প্রাচীন গ্রিসের দেয়াল ছবি বা নক্সায় নারী হয় নর্তকী কিংবা খোদা তথা দেবিদের ভূমিকায় আসীন
নারী: মানব ফুল-৩ (প্রাচীন গ্রিসের নারী)
প্রাচীন গ্রিসে নারীর অবস্থা সম্পর্কে আমরা গত দুই অনুষ্ঠানে আলোচনা করেছি। আমরা জেনেছি যে এথেন্সের লোকেরা নারীদেরকে বাজারের অন্যান্য পণ্যের মতই কিনত ও বিক্রি করত খুব কম মূল্যে!
নারীদেরকে চতুষ্পদ জন্তুর মত উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বণ্টন করা হত এবং ওসিয়ত বা উইলের মাধ্যমে তাদেরকে অন্য কারো কাছেও কখনও কখনও হস্তান্তর করা হত। গ্রিক মেয়েদের বয়স ১৩ বা ১৪ বছর হলেই তারা পিতার নির্বাচিত কোনো এক ব্যক্তিকে বিয়ে করতে বাধ্য হত এবং ওই ব্যক্তির কাছ থেকে পিতাই যৌতুক হিসেবে অর্থ আদায় করত। এই অর্থ গ্রহণের মাধ্যমে ওই ব্যক্তি স্ত্রীর খরচ যোগাতে সক্ষম কিনা তাও বোঝা যেত। আর যে মেয়ের বাবা জীবিত থাকতো না তার নানা স্বার্থ, বিয়ে ও সম্পদের বিষয়গুলো দেখতেন কোনো এক পুরুষ নিকট-আত্মীয় বা চাচা। নারীরা বিবাহিত হবেন এটাই ছিল সবার প্রত্যাশা। সে যুগের সমাজ জীবনে কুমারি কোনো নারীর ভূমিকা বা অধিকারের স্বীকৃতি দেখা যায়নি। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের গ্রিক নাট্যকার ও লেখক ইউরিপিডিস তার মিডা নামের বইয়ে লিখেছেন, শিশুকে যদি নারী ছাড়া জন্ম দেয়া সম্ভব হত তাহলে নারীবিহীন মানব সমাজ সব দুর্ভাগ্য থেকে মুক্তি পেত!
গ্রিকদের অনেক খোদাই ছিল নারী! প্রাচীন গ্রিসের যেসব ঐতিহাসিক নিদর্শন দেখা যায় সেসব থেকে যেমন ফুলদানি, পোড়া মাটির পাত্র ও ভাস্কর্যে এইসব নারী দেবির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও প্রশংসা ফুটে ওঠে। খ্রিস্টপূর্ব যুগের প্রাচীন গ্রিক কবি হোমারের কবিতায়ও এ বিষয়টি স্পষ্ট। বুদ্ধিমত্তা ও প্রজ্ঞা বিষয়ের গ্রিক দেবি আথেনাকে অনেক মহতী গুণের অধিকারী যেমন, অত্যন্ত বুদ্ধিমতী, সাহসি ও ভদ্র বা সভ্রান্ত হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। বেশিরভাগ গ্রিক নাগরিক ছিলেন কৃষিজীবী। তাদের দৃষ্টিতে ডিমিটার ছিলেন উর্বরতা ও বেশি ফলন দেয়ার দেবী। আর পার্সিফোনিস ছিলেন মৃতদের ও পরকালীন জগতের ঈশ্বরের স্ত্রী হিসেবে অত্যন্ত পবিত্র অস্তিত্ব!
প্রাচীন গ্রিসের যেসব দেয়াল ছবি বা নক্সা আজও টিকে আছে সেসবেও দেখা যায় নারী হয় নর্তকী বা অশালীন ভূমিকায় কিংবা খোদা তথা দেবিদের ভূমিকায় আসীন এবং গ্রিকরা তাদের জন্য নিয়ে আসছে উপহার ও কুরবানির সামগ্রী। সাধারণ গ্রিক নারীর কোনো ছবি এইসব স্থাপত্যে খুব কমই দেখা যায়। এ ধরনের কোনো নারীর ছবি থাকলেও তাকে কৃষিকাজে ব্যস্ত দেখা যায়। মোট কথা প্রাচীন যুগের বেশিরভাগ গ্রিকদের দৃষ্টিতে নারী ছিল কেবলই পুরুষের ভোগ-বিলাসের সামগ্রী তথা যৌনদাসী। পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো থেকে জানা যায় গ্রিক নারীকে ঘরের বাইরে যেতে দেয়া হলেও তাকে দিয়ে পরিবারের অর্থনৈতিক কোনো চাহিদা মেটানোর জন্যই ওই অনুমতি দেয়া হত। গ্রিক নারীদের বেশিরভাগ সময়ই কাটতো কৃষিকাজে ও গ্রাম্য খামারের নানা কাজে। বিবাহিতা নারীদের কেউ কেউ ঘরে বুননের কাজ করত ও কেউবা সন্তান প্রতিপালনে ব্যস্ত থাকত। বিবাহিতা গ্রিক নারীরা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশ নিতে ঘরের বাইরে যেতে পারত।
প্রাচীন গ্রিসে অস্থায়ী বিয়ের প্রচলনও ছিল। সেইসব নারীই অস্থায়ী বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হত যারা ছিলেন বিধবা, দাসী অথবা বাবা-মায়ের পক্ষ থেকে পরিত্যক্ত হওয়ায় পতিতাবৃত্তির শিকার হওয়া কন্যারা। এই শ্রেণীর নারীদের সামাজিক কোনো অধিকার ও গুরুত্ব ছিল না। এরা সমাজে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াত। গ্রিক সমাজে হিতায়েরা নামের এক শ্রেণীর নারী এদের চেয়ে কিছুটা উন্নত অবস্থা ও সামান্য সামাজিক স্বীকৃতির অধিকারী ছিল। এরা বেশি অর্থের বিনিময়ে পুরুষের সঙ্গী হত। পুরুষরা তাদেরকে উৎসবের সময় সঙ্গী করত। যৌন-সঙ্গী হওয়া ছাড়াও তারা সামাজিক ও চিন্তাগত বিষয়েও পুরুষের সহযোগী হত। তবে এদেরও কোনো উল্লেখযোগ্য সামাজিক মর্যাদা বা অধিকার ছিল না যদিও তারা কখনও কখনও স্ত্রীর ভূমিকায় শরিক হত। এদেরও নাগরিক অধিকার বলেও কিছু ছিল না। এরাও সমাজে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াত এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নাচ ও গানের মত শিল্প চর্চায় এদের অংশগ্রহণ দেখা যেত। দর্শন ও চিন্তাগত বিষয়েও এদের একটা অবস্থান ছিল। গ্রীসে নারী দাসীদের বেশিরভাগই ছিল যুদ্ধ-বন্দী! তাদেরও কোনো অধিকার ছিল না বরং তারা ছিল মালিকদের হুকুমের গোলাম।
গ্রিসের অবস্থাসম্পন্ন ঘরগুলোর নারীরা ঘরের বাইরে কাজ করতেন না। স্বামীরাই তাদের খরচ যোগাতেন। তারা ঘরে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ, সুতা ও কাপড় বুনন এবং ঘরের লোকদের জন্য পোশাক তৈরির কাজ করতেন। আর্থিক সঙ্গতি থাকলে তারা দাসীও রাখতেন এবং এতে তাদের কাজের চাপ কমে যেত। দরিদ্র ঘরের নারীরা দাসী কেনার সামর্থ্য না থাকায় নিজেরাই কাজ করতেন। তারা কৃষি খামারে বা দোকানে পুরুষের পাশাপাশি কাজ করতেন। তাদের কেউ কেউ কাপড় বিক্রি করতেন ও কেউ কেউ ফল বাগানে ফল পাড়ার কাজও করতেন। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের গ্রিক নাট্যকার এরিস্টোফেনের লেখায় সে যুগের গ্রিক নারীদেরকে সরাইখানা বা আবাসিক হোটেলের কর্মী, নৈশ-নার্স, রাঁধুনি এবং সবজি, মধু, সুগন্ধি ও অন্যান্য জিনিষের বিক্রেতার ভূমিকায় দেখা গেছে।
পার্সটুডে/এমএএইচ/০৮
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।