন শহরকে সর্বদা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশ হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে। ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক গ্রন্থে এই শহরের নাম বহুবার উল্লেখ করা হয়েছে। এই অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আশকানি এবং সাসানি শাসনামলের নিদর্শনগুলো সেই সময়ে এই এলাকার সমৃদ্ধিরই প্রমাণ।

এসপারায়েন শহরের প্রকৃতি

ইসলামি যুগেও এসফারায়েন নিশাবুর-গোরগান সড়কের পাশে অবস্থানের কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। ইসলামি যুগে এ শহর অঅরও বেশি বিকাশ লাভ করে। ঐতিহাসিক বিভিন্ন সূত্রে এই শহরের নাম উল্লেখ হতে দেখা যায়। তাছাড়া এই এসফারায়েন শহরে স্বনামখ্যাত মনীষীদের আগমনও ইসলামি যুগের প্রাথমিক কিংবা মধ্যবর্তী সময়ে এই শহরের ঐশ্বর্যের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। এসফারায়েন শহরের মূল অধিবাসী হলো কুর্দি, তুর্কি এবং তাত গোত্রের লোকজন। এইসব গোত্রের সবারই নিজ নিজ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে। এদের নিজস্ব রীতি-আচার-প্রথা যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে শিল্প বৈশিষ্ট্যও। এসফারায়েন শহরের কুর্দি অধিবাসীরা সেই সাফাভি শাসনামল থেকেই এখানে বসবাস করে আসছে। তুর্কিরা এখানকার সাফিয়াবাদ এলাকাতেই বসবাস করতো। তারা তিন শ বছর ধরে বসবাস করে আসছে। তাত জনগোষ্ঠিও হাজার বছরের পুরোণো রুয়িন গ্রামে বসবাস করতো। জাতি ও গোত্রীয় এই বৈচিত্র এসফারায়েন শহরের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

উত্তর খোরাসান প্রদেশের সুন্দর শহরগুলোর একটি এসফারায়েন। স্বাভাবিকভাবেই এখানে গড়ে উঠেছে বহু পর্যটন এলাকা। প্রাচীন নিদর্শনের পাশাপাশি এসফারায়েন শহরের অন্যতম আকর্ষণ হলো এখানকার বিশেষ কুস্তি বা রেসলিং খেলা। এই কুস্তিকে বচুখেহ কুস্তি বলা হয়। বচুখেহ কুস্তি যেন এসফারায়েন শহরের প্রতীক হয়ে উঠেছে। শহরের প্রবেশমুখে এই খেলার প্রতীকী ভাষ্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে। এসফারায়েন শহরের আশেপাশের টিলাগুলো থেকে পাওয়া ঐতিহাসিক তথ্যপঞ্জি অনুযায়ী এই শহরটির প্রাচীনত্ব খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম কিংবা ষষ্ঠ সহস্রাব্দ পর্যন্ত চলে যায়।

এখানে আবহাওয়াগত বৈচিত্র্য এবং সুন্দর সুন্দর পাহাড় আর সমতলভূমি ও প্রান্তরের অস্তিত্ব থাকার কারণে যুগে যুগে এই এসপারায়েন মানব বসতির জন্য অনুকূল ছিল। এসফারায়েন শহরের লোকজনের মধ্যে ভাষাগত বৈচিত্র্যও ব্যাপক। ফার্সি ভাষার পাশাপাশি লোকজনকে অন্যান্য ভাষা যেমন তুর্কি কিংবা কুর্দি ভাষাতেও কথা বলতে দেখা যায়।

আমরা ইতোপূর্বে এসপারায়েন শহরের বিখ্যাত খেলা বচুখেহ কুস্তি'র কথা বলেছিলাম। যেহেতু এসপারায়েন এই ক্রীড়াটির জন্য বিশেষভাবে খ্যাত তাই খেলাটির সঙ্গে খানিকটা পরিচিত হলে মন্দ কী!

এই খেলা অন্তত আড়াই হাজার বছর আগে থেকে এসপারায়েন শহরে চালু আছে। এই প্রদেশের মানুষের মাঝে সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ এই খেলার প্রতি এতো অনুরাগ ও ভালো লাগার বিষয়টি তাদের পেরিয়ে আসা কয়েক শতাব্দির জীবনযাপনের পটভূমিতে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। এখানকার প্রাচীন শাসকদের শাসনব্যবস্থা নির্ভর করতো উপজাতি এবং যাযাবরদের শক্তিমত্তার ওপর। আবার প্রতিটি উপজাতির টিকে থাকার বিষয়টিও নির্ভর করতো তাদের যুবক এবং বীরদের শক্তিমত্তার ওপর। এসপারায়েনের সকল উৎসব, সকল ঈদ আনন্দ কিংবা নওরোজের আনন্দ, বিয়ে-শাদি ইত্যাদি সকল অনুষ্ঠানেই গুরুত্বপূর্ণ এবং বলা ভালো প্রধান আকর্ষণ ছিল এই বচুখেহ কুস্তি।

চুখেহ' শব্দটি একটি কুর্দি শব্দ। এর মানে হলো এক ধরনের খোলা গাউন যা পরে কুস্তিগীররা মঞ্চে প্রবেশ করে। ওই চুখেহ-কে সাদা একটা কাপড় দিয়ে কোমরে বেঁধে রাখে। এই খেলাটা যেহেতু অনেক আগে থেকেই উত্তর খোরাসানের কুর্দি উপজাতিদের মাঝে প্রচলিত ছিল তাই 'কুস্তিয়ে বচুখে' মানে 'চুখেহযুক্ত কুস্তি' নামে পরিচিতি লাভ করে। ফার্সি ভাষায় 'ব' মানে হলো দ্বারা,দিয়ে, সহিত ইত্যাদি। খেলা উপভোগ করার জন্য মহিলাদের আলাদা গ্যালারির ব্যবস্থা করা হয়। বিজয়ী কুস্তিগীরকে বহু রকমের পুরস্কারে ভূষিত করারও নিয়ম প্রচলিত আছে।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/ ২৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ