জ্ঞান-বিজ্ঞানে ইরানিদের অবদান - তিন
এ সংক্রান্ত গত অনুষ্ঠানে আমরা ইসলামের প্রাথমিক যুগে ইরানের খ্যাতনামা বেশ কিছু বিজ্ঞানীর গবেষণাকর্ম এবং ইসলামপূর্ব যুগে গ্রিকসহ অন্যান্য জাতির গণিতশাস্ত্র গবেষণায় ইরানিদের ভূমিকা ও অবদানের বিষয়টি তুলে ধরেছিলাম।
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ ও সপ্তম শতাব্দিতে প্রাচীন পারস্য তথা আজকের ইরানের শিল্প, সংস্কৃতি ও জ্ঞানবিজ্ঞানের আলো ইরাক ও উত্তর আফ্রিকা থেকে শুরু করে গ্রিস ও ইউরোপের আরো অনেক দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতকে গ্রিসের সঙ্গে ইরানের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। এরপর আলেক্সান্ডার ইরান আক্রমণ করলে গ্রিস ও ইরানের মধ্যকার সাংস্কৃতিক বন্ধন আরো সুদৃঢ় হয়। প্রাচীন পারস্যে পার্থিয়ানদের শাসনকালে সিস্তান থেকে একদল পণ্ডিত ভারতে যান এবং ভারতে গণিত ও জ্যোতিশাস্ত্রের ভিত্তি স্থাপন করেন। তারা 'মাগ ব্রাহ্মণ' নামে খ্যাতিমান ছিলেন। মনে করা হয় পরবর্তীতে ভারতের বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ ও গণিতবিদ 'ব্রহ্মগুপ্ত' ছিলেন মাগ ব্রাহ্মণেরই অবশিষ্ট ধারা।
প্রকৃতপক্ষে, প্রাথমিক যুগে গণিতশাস্ত্রের ব্যবহার ছিল খুবই ক্ষুদ্র পরিসরে এবং মানুষের দৈনন্দিন জীবনের চাহিদার সাথে সম্পর্কিত ছিল। যেমন, গৃহপালিত পশু গণনা করা, কৃষিভূমি ভাগ করা, উপাসনালয় ও ঘর নির্মাণ, নদী বা খাল পারাপারের জন্য বাঁশকাঠের ব্রিজ বানানো, কখনো কখনো বাধ নির্মাণ, যুদ্ধের সরঞ্জাম তৈরি প্রভৃতি ক্ষেত্রে হিসাব নিকাশের জন্য গণিতের ব্যবহার ছিল।
এরপর মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে গণিতের পদ্ধতিতেও পরিবর্তন আসে এবং ব্যবসা বাণিজ্য, অর্থ লেনদেন, জাহাজ নির্মাণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে উন্নত গণিতের ব্যবহার শুরু হয়। বিশেষ করে ইরানে জাহাজ নির্মাণ, কূপ খনন, কৃষিভূমিতে পানি সরবরাহের জন্য ক্বানায়াত বা টানেল নির্মাণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে গণিতের ব্যবহার ছিল লক্ষণীয়।
এটা খুবই স্বাভাবিক যে নগর সভ্যতা এবং শক্তিশালী সরকার ব্যবস্থা গড়ে ওঠার একই সময়ে মানুষের প্রয়োজনেই বিভিন্ন সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য গণিতের ব্যবহার হয়ে আসছে। কিন্তু আগেকার যুগে সংখ্যার হিসাব কেবলমাত্র মানুষের সাধারণ দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজন মেটানোর ক্ষেত্রে কাজে লাগতো। অর্থাৎ আজকের যুগের মতো অতীতে গণিতের তাত্বিক ব্যবহার ছিল না। বলা যায়, গণিতের তাত্বিক ব্যবহার শুরুর পর এই শাস্ত্র জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সামাজিক উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখতে শুরু করে।

খ্রিস্টপূর্ব চতুর্দশ শতাব্দিতে ইলামি জাতিগোষ্ঠী ইরানের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে শাসন করতো। ইলামি গোত্রের প্রভাবশালী শাসকরা প্রাচীন শুশ নগরিসহ আশেপাশের বিশাল এলাকা জুড়ে রাজত্ব করতো। তাদের পাশেই সুমেরিয় এবং এরপর আজকের ইরাকের বাবেলিয়রা ছিল তাদের প্রতিবেশী। সুমেরি একটি জাতির নাম। তাদের আদি বাসস্থান ছিল বর্তমান ইরাকের মেসোপটেমিয়ার উত্তর-পূর্বে। তাদের সভ্যতাকে বলা হয় সুমেরিয় সভ্যতা। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সুমেরিয়দের যথেষ্ট অবদান ছিল। তারা জলঘড়ি ও চন্দ্র পঞ্জিকা আবিষ্কার করেন। তারা জ্যোতির্বিজ্ঞানেরও চর্চা করতেন। গণিতশাস্ত্রেও তাদের ভূমিকা ছিল। সুমেরিয়দের সাথে তৎকালীন ইলামিদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সাংস্কৃতিক ও ব্যবসায়ীক যোগাযোগ ছিল। বলা যায়, উন্নত সংস্কৃতি ও সভ্যতার দিক থেকে এ দুই জাতির সমৃদ্ধিকে আলাদা করে দেখার কোনো সুযোগ ছিল না। ইলামিদের সাড়ে তিন হাজার বছরের শাসনকালে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তারা এতো বেশি অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছিল যে পরবর্তী ইরানি সভ্যতার বিভিন্ন যুগে তার প্রভাব পড়েছিল।
যাইহোক, ইলামি সভ্যতার নিদর্শন বা স্মৃতিচিহ্ন খুব কমই আবিষ্কৃত হলেও তাদের ব্যবহৃত ভাষা ও অক্ষরজ্ঞান পরবর্তীতে বহুকাল পর্যন্ত পার্সসহ ইরানের অন্যান্য সভ্যতার যুগেও ব্যবহৃত হয়েছে। প্রাচীন শুশ অঞ্চলে ইলামি সভ্যতা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে আরো প্রত্নতাত্বিক গবেষণা ও আবিষ্কার জরুরি। কিন্তু এ পর্যন্ত যতটুকু নিদর্শন পাওয়া গেছে তাতেই প্রাচীন ইলামি সভ্যতার বিশালত্ব ও গভীরতা উপলব্ধি করা যায়।
শুশ অঞ্চল ও এর পার্শ্ববর্তী মেসোপটেমিয়া অঞ্চলের জাতিগুলোর মধ্যে প্রচলিত গণিতশাস্ত্র ছিল মানুষের দৈনন্দিন জীবন ও কাজকর্মের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। বাণিজ্যিক লেনদেন, উপাসনালয় ও গৃহনির্মাণ, কৃষিজমি ভাগাভাগি, কৃষিপণ্যের হিসাব-নিকাশ, যুদ্ধের সময় সেনাদের রসদের হিসাব রাখা প্রভৃতি কাজে ইলামি যুগে গণিতের ব্যাপক ব্যবহার ছিল। শুশ অঞ্চলে প্রত্নতাত্বিক খননকাজে এ পর্যন্ত যেসব নিদর্শন উদ্ধার করা হয়েছে তার মধ্যে তিন হাজার ৪০০ বছর আগে তৈরি কিছু মাটির ফলক পাওয়া গেছে যেখানে সেই যুগে জ্যামিতি ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
শুশ অঞ্চলে প্রত্নতাত্বিক খনন কাজ চালিয়ে প্রাপ্ত নিদর্শনের মাধ্যমে তৎকালীন যুগে গণিত ব্যবহারে যে সামান্য প্রমাণ পাওয়া গেছে তাতে বোঝা যায় তখনকার ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব বা পুরোহিতদের বেশিরভাগই ছিলেন গণিতে পারদর্শী। প্রাপ্ত নিদর্শনে শুধু যে সংখ্যা ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে তাই নয় একই সাথে মৌলিক গণিতের তাত্বিক সমাধানে পৌঁছানোরও প্রমাণ পাওয়া গেছে। এমনও প্রমাণ পাওয়া গেছে ইলামিরা বিভিন্ন আকৃতির ত্রিভুজ ও বহুভুজের সাথেও পরিচিত ছিল। অর্থাৎ তারা জ্যামিতির নিয়ম কানুন সম্পর্কে অবহিত ছিলেন।
যদিও খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ ও সপ্তম শতাব্দিতে ইলামিদের তাত্বিক গণিত শাস্ত্রে অগ্রগতির প্রমাণ পাওয়া যায়নি কিন্তু ভবন নির্মাণশৈলী থেকে তাদের আধুনিক জ্যামিতিজ্ঞানের প্রমাণ পাওয়া যায়। এ ছাড়া, ওই যুগে জ্যোতির্বিদ্যা ও সংগীত শিল্পেও বেশ অগ্রগতি লাভ করেছিল যা থেকে ইলামিদের মধ্যে গণিতের ব্যাপক ব্যাবহার ও গুরুত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়।
যাইহোক, প্রাচীন ইরানের ইলাম সভ্যতা গড়ে উঠেছিল কারুন নদীর অববাহিকায়। নদীটির উৎপত্তি খুজিস্তানের জারদ কুহ পাহাড়ে। ৪৫০ মাইল দীর্ঘ কারুন নদীটি ইরানের একমাত্র নৌ-চলাচলযোগ্য নদী। হিব্রু বাইবেলে এই নদীর নাম 'গিহন'। যে চারটে নদীর কথা হিব্রু বাইবেলে বর্ণিত হয়েছে তার মধ্যে গিহন বা কারুন ছিল একটি। এ ছাড়া, হিব্রু বাইবেলে ইলাম শব্দটিও রয়েছে। ইলামিয়রা কথা বলত অ-সেমেটিক ভাষায়। কারুন নদীর অববাহিকায় পরিশ্রমী মানুষ কৃষির উদ্বৃত্ত থেকে গড়ে তোলে নগর, গড়ে তোলে ইলাম সভ্যতা। ইলাম সভ্যতার অন্যান্য নগরগুলি হল আওয়ান, সিমাশ, মাডাকটু এবং ডার-উনটাশ।
ইলাম সভ্যতায় 'কিরিরিশা' নামে দেবীর কথা জানা যায়। সম্ভবত উর্বরতার দেবী ছিলেন কিরিরিশা। সেখানে অসংখ্য কিরিরিশা দেবীর উপাসনালয় গড়ে উঠেছিল। কালের গ্রাসে সেসব আজ বিলীন হয়ে গেছে। এ ছাড়া, ইলামিয় পানপাত্র পরবর্তীকালে পারস্যের শিল্পরীতিকে প্রভাবিত করেছিল#
পার্সটুডে/রেজওয়ান হোসেন/মো.আবুসাঈদ/০৪
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।