ইরানের কালজয়ী গল্প:
ইঁদুর ও বেড়ালের মুক্তি
প্রিয় পাঠক ও শ্রোতাবন্ধুরা! সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করি যে যেখানেই আছেন ভালো ও সুস্থ আছেন। ইরানের কালজয়ী গল্পের পসরা গল্প ও প্রবাদের গল্পের আজকের আসরে আমরা শুনবো চমৎকার একটি গল্প। গল্পটি এরকম:
জঙ্গলের ভেতর চমৎকার একটি গাছের নীচে একটা ইঁদুর একাকি বাস করতো। ইঁদুর প্রতিদিন ভোর বেলা সূর্য ওঠার সময় জেগে উঠে খাবারের সন্ধানে বের হতো। রাত হতে না হতেই আবার বাসা মানে গর্তে ফিরে গিয়ে খেয়ে-দেয়ে বিশ্রাম নিতো। গাছের নীচে যে গর্তে বাসা বেঁধেছিল ইঁদুর তার কাছেই বাস করতো একটা বেড়াল। ইঁদুর যেমন নাদুসনুদুস ছিল বেড়ালটাও তেমনি ছিল মোটাসোটা।
একদিন সকালবেলা ইঁদুর যখন তার দৈনন্দিন নিয়মে কাজে যাবার জন্য গর্ত থেকে বের হচ্ছিলো, আজব এক ব্যাপার দেখতে পেলো। বিষয়টা হলো তার প্রতিবেশি বেড়াল শিকারীর ফাঁদে আটকা পড়েছে। সুতরাং সে একেবারে নিশ্চিন্তে কোনোরকম ভয়ভীতি ছাড়াই গর্ত থেকে বেরিয়ে এলো। গর্তের বাইরে কয়েক পা দিতেই সে আটকে পড়া বেড়ালের দিকে তাকালো। হঠাৎ তার মনে পড়লো সে নিজের বাসা মানে গর্তের মুখ বন্ধ করে নি। তাই ফিরে যেতে চাইলো। কিন্তু তার চোখে পড়লো একটা নেউলে। গাছ থেকে একটু দূরে শিকারের সন্ধানে ওঁৎ পেতে আছে। ইঁদুর যেন পায়ে পেরেক মেরে বসে গেল, সামনে আর এগুলো না। গাছটির উপরের দিকে তাকালো। দেখতে পেলো গাছের ডালে বিশাল একটা পেঁচা শিকারের অপেক্ষায় বসে আছে। ইঁদুরের ভীতি আর বেড়ে গেল। ইঁদুর দেখলো তার চারদিকেই বিপদ। সে না পারছে তার বাসায় ফিরে যেতে না পারছে সামনে যেতে। হতাশ হয়ে বললো: সবদিক থেকে বিপদ আমাকে ঘিরে ধরেছে। গভীরভাবে মাথা খাটিয়ে কাজ করতে হবে। সে ভাবলো: এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হলো বেড়ালকে উদ্ধার করা। আর যাই হোক বেচারা এখন ফাঁদে আটকে আছে। বেড়াল আমার জন্য তুলনামূলকভাবে কম বিপদের। অন্যদিকে বেড়ালকে উদ্ধার করার মতো কেউ যদি থাকে, সে একমাত্র আমি। হতেও তো পারে পারস্পরিক সহযোগিতা আমাদের মুক্তির কারণ হবে। ইঁদুর সুযোগ বুঝে বেড়ালের দিকে দৌড়ে গেল এবং তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। স্বস্তির নিশ্বাস নিয়ে বললো: সালাম প্রিয় প্রতিবেশি আমার! কীভাবে কী হলো? বেড়াল জালের ভেতর থেকে তার দিকে তাকিয়ে বললো: দেখতেই তো পাচ্ছো কপালের ফের, ফাঁদে আটকা পড়েছি। যেমনটি তুমি সবসময় চেয়েছো!
ইঁদুর বললো:এরকম ভাবাটা ঠিক না। তোমাকে ফাঁদে আটকা দেখে আমারও খুব খারাপ লাগছে। ইচ্ছে করছে তোমাকে যে-কোনোভাবেই হোক উদ্ধার করি। জানি আমাদের মাঝে সুপ্ত শত্রুতা আছে কিন্তু আজ আমরা দুজনই বিপদে আছি। তুমি ফাঁদে আটকে আছো আর আমি নেউলে এবং পেঁচার ভয়ে আছি। কিন্তু যতক্ষণ আমি তোমার পাশে আছি ততক্ষণ ওদের কারও সাধ্য নেই আমার দিকে হাত বাড়ায়। তুমি যদি কথা দাও আমাকে ওই দুই শত্রুর হাত থেকে বাঁচাবে তাহলে আমিও কথা দিচ্ছি শিকারী আসার আগেই তোমাকে এই ফাঁদ থেকে বাঁচাবো। আমি কিন্তু অবিশ্বস্ত নই। তোমাকেও তাই শপথ করতে হবে বিশ্বাস ভঙ্গ করবে না। পারস্পরিক আস্থা এবং বিশ্বাস থাকলে আমরা দুজনই মুক্তি পাবো।
বেড়াল ইঁদুরকে জবাব দেওয়ার আগে একটু ভাবলো। ইঁদুরের কথায় তার বিশ্বাস জন্মালো। এর বাইরে করারও কিছু ছিল না। দুজনই বিপদে। সুতরাং আস্থা রাখাই উচিত। তা না হলে যে-কোনো মুহূর্তে শিকারী চলে আসতে পারে। তখন আর কিছুই করার থাকবে না। ইঁদুরকে বললো: তোমার কথায় আস্থা রাখা যায়। এটা হয়তো আল্লাহরই চাওয়া ছিল যে দুজনই বিপদে পড়ে বন্ধু হয়ে যাবো এবং আমাদের মধ্যকার শত্রুতা চিরতরে দূর হয়ে যাবে। আমি কথা দিচ্ছি কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করবো না। আজ থেকে তুমি আমার বন্ধু। ইঁদুর খুশি হয়ে বললো: তাহলে একটা কথা বলবো। বেড়াল বললো: বলো! ইঁদুর বললো: আমি যখন তোমার কাছে আসবো তুমি তখন এমন ব্যবহার করবে যেন নেউল কিংবা পেঁচা মনে করে যে আমাদের মাঝে বন্ধুত্ব বেশ গভীর। তাহলে ওরা আমার ওপর হামলা করার কথা ভাববে না, আমিও তোমাকে উদ্ধারের কথা ভাববো।
বেড়াল ইঁদুরের কথা মেনে নিলো এবং তাকে কাছে ডাকলো। ইঁদুর গেল এবং বেড়াল অনেক কষ্টে জালের ভেতর থেকে পা বের করে জীবনে প্রথমবারের মতো তার মাথায় আদর করে দিলো। ইঁদুরের ভয় হচ্ছিলো। তারপরও নেউল আর পেঁচা তো দেখেছে। সুতরাং ওরা আর হামলা না করে চলে গেল আর ইঁদুরও বেড়ালের আটকে পড়া জাল আস্তে আস্তে কাটতে শুরু করলো। বেড়ালের ভালো লাগলো না। সে ভাবলো ইঁদুর হয়তো চাচ্ছে না তাকে উদ্ধার করতে। বললো: তুমি মনে হয় চাচ্ছো শিকারী চলে আসুক আর তুমি আমাকে বিপদে রেখে দৌড়ে পালিয়ে যাও! ইঁদুর বললো: আমি বিশ্বাসঘাতক নই। তবে সেই জ্ঞানী যে নিজের উপকারও করে আবার পালানোর পথও খোলা রাখে। আমি তাই করছি। জালের সূতো একটা একটা করে কাটছি। তোমার বের জন্য যতগুলো ঘর কাটা দরকার শেষটা রেখে বাকিগুলো কাটবো।
এভাবে কাটতে কাটতে একটি ঘর বাকি থাকতে হঠাৎ কারো পায়ের শব্দ কানে এলো: বেড়াল ভয় পেয়ে গেল। ইঁদুর দেখলো শিকারী এগিয়ে আসছে। সেই মুহূর্তে শেষ গিঁটটা কেটে দিলো। শিকারী বেড়াল এবং ইঁদুরকে দেখে দ্রুত পা চালালো। কিন্তু শিকারী পৌঁছার আগেই গিঁট কেটে ফেললো ইঁদুর। বেড়াল ভয় পেয়ে ইঁদুরের কথা না ভেবেই দৌড়ে উঠে গেল গাছের মগডালে। ইঁদুরও তার গর্তে পালালো। আর শিকারী তার কাটা জাল নিয়ে ঘরে ফিরে গেল। পরদিন সকালে চারদিকে প্রশান্তির নীরবতা বিরাজ করলো। ইঁদুর তার গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে সতর্কতার সঙ্গে চারদিক তাকালো। হঠাৎ একটা শব্দ ভেসে এলো কানে। বেড়াল দূর থেকে বললো: সালাম! ইঁদুর থমকে গেল। বেড়াল বললো: অতো দূরে কেন? গতকালের দয়ার জন্য কৃতজ্ঞ আমি। ইঁদুর দূর থেকেই বললো: তোমার কথায় বিশ্বাস আছে আমার। তুমি মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দাও নি।
কিন্তু কাছে গেল না ইঁদুর। বললো: জ্ঞানী সে-ই, যে নিরুপায় হয়ে বিপদ থেকে উদ্ধার পাবার জন্য শত্রুর সঙ্গে হাত মেলায়। কিন্তু বিপদমুক্ত হবার পর শত্রুতার কথা ভুলে যায় না। সতর্ক থাকে সবসময়। এই বলে ইঁদুর ফিরে গেল তার বাসায়। বেড়াল দাঁড়িয়েই রইলো। তার মাথায় হাজারো প্রশ্ন উত্তরহীন রয়ে গেল।#
পার্সটুডে/এনএম/৩/৫৯
মূল ফার্সি গল্পের রূপান্তর: নাসির মাহমুদ