'ঈমানের অর্ধেক হল আমানতদারী, বাকি অর্ধেক পাপ বর্জন'
রমজান: খোদাপ্রেমের অনন্য উৎসব (পর্ব-১২)
খোদা-সচেতনতা বা তাকওয়া অর্জন রোজার প্রধান লক্ষ্য।
তাই বিগত বেশ কয়েক দিনের আলোচনায় আমরা খোদা-সচেতনতা অর্জনের উপায় হিসেবে পবিত্র কুরআনের আলোকে খোদা-সচেতন ব্যক্তির নানা বৈশিষ্ট্য এবং মহান আল্লাহর নানা গুণ বা বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কিছু কথা বলেছি। আমরা জেনেছি তাকওয়া অর্জনের লক্ষ্যে মহান আল্লাহর নানা গুণের রঙ্গে রঙ্গিন হতে তাঁর বিখ্যাত নামগুলো বা আসমায়ুল হুসনা সম্পর্কে ধারণা থাকাও জরুরি। আর তাই আমরা মহান আল্লাহর বিখ্যাত নাম আল আবক্বা ও আলআমিন তাৎপর্য নিয়েও কিছু কথা বলেছি।
মহান আল্লাহর আল আমিন নামের রঙ্গে রঙিন হতে হলে আমাদেরকে তাঁর বিধি-বিধানগুলো মেনে চলার ব্যাপারে একনিষ্ঠ হতে হবে। যে কোনো ক্ষেত্রে নিজের পছন্দ বা খেয়ালখুশি মোতাবেক নয় বরং মহান আল্লাহ যা হালাল ও হারাম করেছেন তার সীমানা নির্দ্বিধায় মেনে নিয়ে সেই মোতাবেক আচরণ করতে হবে। ইসলাম মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে মানুষকে বিশ্বস্ত বা আমিন করতে চায়।
মানুষ যখন হবে পরস্পরের প্রতি বিশ্বস্ত তখনই তাদের পারস্পরিক সালাম হবে অর্থবহ। একে অপরকে সালাম দেয়ার মানে হল তারা পরস্পরের জন্য সবক্ষেত্রেই নিরাপদ ও বিশ্বস্ত। অথচ আমরা একে-অপরকে সালাম দিয়েও অনেক সময় এই ভয়ে ভীত থাকি যে এই ব্যক্তি আমার কোনো ক্ষতি করতে পারে এবং এখনই হয়তো আমার ব্যাপারে কোনো খারাপ কথা বলবে। অর্থাৎ আমরা একে অপরকে বিশ্বাস করতে পারছি না, বিশ্বস্ত মনে করতে পারছি না!
মহানবী -সা. যখন মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করতে রওনা হন তখন তিনি তাঁর কাছে থাকা মানুষের আমানতগুলো ফেরত দিতে আমিরুল মু'মিনিন হযরত আলীকে দায়িত্ব দেন। আমানত রক্ষার গুরুত্ব হযরত আলী খুব ভালোভাবে বুঝতেন বলেই তিনি তাঁকে এ দায়িত্ব দিয়েছিলেন। হযরত আলীর নাতি ইমাম যাইনুল আবেদিন (আ) বলেছেন, আমিরুল মুমিনিন হযরত আলীর হত্যাকারীও যদি আমার কাছে কোনো কিছু আমানত রাখে তাহলে আমি আমার জীবন দিয়ে হলেও সেই আমানত রক্ষা করব!
হযরত ইমাম রেজা (আ) আব্বাসীয় শাসক মামুনকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন, ঈমানের অর্ধেক হল আমানত যথাযথভাবে ফিরিয়ে দেয়া এবং বাকি অর্ধেক হল পাপ বর্জন করা। - আমাদের কাছে মহান আাল্লাহর আমানত হল শরিয়ত ও ইসলাম। পরকালে এ ব্যাপারে আমাদেরকে প্রশ্ন করা হবে। আমাদের ধন-সম্পদ ও যৌবন এবং জ্ঞান-বুদ্ধি -এসবও আমানত। তবে ইসলামের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের ওপর অর্পিত মহান আল্লাহর আমানতের ভার আরও অনেক কঠিন। যার পদমর্যাদা যত বেশি তার দায়িত্বও তত বেশি।
মহান আল্লাহ যাকে বেশি উপযুক্ত মনে করেন তাকেই নবী ও রাসুল করেন এবং ইমামত বা নেতৃত্ব দান করেন। কোনো শিশুর ওপর তো আমরা গাড়ি চালানোর দায়িত্ব দেই না। তাই আমরা কেন নবী বা ইমাম হলাম না এ নিয়ে যেন দুঃখ না করি। বরং এমন কঠিন দায়িত্ব যে আমাদেরকে দেয়া হয়নি সেজন্য আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত। আমরা যেন নবী-রাসুল ও ইমামদের অনুসারী হতে পারি সে দোয়া করা উচিত এবং সেজন্য সচেষ্ট হওয়া উচিত।
যারা ইমাম হুসাইন (আ)'র আহ্বানে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ও ইয়াজিদের স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে এবং ইসলামকে রক্ষার কাজে ইমামের জিহাদে শরিক হয়নি তারা মহান আল্লাহর দেয়া আমানত রক্ষা করেনি। তাই তারা ঈমানের একটি বড় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হয়েছেন। নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত এসবও যথাযথভাবে আদায় করাটা হচ্ছে আমানত রক্ষার অন্যান্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া। বর্তমান যুগে নবী-রাসুলদের উত্তরসূরি বা ন্যায়পরায়ণ ইমামের প্রতিনিধির দায়িত্ব পালনকারী সত্যিকারের খোদাপ্রেমিক ও সংগ্রামী আলেমদের আহ্বানে জালিম শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অংশ নেয়াটাও ঈমানের এক বড় পরীক্ষা। এ লড়াই কখনও অর্থনৈতিক, কখনও সাংস্কৃতিক বা কখনও বুদ্ধিবৃত্তিকও হতে পারে।
সুরা আনফালের ২৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, হে ঈমানদারগণ, খেয়ানত করোনা আল্লাহর সাথে ও রসূলের সাথে এবং খেয়ানত করো না নিজেদের পারস্পরিক আমানতে জেনে-শুনে।
-আসুন আমরা পবিত্র এই রমজান মাসে ভেবে দেখি কিভাবে মহান আল্লাহ ও রাসুলের আমানত রক্ষা করা যায় এবং আমরা কোনোভাবে আল্লাহ ও রাসুলের খিয়ানত করে যাচ্ছি কিনা। মুসলমানদের ব্যাপারেও আমরা বিশ্বাসঘাতকতা করছি কিনা তাও গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে। বন্ধুর সঙ্গে, সহকর্মীর সঙ্গে, কর্মক্ষেত্রের দায়িত্বশীলের সঙ্গে, নিজ পরিবারের সঙ্গে, সন্তানের সঙ্গে ও স্ত্রীর সঙ্গে আচার-আচরণে আমানত রক্ষা করছি কিনা তাও ভেবে দেখা দরকার। বিশ্বের মজলুম জাতিগুলোর ব্যাপারে যেমন, মিয়ানমারের, কাশ্মিরের, ইয়েমেনের, বাহরাইনের ও স্বদেশের মুসলমানদের ব্যাপারে এবং প্রথম কিবলার দেশ ফিলিস্তিনের মজলুম মুসলমানদের ব্যাপারে আমরা কি আমাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছি যারা রাষ্ট্রীয় বড় কর্মকর্তা বা শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ তারা কি দেশ, সমাজ ও জনগণের আমানত রক্ষা করছেন?
মহান আল্লাহ আমাদেরকে সব ক্ষেত্রে যথাযথভাবে দায়িত্ব ও কর্তব্যকে বোঝার এবং সময়মত সেইসব দায়িত্ব সুচারুভাবে পালনের মাধ্যমে প্রকৃত আমিন তথা বিশ্বস্ত হওয়ার তওফিক দিন।#
পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবু সাঈদ/ ১২
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।