আগস্ট ১৪, ২০২২ ১৮:০৫ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা জারিয়াতের সংক্ষিপ্ত তাফসির। মক্কায় অবতীর্ণ এ সূরায় পার্থিব জীবন ও পরকাল, সৃষ্টজগতে আল্লাহ তায়ালার অস্তিত্বের নির্দশন, কয়েকজন নবীর কাহিনী এবং পথভ্রষ্ট কিছু জাতির পরিণতি বর্ণনা করা হয়েছে। এই সূরার ৪৭ থেকে ৪৯ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

وَالسَّمَاءَ بَنَیْنَاهَا بِأَیْدٍ وَإِنَّا لَمُوسِعُونَ ﴿٤٧﴾ وَالأرْضَ فَرَشْنَاهَا فَنِعْمَ الْمَاهِدُونَ ﴿٤٨﴾ وَمِنْ کُلِّ شَیْءٍ خَلَقْنَا زَوْجَیْنِ لَعَلَّکُمْ تَذَکَّرُونَ ﴿٤٩﴾

“আর আমি আসমান নির্মাণ করেছি আমার বর্ণনাতীত ক্ষমতা বলে এবং আমি [সারাক্ষণ] এটির সম্প্রসারণ করছি। ”(৫১:৪৭)

“আর আমি জমিনকে বিছিয়ে দিয়েছি। আমি কতই না সুন্দর (সমতল) প্রসারণকারী!” (৫১:৪৮)

“আর আমি প্রত্যেক বস্তু সৃষ্টি করেছি জোড়ায় জোড়ায়, যাতে তোমরা উপদেশ [ও শিক্ষা] গ্রহণ কর।” (৫১:৪৯)

এই আয়াতগুলোতে আসমান ও জমিন এবং এ দুইয়ের মধ্যবর্তী সবকিছু সৃষ্টিতে আল্লাহর বর্ণনাতীত ক্ষমতার কথা আবার উল্লেখ করা হয়েছে। যারা পরকালকে বিশ্বাস করে না তাদের সংশয় দূর করার লক্ষ্যে আল্লাহ তায়ালা বিষয়টিকে এভাবে বর্ণনা করেছেন। প্রথমেই তিনি আসমানের বিশালত্ব তুলে ধরে বলছেন, তোমরা তোমাদের মাথার উপরে যে তারকারাজি ও ছায়াপথ দেখতে পাও তার সংখ্যা ও আয়তন প্রতি মুহূর্তে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তোমাদের পক্ষে এসবের শুরু এবং শেষ নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। আর এ বিষয়টি আল্লাহর অসীম ক্ষমতার অন্যতম জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ। এখানে আল্লাহ তায়ালা সুস্পষ্ট করে বলছেন যে, আসমানের পরিধি অনবরত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আধুনিক যুগের বিজ্ঞানীরাও একথার প্রমাণ পেয়েছেন যে, বিশ্বজগত থেমে নেই বরং প্রতিনিয়ত সম্প্রসারিত হচ্ছে। তারা বলছেন, ছায়াপথের নক্ষত্রগুলো প্রতি মুহূর্তে প্রচণ্ড গতিতে এগুলোর কেন্দ্র থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।

অবশ্য বিজ্ঞানীরা মনে করেন, বিশ্বজগতের সম্প্রসারণের অর্থ হচ্ছে এর একটি শুরু ছিল এবং সেখান থেকে সম্প্রসারিত হতে হতে এই জগত বর্তমান অবস্থায় পৌঁছেছে। পরবর্তী আয়াতে বলা হচ্ছে, শুধুমাত্র মাথার উপরের আসমান নয় সেইসঙ্গে তোমাদের পায়ের নীচের জমিনও আল্লাহ তায়ালা এমনভাবে বিছিয়ে রেখেছেন যাতে তোমরা বসবাস, কৃষিকাজ ও পশুপালনসহ অন্যান্য সব কাজ করতে পারো। অন্য কথায়, পৃথিবীর বুকে আল্লাহর মেহমান মানুষ যাতে স্বাচ্ছন্দে সব কাজ করতে পারে তার ব্যবস্থা তিনি এখানে করে রেখেছেন।

এখানে উদাহরণ হিসেবে ভূপৃষ্ঠের জীবজগতের বেঁচে থাকার জন্য বায়ুমণ্ডলের ভূমিকার কথা স্মরণ করা যেতে পারে। এই বায়ুমণ্ডল সূর্যের তাপমাত্রাকে নিজের মধ্যে ধরে রাখে যার ফলে রাত যেমন প্রচণ্ড ঠাণ্ডা হয়ে যায় না তেমনি দিনের বেলাও গরম অসহনীয় হয়ে ওঠে না। এছাড়া, আসমান থেকে আসা বিশালাকৃতির পাথরের হাত থেকেও পৃথিবীতে বসবাসকারী প্রাণী ও উদ্ভিদের প্রাণ রক্ষা করে এই বায়ুমণ্ডল। পৃথিবীর দিকে প্রচণ্ড গতিতে ধেয়ে আসা বিশাল বিশাল উল্কাপিণ্ড বায়ুমণ্ডলের সংস্পর্শে আসার সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরিত হয়ে ধ্বংস হয়ে যায়।

আসমান ও জমিন সৃষ্টির প্রসঙ্গ শেষ হওয়ার পর এই দুইয়ের মধ্যবর্তী বিভিন্ন সৃষ্টি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। মহান আল্লাহ সব জীবকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন যাতে এগুলোর অস্তিত্ব বংশ পরম্পরায় টিকে থাকে। আমরা শুধুমাত্র মানুষসহ অন্যান্য প্রাণীকে জোড়ায় জোড়ায় দেখত পেলেও এই আয়াত অনুযায়ী অন্য সব বস্তুও আল্লাহ তায়ালা জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন। আর এসব বর্ণনা করে আল্লাহ বলছেন, সৃষ্টির এত বৈচিত্র দেখার পর হয়তো তোমরা আমার প্রতি ঈমান আনবে এবং গোয়ার্তুমি ও দাম্ভিকতা পরিহার করবে।

এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় কয়েকটি বিষয় হচ্ছে:

১- বিশ্বজগত এক জায়গায় স্থির নয় বরং প্রতিনিয়ত নড়াচড়া করছে এবং এর আকার ও আয়তন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

২- শুধুমাত্র মানুষ, প্রাণী ও গাছপালা নয় সেইসঙ্গে জড় পদার্থও আল্লাহ তায়ালা জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন।

৩- প্রাকৃতিক বিষয়াদির সঙ্গে পরিচিত করানোর জন্য পবিত্র কুরআন নাজিল হয়নি ঠিকই কিন্তু মানুষের সামনে থেকে অজ্ঞতার অন্ধকার দূর করে তাকে আলোর পথ দেখানোর জন্য কিছু প্রাকৃতিক নিদর্শন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া হয়েছে; যাতে মানুষ আল্লাহ তায়ালার মহাশক্তি সম্পর্কে কিছুটা ধারনা লাভ করতে পারে।

সূরা জারিয়াতের ৫০ থেকে ৫১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

فَفِرُّوا إِلَى اللَّهِ إِنِّی لَکُمْ مِنْهُ نَذِیرٌ مُبِینٌ ﴿٥٠﴾ وَلا تَجْعَلُوا مَعَ اللَّهِ إِلَهًا آخَرَ إِنِّی لَکُمْ مِنْهُ نَذِیرٌ مُبِینٌ ﴿٥١﴾

“অতএব তোমরা আল্লাহর দিকে ছুটে পালাও, নিশ্চয় আমি তোমাদের প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে এক স্পষ্ট সতর্ককারী।” (৫১: ৫০)

“আর তোমরা আল্লাহর সাথে কোন ইলাহ স্থির করো না; আমি তোমাদের প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত এক স্পষ্ট সতর্ককারী।”  (৫১: ৫১)

আগের আয়াতগুলোর ধারাবাহিকতায় এই আয়াতে রাসূলে পাক (সা.)কে কাফির ও মুশরিকদের এই বলে সতর্ক করতে বলা হচ্ছে যে, বিশ্বজগত সৃষ্টি বা এর পরিচালনায় আল্লাহর সঙ্গে কোনো শরীক স্থাপন করো না।  মাটি, কাঠ বা পাথরের তৈরি মূর্তিগুলো থেকে ছুটে পালাও এবং আল্লাহর কাছে আশ্রয় নাও। তাহলে তোমরা জীবনের আসল ঠিকানা খুঁজে পাবে এবং শিরক ও কুফরের মন্দ পরিণতি থেকে রক্ষা পাবে।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:                               

১- সম্পদ, ক্ষমতা কিংবা বন্ধু-বান্ধব কেউই মানুষের জন্য নিরাপদ আশ্রয় হতে পারে না। মানুষের জন্য একমাত্র নিরাপদ ভরসাস্থল হচ্ছেন আল্লাহ তায়ালা। কাজেই আমাদের উচিত সকল কাজে একমাত্র তাঁর ওপর নির্ভর করা।

২- মানুষকে একত্ববাদ ও সৎকাজের প্রতি দাওয়াত দেওয়ার পাশাপাশি তাদেরকে শিরক মিশ্রিত বিশ্বাস ও মন্দ কাজের পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করাও নবী-রাসূলগণের দায়িত্ব।

সূরা জারিয়াতের ৫২ থেকে ৫৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

کَذَلِکَ مَا أَتَى الَّذِینَ مِنْ قَبْلِهِمْ مِنْ رَسُولٍ إِلا قَالُوا سَاحِرٌ أَوْ مَجْنُونٌ ﴿٥٢﴾ أَتَوَاصَوْا بِهِ بَلْ هُمْ قَوْمٌ طَاغُونَ ﴿٥٣﴾

“[হে রাসূল!] এভাবে [তারা যেমনভাবে আপনাকে অস্বীকার করেছে তেমনিভাবে] তাদের পূর্ববর্তীদের কাছেও যখনই কোন রাসূল এসেছেন তখনই তারা বলেছে, [সে] তো এক জাদুকর, না হয় এক উন্মাদ!”  (৫১: ৫২)

“তারা কি [ইতিহাসের যুগে যুগে] একে অপরকে এ মন্ত্রণাই দিয়ে এসেছে [যে, নবীদের সঙ্গে এমন আচরণ করবে? না!] বরং এরা সীমালঙ্ঘনকারী সম্প্রদায়।” (৫১: ৫৩)

গত আসরে আমরা দেখেছি যে, ফেরাউন হযরত মূসা (আ.)-এর চারপাশ থেকে তাঁর অনুসারীদের সরিয়ে দিতে তাঁকে উন্মাদ বলে অপবাদ দিয়েছে। আজকের এই আয়াতে বলা হচ্ছে: শুধুমাত্র হযরত মূসার প্রতিই তারা অপবাদ দেয়নি বরং যুগে যুগে সর্বকালে সব নবীর প্রতি এ ধরনের অপবাদ দিয়েছে কাফির ও মুশরিকরা।

ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে কাফিরদের এই আচরণ এতটা সাদৃশ্যপূর্ণ ছিল যে, কেউ চিন্তা করলে ভাববে এরা বুঝি একদল আরেক দলকে এই মন্ত্রণা দিয়ে গিয়েছিল যে, সবাই যেন নবীদের উন্মাদ ও যাদুকর বলে প্রত্যাখ্যান করে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বিষয়টি এমন ছিল না বরং সব যুগের কাফিরদের মধ্যে একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল। আর তা হলো  মহাসত্যের সামনে দাম্ভিকতা ও গোয়ার্তুমি। এ কারণে তারা সত্য গ্রহণকারী মানুষগুলোকে বিপথগামী করার জন্য এ ধরনের গর্হিত আচরণ করত। তারা নবীদেরকে হত্যা করার সাহস না পেলেও তাঁদের ব্যক্তিত্বকে ধুলায় মিশিয়ে দেয়ার চেষ্টায় তারা কোনো কার্পণ্য করত না।

এই দুই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- শত্রুদের গালিগালাজ ও কটুক্তিকে ভয় পেয়ে দ্বীন প্রচারের কাজে পিছু হটা যাবে না। মনে রাখতে হবে, যুগে যুগে খোদ নবী-রাসূলগণ এমন আচরণের শিকার হয়েছেন।

২- মনুষ্যত্বের সীমারেখা অতিক্রম করে ফেললে মানুষ নবী-রাসূলদের বিরোধিতা করতেও কুণ্ঠিত হয় না। এমনকি আল্লাহর প্রেরিত পুরুষদের যাদুকর বা উন্মাদ বলতেও তাদের এতটুকু গলা কাঁপে না।#

পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ১৪

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ