আগস্ট ১৬, ২০২২ ১৮:২৬ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র সূরা তূরের সংক্ষিপ্ত তাফসির। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর হিজরতের পূর্বে মক্কায় অবতীর্ণ এই সূরায় পরকাল এবং মৃত্যু পরবর্তী জগতে সৎকর্মপরায়ণ ও গোনাহগার ব্যক্তিদের পরিণতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। এই সূরার ২২ থেকে ২৪ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

وَأَمْدَدْنَاهُمْ بِفَاکِهَةٍ وَلَحْمٍ مِمَّا یَشْتَهُونَ ﴿٢٢﴾ یَتَنَازَعُونَ فِیهَا کَأْسًا لا لَغْوٌ فِیهَا وَلا تَأْثِیمٌ ﴿٢٣﴾ وَیَطُوفُ عَلَیْهِمْ غِلْمَانٌ لَهُمْ کَأَنَّهُمْ لُؤْلُؤٌ مَکْنُونٌ ﴿٢٤﴾

“আর আমি তাদেরকে একের পর এক দিতে থাকব ফলমূল এবং গোশত যা তারা কামনা করবে।”(৫২:২২)

“সেখানে তারা একে অপরের নিকট হতে গ্রহণ করবে মদ ভরা পান-পাত্র, যা হতে [পান করলে] কেউ অসার কথা বলবে না এবং পাপ কর্মেও লিপ্ত হবে না।” (৫২:২৩)

“আর তাদের [সেবায়] কিশোরেরা তাদের আশপাশে ঘোরাফেরা করবে; তারা [হবে] ঝিনুকে সুরক্ষিত মুক্তা সদৃশ।” (৫২:২৪)

গত আসরে আমরা জান্নাতের অফুরন্ত নেয়ামতের কথা তুলে ধরেছিলাম। সেই আলোচনার জের ধরে এই আয়াতগুলোতে জান্নাতের কিছু খাবার ও পানীয়ের কথা উল্লেখ করে বলা হচ্ছে: জান্নাতে রয়েছে নানা রকমের ফলমূল এবং জান্নাতবাসী যখনই যে ফল খেতে চাইবে তাকে সে ফলই দেয়া হবে। অথচ পার্থিব জীবনে পৃথিবীর সব অঞ্চলে সব ফল পাওয়া যায় না এবং সব ঋতুতেও সব ফলের দেখা মেলা ভার। এছাড়া, আকাশের উড়ন্ত পাখি, নদীর মাছ কিংবা মাঠে চড়ে বেড়ানো পশু- জান্নাতবাসী যে কারো গোশত খেতে চাইবে তার সামনে সেই গোশত হাজির করা হবে।

স্বাভাবিকভাবে খাবারের পাশাপাশি পানীয়েরও প্রয়োজন হবে। জান্নাতে এমন মদের ব্যবস্থা রয়েছে যা জান্নাতবাসী একে অন্যের সঙ্গে বিনিময় করবে। এই পানীয় খেয়ে তারা পরম তৃপ্তি লাভ করবে কিন্তু পার্থিব জীবনের মদের মতো ওই পানীয় খেলে মানুষ অসার কথা বলবে না কিংবা পাপকর্মে লিপ্ত হতে চাইবে না। সেইসঙ্গে জান্নাতবাসীর সেবা করার জন্য থাকবে সুদর্শন কিশোরেরা। তারা চাহিবামাত্র যেকোনো জিনিস মুহূর্তের মধ্যে হাজির করে দেবে।

এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে:

১- জান্নাতের অধিবাসীদের জন্য তাদের চাহিদা অনুযায়ী সব রকম খাবার ও পানীয়ের ব্যবস্থা থাকবে এবং সেখানে তাদের কোনো কিছুই একঘেয়ে মনে হবে না।

২- জান্নাতের শরাবে পার্থিব জগতের মদের মতো ক্ষতিকর কিছু নেই।  জান্নাতবাসী যে পানীয় খাবে তাতে তাদের মাতাল হয়ে যাওয়া বা খারাপ কাজ করার স্পৃহা সৃষ্টি হওয়ার কোনো আশঙ্কা থাকবে না।

সূরা তূরের ২৫ থেকে ২৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

وَأَقْبَلَ بَعْضُهُمْ عَلَى بَعْضٍ یَتَسَاءَلُونَ ﴿٢٥﴾ قَالُوا إِنَّا کُنَّا قَبْلُ فِی أَهْلِنَا مُشْفِقِینَ ﴿٢٦﴾ فَمَنَّ اللَّهُ عَلَیْنَا وَوَقَانَا عَذَابَ السَّمُومِ ﴿٢٧﴾ إِنَّا کُنَّا مِنْ قَبْلُ نَدْعُوهُ إِنَّهُ هُوَ الْبَرُّ الرَّحِیمُ ﴿٢٨﴾

“আর তারা একে অপরের মুখোমুখি হয়ে [পরস্পরের খবরাখবর] জিজ্ঞাসাবাদ করবে।” (৫২:২৫)

“তারা বলবে, নিশ্চয় আমরা আগে [পার্থিব জীবনে] নিজেদের পরিবার-পরিজনের হিতাকাঙ্ক্ষী ছিলাম [এবং পরিবারের সদস্যদেরকে ঐশী আজাবের ব্যাপারে সতর্ক করতাম]।” (৫২:২৬)

“অতঃপর আমাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন এবং আমাদেরকে আগুনের শাস্তি থেকে রক্ষা করেছেন।” (৫২:২৭)

“কারণ, আমরা আগে [পার্থিব জগতে] সব সময় আল্লাহকে ডাকতাম, নিশ্চয় তিনি কৃপাময়, পরম দয়ালু।”(৫২:২৮)

এই আয়াতগুলোতে জান্নাতবাসীর পরস্পরের সঙ্গে কথোপকথন তুলে ধরা হয়েছে। তারা পরস্পরকে একথা জিজ্ঞাসা করবে যে, পৃথিবীতে তারা কি কি ভালো কাজ করেছে যার বিনিময়ে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে জান্নাত দান করেছেন? এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জবাব হবে তারা তাদের পরিবারের সদস্যদের পরিণতি নিয়ে সব সময় উদ্বেগে থাকত। তারা পিতা-মাতা, স্বামী-স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততির প্রতি নিজেদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করত এবং সারাক্ষণ তাদের চেষ্টা থাকত পরিবারের কেউ যেন বিপথগামী হয়ে না যায়। তারা শুধু নিজেদেরকে পাপ কাজ থেকে বিরত রাখেনি বরং সন্তানরাও যাতে মুমিন ও নেককার হয়ে ওঠে সেই চেষ্টা করেছে। স্বাভাবিকভাবেই এ ধরনের মানুষকে আল্লাহ তায়ালা পছন্দ করেন। এ ধরনের পরিবারকে আল্লাহ জান্নাতে একত্রে থাকার ব্যবস্থা করবেন এবং তাদের সবাইকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করবেন।

এই চার আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে:

১- জান্নাত ও জাহান্নামে যাওয়ার বিষয়টি আমাদের নিজেদের ওপর নির্ভর করছে। পার্থিব জগতে আমাদের ঈমান ও কর্ম আমাদেরকে ওই দুই স্থানের যেকোনো এক জায়গায় নিয়ে যাবে।

২- পরিবারের সদস্যদের প্রতি বিশেষভাবে দৃষ্টি দিলে সন্তান সঠিকভাবে বেড়ে ওঠে। আর এটাই জান্নাতের চাবিকাঠি। সন্তানদের পারলৌকিক কল্যাণ কামনায় চেষ্টা করলে পিতামাতা ও সন্তান উভয়ই জান্নাতে যাওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করে।

৩- জান্নাতবাসী জান্নাতকে তাদের প্রতি আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহ মনে করে। তারা তাদের আমলের গুণে জান্নাত পেয়েছে বলে মনে করে না কারণ, তারা যেসব নেক কাজ করেছে তার তুলনায় লক্ষ-কোটি গুণ বেশি অনুগ্রহ আল্লাহ তাদেরকে জান্নাতে করবেন।

সূরা তূরের ২৯ থেকে ৩১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:

فَذَکِّرْ فَمَا أَنْتَ بِنِعْمَةِ رَبِّکَ بِکَاهِنٍ وَلا مَجْنُونٍ ﴿٢٩﴾ أَمْ یَقُولُونَ شَاعِرٌ نَتَرَبَّصُ بِهِ رَیْبَ الْمَنُونِ ﴿٣٠﴾ قُلْ تَرَبَّصُوا فَإِنِّی مَعَکُمْ مِنَ الْمُتَرَبِّصِینَ ﴿٣١﴾

“অতএব [হে রাসূল!] আপনি [মানুষকে] উপদেশ দিতে থাকুন, কারণ, আপনার রবের অনুগ্রহে আপনি গণক নন এবং উন্মাদও নন।” (৫২:২৯)

“[বরং] কাফেররা বলতে চায় যে, ‘সে একজন কবি। আমরা তার জন্য কালের বিপর্যয় [বা মৃত্যুর] প্রতীক্ষা করছি। (৫২:৩০)

“[আপনি তাদের] বলে দিন: বল, তোমরা প্রতীক্ষা কর, আমিও তোমাদের সাথে প্রতীক্ষা করছি। [অর্থৎ তোমরা আমার মৃত্যুর জন্য এবং আমি তোমাদের ওপর বিজয়ী হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছি।” (৫২:৩১)

আগের আয়াতগুলোতে জান্নাতের পরিবেশ বর্ণনা করার পর এই তিন আয়াতে মহান আল্লাহ তাঁর রাসূলকে উদ্দেশ করে বলছেন: মানুষের সামনে হেদায়েতের বাণী তুলে ধরতে থাকুন এবং তাদেরকে পরকালের ভয়াবহ আজাবের কথা স্মরণ করিয়ে দেন।  তাদেরকে বিচার দিবসের ভয়াবহতা সম্পর্কে জানান। পার্থিব জীবনে আল্লাহকে ভুলে গিয়ে বান্দারা যেন উদাসীনতার জীবন যাপন না করে। কিন্তু কাফিররা রাসূলের এই নমনীয় আচরণের কারণে একথা বলে বেড়াত যে, সে একজন গণক এবং এজন্য ভবিষ্যত সম্পর্কে যেকোনো কিছু ঠিকঠাক বলে দিতে পারে। জ্বিনের সঙ্গে তার সম্পর্ক রয়েছে এবং ভবিষ্যতের খবরাখবর জ্বিনদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে।  অথচ আল্লাহ তায়ালা এই আয়াতে বলছেন: রাসূল ভবিষ্যত সম্পর্কে যেসব কথা বলেন তা তাকে ওহীর মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হয়। তিনি গণক বা জ্বিনকে বশীভূত করা কোনো মানুষ নন। তিনি একইভাবে কবি বা সাহিত্যিকও নন। তার বাণী-বক্তব্য সরাসরি আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজিল করা হয়।

এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হলো:

১- যুগে যুগে কাফের ও মুশরিকরা নবী-রাসূলদেরকে কবি বা গণক বলে অপবাদ দিত যাতে সাধারণ মানুষ ঐশী বার্তাবাহকদের ধারেকাছে না যায়।

২- ইসলামের শত্রুরা আশা করেছিল, রাসূলের ওফাতের সঙ্গে সঙ্গে ইসলামের দ্বীপশিখা নিভে যাবে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা ছিল এই দ্বীপশিখা চিরকাল সমুজ্জ্বল থাকবে। আজও আমরা দেখতে পাই ইসলামের বিরুদ্ধে নানামুখী ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও এটি ক্রমপ্রসারমান একটি ধর্ম।#

পার্সটুডে/এমএমআই/আবুসাঈদ/ ১৬

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ