গল্প ও প্রবাদের গল্প:
ধৈর্য ধরো যাতে অনুতাপ করতে না হয়
প্রিয় পাঠক ও শ্রোতাবন্ধুরা! সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করি যে যেখানেই আছেন ভালো ও সুস্থ আছেন। ইরানের কালজয়ী গল্পের পসরা গল্প ও প্রবাদের গল্পের আজকের আসরে আমরা শুনবো চমৎকার একটি প্রাচীন প্রবাদের গল্প। প্রবাদটি হলো: 'ধৈর্য ধরো যাতে অনুতাপ করতে না হয়'।
প্রতিটি প্রবাদের পেছেনই কিন্তু একেকটা গল্প থাকে। এই প্রবাদের পেছনে সেরকম একটি গল্প আছে। গল্পটি এরকম: প্রাচীনকালে একজন বাদশাহ ছিলেন। বাদশাহ তো, কোনো কিছুরই অভাব ছিল না তার। কেবল একটাই ছিল না তার-সন্তান। বিয়ের পর বছরের পর বছর কেটে গেল কিন্তু আল্লাহ তাকে মানে তার স্ত্রীর গর্ভে কোনো সন্তান দিলেন না।
বাদশাহীর কোনো অর্থই থাকে না যদি তার সন্তান না থাকে। সুতরাং বাদশার মনটা সবসময় ভার হয়ে থাকতো। সেইসঙ্গে বাদশার স্ত্রী মানে রাণীর মনটাও বেদনাহত থাকতো সবসময়। নি:সন্তান হবার কারণে বাদশাহর মন খারাপ থাকলেও দেশের জনগণ কিন্তু বাদশাকে ভীষণ পছন্দ করতো, ভালোবাসতো। সে কারণে জনগণও বাদশাহর জন্য দোয়া করতো আল্লাহ যেন তাকে একটা সন্তান দান করেন। আল্লাহ জনগণের দোয়া কবুল করলেন এবং অচিরেই একটি সংবাদ সারা দেশময় চাউর হয়ে গেল যে বাদশার একটি সন্তান হয়েছে। ছেলে সন্তান।
বাদশাহর ছেলে সন্তান হবার খবরে সবাই যার পর নাই খুশি হলো এবং আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করলো। যে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত বাদশাহর সন্তান ছিল না তখন বাদশা সুন্দর একটা নেউলে নিয়ে মজা করে সময় কাটাতো। তার ওই নেউলেটা ছিল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। সে দারুন সব খেলা দেখাতো, মজার মজার কাজ করতো। সেসব দেখে বাদশাহ এবং তার স্ত্রীর মনের যাতনা কিছুটা সময়ের জন্য লাঘব হতো। জনগণ ভেবেছিলো যে সন্তানের বাবা হবার পর বাদশাহ হয়তো ওই নেউলের সঙ্গে খেলাধুলা করা ছেড়ে দেবেন এবং তাকে কোনো জঙ্গলে নিয়ে ছেড়ে দেবেন। যাতে করে সে তার বাকি জীবন নিজের মতো করে স্বাধীনভাবে অপরাপর প্রাণীর মতো কাটিয়ে দিতে পারে। কিন্তু জনগণ অবাক হয়ে দেখলো ব্যাপারটা সেরকম হয় নি।
বাদশাহ বরং আগের মতোই তার নিঃসঙ্গ জীবনের সঙ্গির মতো একইভাবে তাকে ভালোবাসতে লাগলো। তার সঙ্গে খেলাধুলা করতে লাগলো। পুত্রসন্তানহীন সময়কার নিঃসঙ্গতার কথা মনে করে বরং তাকে আরও বেশি যত্ন করতে শুরু করলো। তার খেলা দেখে মজা পেতো। বাদশার সন্তানের জন্য সেবক-সেবিকার অভাব ছিল না। একমাত্র সন্তান বলে কথা, তাও আবার পুত্র সন্তান-মানে বাদশার সিংহাসনের উত্তরাধিকার। সুতরাং সবাই খুব সাবধানতার সঙ্গে তাকে লালন পালন করতে লাগলো যাতে রাজপুত্র সুন্দরভাবে এবং সঠিকভাবে বেড়ে উঠতে পারে।
একদিন দুপুর বেলার কথা। বাদশাহর সন্তানের সেবিকা বা আয়া ব্যাপক ক্লান্তির কারণে ঝিমুতে ঝিমুতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। এমন সময় বিরাট একটা ভয়ংকর সাপ বাগানের ভেতর থেকে এসে ঢুকে পড়লো প্রাসাদের ভেতর। ধীরে ধীরে সাপটা বাদশার ছেলের রুমের জানালার কাছে গিয়ে পৌঁছে গেল। জানালার ভেতর দিয়ে সাপটা রুমের ভেতর ঢুকে পড়লো এবং সোজা চলে গেল রাজপুত্রের দোলনার কাছে এবং পরমুহূর্তেই দোলনার উপর। বাদশার পোষা নেউলেটি সে সময় ওই রুমের পাশেই খেলা করছিল। হঠাৎ তার নজর পড়ে গেল ওই সাপটির ওপর। এক মুহূর্তও নষ্ট না করে নেউলে দৌড়ে গিয়ে সাপের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। যার ফলে রাজপুত্রের গায়ে ছোবল মেরে কোনো ক্ষতি করার সুযোগ পেলো না সাপ।
সাপ-নেউলের কাহিনী তো সবারই জানা। ব্যাপক যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল তাদের মধ্যে। নেউলে সাপের কোমর কামড়ে ধরে এধার ওধার এমনভাবে আছড়াতে লাগলো যে একসময় সাপ দুর্বল হয়ে পড়লো এবং নিস্তেজ হয়ে গিয়ে মারা গেল। সাপ-নেউলের যুদ্ধের ফোঁস ফোঁস শব্দ শুনে রাজপুত্রের বিশেষ সেবিকা মানে আয়ার ঘুম ভেঙে গেল। রাজপুত্রের দোলনার উপর যে বিরাট সাপ পড়ে মরে রয়েছে সেদিকে নজর পড়লো না আয়ার। কিন্তু যখনই তার দৃষ্টি গেল নেউলের ওপর দেখলো দোলনার দিক থেকে রক্ত মুখে বেরিয়ে আসছে, চীৎকার দিয়ে উঠলো। বললো: হায় হায়! ওরে হিংসুক নেউলে! এ কী কাণ্ড করলি রে তুই! বাদশাহর সন্তানকে মারলি? আয়ার বেপরোয়া চীৎকার শুনে সবাই রাজপুত্রের দোলনার কাছে দৌড়ে গেল।
রাজপুত্রের মহিলা সেবিকা মানে আয়ার বেপরোয়া চীৎকার শুনে সবাই রাজপুত্রের দোলনার কাছে দৌড়ে গেল। তারাও দেখলো নেউলের মুখ থেকে রক্ত ঝরছে। বাদশাহ নিজেও দেখলো এবং ভয়ংকর রকমে রেগে গিয়ে তলোয়ার বের করলো। তারপর যা হবার তাই হলো। এক আঘাতে নেউলেকে দুই টুকরো করে ফেললো। তারপর রাণীর মতো সেও মাথা-বুক চাপড়াতে চাপড়াতে, কাঁদতে কাঁদতে দোলনার কাছে এগিয়ে গিয়ে রাজপুত্রের দিকে নজর দিলো। পুত্র জীবিত এবং হাঁসছে, হাত-পা নাড়াচ্ছে। তার গায়ের ওপর পড়ে আছে টুকরো টুকরো হয়ে পড়া সাপ। সবার হাত চলে গেল মুখের ওপর আর বিস্ময়রেখা ফুটে উঠলো কপালে, চোখে-মুখে তার স্পষ্ট ছাপ।
সবাই বুঝলো নেউলে হিংসা তো করেই নি বরং সে নিষ্পাপ রাজপুত্রের জীবন বাঁচাতে তার নিজের জীবনটাকেই মহাবিপদে ফেলে দিয়েছিল। বাদশাহ ভীষণ গম্ভীর হয়ে গেল। অনুতাপে তার বুকটা ফেটে যাচ্ছিলো। দীর্ঘ নি:সঙ্গ জীবনের বিশ্বস্ত সঙ্গীকে সে কোনোরকম বিচার বিবেচনা না করেই মেরে ফেললো! কিন্তু এখন তো আর অনুতাপ করে কোনো লাভ নেই। পরম বিশ্বস্ত বন্ধু নেউলেকে তো আর প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না। সে দিন থেকে বাদশা নেউলেকে হারানোর জন্য আফসোস করতে লাগলো এবং আশেপাশের সবাইকে বলতে শুরু করলো: ধৈর্য ধরো যাতে অনুতাপ করতে না হয়। এভাবেই চালু হয়ে গেল প্রবাদটি।#
পার্সটুডে/এনএম/৪/৬০
মূল ফার্সি গল্পের রূপান্তর: নাসির মাহমুদ